মানব দেহে কন্ঠ নিসৃত ভাষার অভিব্যক্তির উৎস সন্ধানে

লেখক
সমরেন্দ্রনাথ ভৌমিক

আমরা ব্যাকারণে পড়েছি, ভাব হ’তে ভাষার উৎপত্তি হয়৷ অর্থাৎ মনের ভাবকে কন্ঠনালির দ্বারা অভিব্যক্তিকরণই হ’ল ভাষা৷ মানবদেহ হ’ল একটি জৈব যন্ত্র বিশেষ Human body is a biological machine) এবং এই যন্ত্র চালিত হয় মানব মনের দ্বারা৷ কিন্তু এই মানব মনের মধ্যস্থিত ‘ভাব’ শক্তি কিভাবে অবস্থান করে ও কিভাবেই বা এই ভাব শক্তি মনের মধ্যে ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে থাকে৷ ভাব হ’তে ভাষার রূপান্তরের নেপথ্য কারণটিকে জানতে হ’লে, আমাদের এই Biological machine-এর সংরচনা জানলে তবেই ভাব হ’তে ভাষায় রূপান্তরের কারণ জানা সহজ হবে৷ আজকের আলোচ্য বিষয়টি শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের ব্যাকরণের অভিমত অনুসারে লেখা হল৷ আমাদের মেরুদণ্ডের মধ্যে রয়েছে ছ’টি চক্র Plexus) এই ছটি চক্র হ’ল মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মনিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ ও আজ্ঞাচক্র৷ মেরুদণ্ডের নীচের দিকে শেষ প্রান্তে আছে মূলাধার চক্র, আর এই মূলাধারই হ’ল সমস্ত ভাবশক্তির আশ্রয়স্থল, এখানেই ভাবশক্তি অবস্থান করে৷

এখন মানুষ কথা বলে বিশেষ বিশেষ ধবনির সাহায্যে, আর এই ধবনির উৎপত্তি হয় নিঃশ্বাস বায়ু থেকে৷ এই নিঃশ্বাস বায়ু শ্বাসনালী দিয়ে কন্ঠনালীতে৷ তারপর কন্ঠনালী হ’তে গলা ও নাকের মাধ্যমে গিয়ে মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে ও এই  বেরিয়ে আসা ধবনিটাই আমরা শুনতে পাই৷

মানুষের ভাব থেকে ভাষায় রূপান্তর হওয়াটা ঘ’টে থাকে ছ’টি স্তরের মধ্য দিয়ে৷ এই ছ’টি স্তর হ’ল যথাক্রমে---

(১) পরা (২) পশ্যন্তী

(৩) মধ্যমা (৪) দ্যোতমানা

(৫) বৈখরী (৬) শ্রুতি গোচরা৷

আমরা যা কিছু বলছি বা যা কিছু বলব সেই বলার সম্ভাবনা অর্থাৎ বাকস্ফূরণের সমস্ত অভিব্যক্তির ক্ষমতা বা শক্তি বীজরূপে মূলাধার চক্রে নিহিত থাকে৷ এই শক্তিকে বলা হয়,‘পরাগতি’৷ এই বীজরূপী পরাশক্তিকে যখন কল্পনার ভাবরূপ দেওয়া হয় তখন ধবনিটা কল্পলোকেই থেকে যায়৷ এই অবস্থায় ধবনির কল্পলোকে থাকাটাকেই ব্যাকরণ সম্মতভাবে বলা হয় ‘পশ্যন্তী’৷ এরপর পশ্যন্তী শক্তি স্বাধিষ্ঠান চক্রে এসে অবস্থান করে এবং কি বলতে চাইছি সেটা মনে মনে যেন দেখতে পাচ্ছি বলে অনুভব হয়৷ পরবর্তী ধাপে পশ্যন্তী শক্তি মনিপুর চক্রে এসে প্রথম প্রাণশক্তির সাহায্য পায় ও ভাবকে ভাষায় রূপান্তর করার আকুতির সম্ভাবনা দেখা দেয়৷ একেই বলে ‘মধ্যমা’ শক্তি৷ অনেক সময় আমরা বলি---‘কথাটা যেন পেটে আসছে, মুখে আসছে না এরূপ বলার কারণ হ’ল---যেহেতু মনিপুর চক্রটি পেটে অবস্থিত, সেহেতু বাক্‌শক্তি ভাবটা পেটের কাছে এসে গেছে কিন্তু স্মৃতি ভ্রংশের দরুণ এই ভাবকে আমরা ভাষায় রূপদান করতে পারছি না৷’ তাই দেখা যাচ্ছে ঐ ‘পেটে আসছে, মুখে আসছে না’ কথাটা ব্যাকরণ বিজ্ঞান সম্মত৷

এর পরের স্তরটি দ্যোতমানা৷ অর্থাৎ মধ্যমা শক্তি ভাব শক্তিকে প্রায় ভাষায় রূপ দিতে চলেছে৷ ‘দ্যোতমানা’ কথার মানে হ’ল কম্পমান বাVibrate  করা৷ এরপরে এই ‘দ্যোতমানা’ কন্ঠে বা Vocal cord-এ এসে পৌঁছায়৷ এই অবস্থায় ভাষা স্থূলরূপে রূপান্তরিত হচ্ছে৷ এই অবস্থাটাকে ব্যাকরণে বলা হয় ‘বৈখরী’৷ বৈখরী অবস্থাটা হচ্ছে ভাবের ভাষায় রূপান্তর, হ’য়ে গেছে৷ সবশেষে এই বৈখরী শক্তিটা জিব, আলজীব, দাঁত ও ঠোঁট প্রভৃতির সাহায্য নিয়ে বাইরে ভাষারূপে ব্যক্ত হ’য়ে শব্দSound রূপে বেরিয়ে আসে৷ তখনই বেরিয়ে আসা শব্দকে বলি মুখের ভাষা৷ একেই বলা হয় ‘শ্রুতিগোচরা’ শব্দ৷

‘ভাব’ হ’তে ‘ভাষায়’ রূপান্তর বা Transmission হয় কিভাবে, তার একটা বাস্তব দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক্‌৷ ধরা যাক্‌ কোন এক ব্যষ্টির ‘তৃষ্ণার ভাব’ মূলাধার চক্র হ’তে উৎপন্ন হ’য়ে পূর্ব উল্লেখিত ছ’টি ধাপ অতিক্রম ক’রে বৈখরী, তারপর শ্রুতিগোচরা হ’য়ে ভাষায় ব্যক্ত করল ও তার মনের পিপাসার ভাবকে বাংলায় বলল---‘আমাকে  এক গ্লাস জল দাও৷’ আবার কেউবা এই ভাবকে ইংরাজীতে বলল---Give me a glass of water) কেউবা হিন্দিতে  বলল---‘ এক্‌ গ্লাস পানী দিজিয়ে৷’ অর্থাৎ এই পিপাসা ভাবটা পৃথিবীর সকল মানুষেরই সমান৷ এই ভাবটা  বৈখর স্তরে উপস্থিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত পৃথিবীর সকল মানুষেরই একই৷ এই একই ভাবশক্তি শুধুমাত্র বৈখরী ও  শ্রুতিগোচরা স্তরে পৌঁছে গিয়ে অভিব্যক্তির ভাষাটা কেবল মানুষে মানুষে তফাৎ হয়৷ এই দুটি স্তরের বিভিন্নতার জন্য বিভিন্ন দেশের মানুষ বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে৷ তাহলে দেখা যাচ্ছে হ’ল ভাব বিনিময়ের  একটা বাহন মাত্র৷ মনের ভাবকে বোঝাতে হ’লে কোন না কোন একটা ভাষায় তা প্রকাশ করতেই হবে৷ তবুও  আমরা অতীতের ইতিহাস দেখেছি, এই ভাষা নিয়ে অনেক রক্তক্ষয়ী বিপ্লব ঘটে গেছে৷

মহাপ্রাজ্ঞ ভাষাবিদ শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন--- সব  ভাষার শব্দ সম্ভারের Vocabulary) বুৎপত্তি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, সব ভাষারই রীতি পদ্ধতি এক৷ পৃথিবীর সব ভাষাই একসূত্রে বাঁধা---‘সুত্রে মনিগণা ইব৷’