মাভৈঃ ভারত আবার জেগে উঠছে

লেখক
হরিগোপাল দেবনাথ

অগণিত ভারতবাসীদের প্রাণবলি, আত্মত্যাগ, দ্বীপান্তরে নির্বাসন,ও অপরদিক থেকে বেইমান আর বিশ্বাসঘাতক দালাল ও ব্রিটিশ শাসকদের অনুচরদের বর্বরচিত নিন্দাবাদ সমালোচনার গ্লানি সয়ে যাওয়ার--- বিনিময়ে ভারতবাসী সেদিন পণ্ডিত নেহেরুর হাত দিয়ে পাওয়া ‘রাজনৈতিক ক্ষমতা-হস্তান্তর চুক্তিকেই ‘‘দেশের স্বাধীনতা’’ বলে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন---১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট গভীর রাতের কালো অন্ধকারে৷ কিন্তু সেই স্বাধীনতার আস্বাদন কী রকম তা’ অবশ্যই বুদ্ধিমান ও বিচারশীল ভারতবাসী মাত্রেই আশা করি বুঝতে পেরেছেন আর এত বছরের ব্যবধানে তাঁদেরই বংশধরগণ, পরবর্তী প্রজন্ম যাঁরা অন্ততঃ নিজেদের চোখ দিয়ে দেখা, কোন দিয়ে শোনা আর আপন চিন্তা-বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে ভাবতেও শিখেছেন---তাঁরাও উপলদ্ধি করতে পারছেন৷

বিদেশাগত ব্রিটিশরা ছিল সাম্রাজ্যবাদী শোষক,অত্যাচারী শাসক,  নির্মম-নিষ্ঠুর দুর্বৃত্ত৷ তাই, না হয় ওদের কথা ছেড়েই দিলুম৷ কিন্তু সেই শোষকদের প্রকাশ্যে ও গোপনে মদত দিয়ে গেছেন, ব্রিটিশের অনুচরবৃত্তি সাদরে গ্রহণ করে তাদের পদলেহন করে গেছেন যে সকল মেটে-রঙের ভারতীয়রা তাদেরই একটা বিশেষ শ্রেণী কায়দা কানুন করে দেশমাতাকে খণ্ডিত করে আর দেশবাসীকে জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করে খণ্ডিত ভারতের শাসকগোষ্ঠী বনে গিয়েছিলেন৷ ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা হাতে নিয়ে একজন অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন নব-ভারতের (ব্রিটিশমুক্ত) প্রধানমন্ত্রীর মসনদে আর দ্বিতীয়জন অভিষিক্ত হয়েছিলেন বাঁকাচাঁদ-তারা খচিত সবুজপাতা হাতে উজিরে-ই আজম এর মসনদে৷

পণ্ডিত নেহেরুর নেতৃত্বাধীন খণ্ডিত ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনায়লেখা হয়ে গেল---‘‘গণতান্ত্রিক সমাজবাদ, স্বাধীন সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র’’কথাগুলো৷ উল্লেখ্য যে গণতন্ত্র আর সমাজবাদ দুটোই রাজনৈতিক তত্ত্বরূপে দু’মেরুতে অবস্থানরত বলে, প্রস্তর-নুড়ি আর ইটের টুকরোর মাঝখান দিয়ে যেমন বাতাস ও জল অনায়াসে ঢুকে যেতেই পারে, তদ্রূপ ওই দু’টো ‘তন্ত্রের’ ফাঁক গলেই নেহেরুজীর উর্বর মস্তিষ্ক প্রসূত ‘‘মিশ্রনীতি’’ নামীয় বড় রকমের ধাপ্পাবাজি৷

উঃ ভারতের অধিকাংশরাই গান্ধীজিকে এদেশে ‘‘জাতির পিতা’’ আর নেহেরুজীকে ‘‘নব ভারতের রূপকার’’ বলে আবেগ পূর্ত্তির তৃপ্তি পেতে চেয়েছিলেন৷ কিন্তু, আবেগের আতিশয্যবশতঃই গান্ধীজিকে ‘‘জাতির পিতা’’ আখ্যায়িত করার প্রমত্ততা পরবর্ত্তী সময়ে অনেকেরই দূরীভূত হয়েছে৷ তবে, নেহেরুজীর রূপকারিত্বের মোহ কাটতে পরবর্তী কয়েক দশক পার হয়ে যেতে হয়েছিল৷ ভারতের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পাশ্চাত্যে রেনেসাঁ ও শিল্পবিপ্লবোত্তর ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স, জার্র্মনী, আমেরিকা প্রমুখ দেশগুলোর ইন্ডাষ্ট্রিয়্যাল সভ্যতার সমৃদ্ধি লক্ষ্য করেই নেহেরু চেয়েছিলেন সস্তায় বাজীমাত করে নেবেন  ও তাই, তিনি কৃষিকে পেছনে ঠেলে রেখে শিল্পোদ্যগে মনোনিবেশ করেছিলেন৷ অবশ্য কিছুসংখ্যক দুর্মুখেরা এ কথাও বলেন যে, নেহেরু আসলে দেশীয় পুঁজিপতিদেরই ‘‘পুতুল’’সেজে গিয়ে যা করনীয় তা-ই করেছিলেন৷ তবে,নেহেরু তাঁর প্রথম পদক্ষেপেই যে ভুলটা করেছিলেন সেটি ছিল, মূলত ঃ কৃষি প্রধান ভারতে কৃষিকে উপেক্ষা করা৷ আবার, তিনি এটাও বুঝতে অক্ষম ছিলেন অথবা জেনেবুঝেই দেশীয় জমিদার-ভূস্বামীদের সাজানো বাগানে হাত বাড়াতে চাননি বলেই হয়তো বা চাষ-বাসের দিকটা এড়িয়ে চলেছিলেন৷ তস্য ফলম্‌ অনিবার্যমরূপে পরবর্তী সময়ে এল ‘পি-এল-৮৪’ চুক্তি অনুযায়ী আমেরিকার বস্তা-পচা আটা আমদানীর পালা৷ আর, একই ছকে চলতে গিয়ে ইন্দিরাজীর ‘‘গরীবী হঠাও’’ শ্লোগানের মাসুলসহ জাহাজডুবি হয়েছিল৷ তবে শাস্ত্রীজির প্রধানমন্ত্রীত্বকালে ‘‘খাদ্য-ফলন বাড়াও’’ (গ্রো মোর্‌ ফুড্‌) আন্দোলনে (যাকে কোন কোন অত্যুৎসাহীরা ‘সবুজ বিপ্লব’ বলতেও কসুর করেন নি) কিছুটা সাড়া জেগেছিল৷ নতুবা, অতীতের সেই তুর্কী-সুলতানী ও পাঠান মোগল নবাবী আমলের পর ব্রিটিশ শোষকদের আমল ব্যাপী বাঙলার তথা অখণ্ড ভারতবর্ষের কর্ষককুলের (চাষী-সমাজের) ওপর যে শোষনের বুলডোজার ও নির্যাতনের দু-মুখা বড়শীর আক্রমণ চলে আসছিল তাতে বিন্দুমাত্রও আঁচড় কাটত না৷

পৃথিবীবাসীমাত্রেই জানেন, প্রাচীন ভারতবর্ষ সুমহান ঐতিহ্য ও ঐশ্বর্যের অধিকারীরূপেই বিশ্ববাসীকে জ্ঞানের দীপ্তালোকে উদ্‌বাসিত করেছিল৷ প্রাগৈতিহাসিক যুগ তথা ‘ভারতবর্ষ’ নামকরণ হবারও  পূর্ব থেকে গণ্ডোয়ানাল্যাণ্ডের উর্বরাংশ যা ‘রাঢ়ভূমি’ নামে আখ্যাত ছিল, সেই ভূ-ভাগ তৎকালীন বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের ভরণপোষণ যোগাতে বলেই এর নাম হয়েছিল পরবর্ত্তীকালে ‘ভারতবর্ষ’৷ কিন্তু, সেই ভারতবর্ষকে ব্রিটিশরা এসে দ্বিখণ্ডিত করেছিল ও বাঙলাকে বানরের পিঠে ভাগের মত বহুখণ্ডে বিভক্ত করে তছনছ করে গেছে৷ পরে সেই খণ্ডিত ভারতের বুকে বসে হিন্দী-সাম্রাজ্যবাদী দুঃশাসকেরা আপামর ভারতবাসীর--- চাকরীজীবী, শ্রমজীবী, নিরক্ষর, দরিদ্র নিঃস্ব-রিক্ত ভারতবাসীকে দশকের পর দশক শোষণ করে চলেছে৷

বিগত সাত আট দশক ধরেই নামে বেনামে-ছদ্মনামে, নানারূপ ধরে পুঁজিবাদী গোষ্ঠীর ক্রীড়নক তথা দাসানুদাস সেজে শুধু নিজেদের  ক্ষমতাভোগের লালসাকে চরিতার্থ করতে নিরীহ ভারতবাসীর রক্তমোক্ষণে রত হয়েছে৷ আর এই জঘন্যতম কীর্তিকলাপের অনিবার্য পরিণতিস্বরূপ বর্তমান ভারতের এই শোচনীয় পরিস্থিতি ও মহার্দুদৈব উপস্থিত হয়েছে৷ কর্ষককুল তাদের জমি ছেড়ে উঠে এসেছে রাজধানী দিল্লী নগরীর রাজপথে৷ ক্রমশঃ ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশটার  প্রান্তে প্রান্তে৷ যে চাষীরা চাষের কাজ ফেলে খাওয়ার সময়টুকু পান না, তারাই আজ কাজে জলাঞ্জলি দিয়ে শীতের প্রকোপ সহ্য করে ধর্ণা, অবস্থান সত্যাগ্রহ অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন৷ কেন? এই কেন-রও সঠিক উত্তর একটাই ---বর্তমান মোদী-সরকারের করিতকর্মাগিরি --- দেশের পুঁজিপতি মজুতদার, মুনাফাখোর, ব্যবসাদার ও কোম্পানী মালিক তথা কর্র্পেরেট ---মালিকানার স্বার্থে প্রস্তুত বর্তমান কৃষি-আইন, যা শুধু কর্ষক ---মারার আর পুঁজিপতিদের মুনাফাবৃদ্ধির  অব্যর্থ ‘‘রাষ্ট্রানুমোদিত হাতিয়ার’  হতে  চলেছে তারই প্রতিবাদে  যুগ-যুগান্তরে মার খাওয়াদের তীব্র জেহাদের অভিপ্রকাশ৷

উল্লেখ করতে হচ্ছে যে, এর পাশাপাশি চলেছে শ্রমজীবীদের, পরিযায়ী শ্রমিক সে দেশের ভেতরে বা বাইরে যেখানকারই হোক, বর্তমান লক -ডাউনগ্রস্ত-পরিস্থিতিতে বা অন্যান্য কারণবশতঃও যারা কাজ হারিয়ে পথে বসেছেন, তারা কিন্তু এখনও নীরব৷ ওদের বুক ফেটে যাচ্ছে তবুও মুখে রা বেরোচ্ছে না৷ তবে ছাই-চাপা আগুন অন্তঃসারশূন্য মিথ্যে ছলনায়, হুমকি-ধমকিতে, নোংরা পলিটিক্যাল বজ্জাতির ছাই ছড়িয়ে দিয়ে বুভুক্ষু জনতার ঘুষঘুষে আগুনকে আর কতদিন চাপা রাখতে পারবেন ওরা৷

দেশজুড়ে কোটি কোটি মানুষের বেকারত্ব,ঘুষখোরিতে শীর্ষে আরোহনের প্রবণতা, কালো টাকা বিদেশী ব্যাংকে জমা রাখার পর, দেশের  ব্যাংক খালি করে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে পাড়ি দিয়ে গা ঢাকা দিয়ে থাকার সুযোগ পাওয়া,প্রকারান্তরে দেশে অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে এলে মুখে ক্যাশলেশ ইন্ডিয়া, ডিজিটাল ইন্ডিয়া, রাইজিং বা শাইনিং ইন্ডিয়া ইত্যাদি গালভরা শ্লোগান শুনিয়ে  মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে নোটবন্দী ও নোটে ছাপানোর মত হঠকারিতা করে সত্যটাকে ধামাচাপা দেবার জাদুগিরিতে বোধ হয় আর বেশী সময় মানব-শত্রুরা সুযোগ পেতে পারেন না৷

দেশের শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থানের জন্যে প্রথমতই প্রয়োজন সু-সন্তুলিত অর্থনীতির রূপায়ণ ও ব্লক-ভিত্তিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ৷ কৃষিতে শিল্পে, বাণিজ্যে একান্তভাবেই যুদ্ধকালীন জরুরী ভিত্তিতে প্রয়োজন সামবায়িক ব্যবস্থাপনার বাস্তবায়ন৷ কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা! ভবি কিছুতেই ভুলবার নয়৷ কারণ? কারণটা অতীব পরিষ্কার৷ ব্রিটিশমুক্ত ভারতে সংবিধান খসড়া রচনা কমিটিতে ছিলেন--- ব্রিটিশদেরই মনোনীত অধিকাংশদের বাইরে গুটিকয়েক দেশীয় বিত্তবান,জমিদার ও অভিজাতশ্রেণীর প্রতিনিধিরা দেশের শ্রমজীবী, কর্ষক--- এদের কোন প্রতিনিধিত্ব ছিল না  আর ছিল না বলেই---(ক) কর্মসংস্থানের অধিকার, (খ) বাঁচার জন্যে ন্যূনতম চাহিদাগুলো--- খাদ্য,বস্ত্র,বাসস্থান,শিক্ষা ও চিকিৎসার মত অধিকারগুলো মানুষের মৌলিক অধিকার বলে স্বীকৃত হল না বা আজও সেই স্বীকৃতি মিলছে না৷

সারা দেশজুড়ে বিধানসভা, বিধান পরিষদ আর কেন্দ্রীয় স্তরে  লোকসভা ও রাজ্যসভার সাংসদদের সংখ্যা একত্রে কম করেও ৪১০০-র উপরে বই নীচে হবে না৷ তো গড়ে প্রত্যেকের মাথাপিছু সান্মানিক ভাতা বাবদ মাসে ২,০০০০০টাকা করে ধরলেও মাসে রাজকোষের ব্যয় দাঁড়াচ্ছে মোট ৮২ কোটি টাকা৷ তদুপরি আরও লাগবে তাঁদের বিলাসপূর্ণ বাসভবন, গাড়ী-আমলা, ইলেকট্রিক বিল, যাতায়াত-ব্যয়বহর৷ তারও সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আমলাতান্ত্রিক, মাথাভারী প্রশাসনিক ব্যয়বহর৷ সবকিছু মিলিয়ে খরচের পরিমাণ সহজেই নিরূপনেয়৷ তা সত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে রাজ্য বা কেন্দ্রের প্রাইবেটাইজেশনের প্রবণতা৷ এটাকে পুঁজিবাদ ছাড়া আর কি বলা যায়? তাই বলতে হচ্ছে নয়া শিক্ষানীতি (২০২০) আর নয়া কর্ষক-নীতি ইত্যাদি যা-ই বলুন সে-সব বিল এ্যাসেমব্লিতে বা পার্র্লমেন্টে নামকা বাস্তে হলেও, এর আঁতুড়ঘরটা কিন্তু রয়ে গেছে বিত্তবানদের প্রমোদকক্ষে---যেখানে খানা-পিনা নাচা-গানা আর টুংটাং ধবনিসহ ওষ্ঠ-অধরে বড় ব্যবধান ঘটিয়ে উদরগহ্বর থেকে নিষ্কাষিত সশব্দ বায়ু-বমনের মাধুর্য লালিত মস্তি-দোস্তি-দুশমনি সবটাই চলে৷

১৯৮৯ সালে, হিমাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী বীরভদ্র সিং এক ভাষণে বলেছিলেন---‘‘দেশে নির্বাচনী ব্যয় মেটবার জন্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে লালফিতা কাটবার জন্যে শিল্পপতি ও ধনী ব্যবসায়ীরা নগদ টাকা ঢেলে দেন বলেই, দুর্নীতিটা জীবন-পথ (ওয়ে অব্‌ লাইফ) হয়ে উঠেছে৷

সম্প্রতি ‘অক্সফাম’’ সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়  দেশের মোট জাতীয় সম্পদের ৪১.৪৩ শতাংশ মজুত রয়েছে জনসংখ্যার ১শতাংশ মানুষের হাতে ও ৭৭.৪১ শতাংশ সম্পদ গচ্ছিত রয়েছে ১০ শতাংশ লোকের কাছে৷ আর নিম্নতলার ২০ শতাংশ লোকের হাতে রয়েছে মোট সম্পদের ৯.২ শতাংশ মাত্র৷ ধনী-গরীবের ব্যবধান আর পরিষ্কারভাবে ধরা পড়ে যায় যখন দেখি, উক্ত ১শতাংশ লোকেদের দৈনিক গড় পড়তা রোজগার ২২০০ কোটি টাকা৷ এই বৈষম্য দূর করতে আশু জাগরণ প্রয়োজন৷