মানব জীবনে বিজ্ঞান ও ধর্ম

লেখক
সৌমিত্র পাল

পুর্ব প্রকাশিতের পর

ধর্ম ও মানব জীবন :

যে কোন সত্তারই নিজস্ব ধর্ম  আছে৷ ‘‘ধর্ম কে বাদ দিলে সত্তার অস্তিত্বইবিনষ্ট হয়ে যাবে৷ সত্তার অস্তিত্ব ও তার ধর্ম অঙ্গাঙ্গিকভাবে সংযুক্ত--- যেন একটি মুদ্রার দুই পিঠ৷ এক দিককে বাদ দিলে আরেক  দিকের অস্তিত্ব নষ্ট হয়ে যাবে৷৷ আনন্দমূর্ত্তিজী ধর্মের  ব্যাখা করতে  গিয়ে বলেছেন --- সংস্কৃত ধৃধাতুর সাথে  মনপ্রত্যয় করে ধর্ম শব্দের  উৎপত্তি৷ তাই ধর্ম মানে হল প্রতিটি সত্তা এমন কিছু বিশেষ গুণ ধারণ করে আছে যা সেই সত্তার পরিচিতি বহন করছে৷  আগুনের ধর্ম দহন করা বা দাহিকা শক্তি৷ একইভাবে জলের ধর্ম ভিজিয়ে দেওয়া, চুম্বকের ধর্ম লোহাকে আকর্ষণ করা প্রভৃতি৷ জল যদি কোন কিছুকে ভেজাতে না পারত কিংবা চুম্বকের মধ্যে আকর্ষণ গুণ না থাকত তবে ঐ সত্তাগুলি তাদের পরিচিতি হারাতো৷ যে বিশেষগুণSpcial quality) সত্তাকে আমাদের কাছে পরিচয় করাচ্ছে, সেইগুণই সত্তার নিজস্ব ধর্ম৷ এই ধর্ম সত্তার অস্তিত্বের মধ্যে ওতোপ্রতে সংযুক্ত৷  ধর্মকে সত্তার অস্তিত্ব থেকে আলাদা কখনোই করা যাবে না৷ একই ভাবে প্রতিটি জীবের ও নিজস্ব ধর্ম রয়েছে যা তাদের পরিচিতি বহন করে৷ জীবের ধর্ম কী? শাস্ত্রে বলা হয়েছে: ‘‘সুখানুরক্তি পরমা জৈবীবৃত্তি’’

অর্র্থৎ সুখের অন্বেষনই জীবের ধর্ম৷ কেউ দু:খ চায় না৷  প্রতিটি  জীব তাদের কাজের মাধ্যমে সুখের অনুভূতি অর্জন করতে চায়৷ সুখ পাবার ইচ্ছা তার মনের সহজাত এষনা৷ সুখের আশা বিনষ্ট হলে কোন জীবই বাঁচবে না৷ তার অস্তিত্বই হারিয়ে যাবে৷ বাস্তব জগৎ তার কাছে  নিরস নিষ্ঠুর  হয়ে উঠবে এবং পরিশেষে  আত্মহত্যা করতে  চাইবে৷ যাইহোক জীবমাত্রেই প্রধান চার প্রকার প্রবৃত্তি Prophensity) ক্ষুধা নিদ্রা ভয় ও যৌনতা দ্বারা পরিচালিত হয়৷ উক্ত বৃত্তিগত চাহিদা মিটলেই সে  সুখী হয়৷ যেমন ক্ষুধা বৃত্তির তাড়নায় সে খাবার খায়, নিদ্রাবৃত্তির  প্রভাবে বিশ্রাম নেয় , ভয় বৃত্তির  মাধ্যমে বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রন করে আর যৌন বৃত্তির প্রভাবে বংশ বিস্তার করে৷ প্রকৃতির নিয়মে উক্তবৃত্তি চৌহদ্দি তার জীবনকে পরিচালিত করে সুখের অনুভূতি এনে দেয়৷ উক্তবৃত্তিগুলিকেই জীবের ধর্ম (জৈবধর্ম) বলা হয়৷

এবার আলোচনা করব মানবধর্ম সম্পর্কে৷ মানুষ উন্নত মনপ্রধান জীব৷ তার দেহ মনের সংরচনা শুধু অপরাপর মনুষ্যেতর জীব-জন্তুর থেকে স্বাতন্ত্র্যই নয় বরং শ্রেষ্ঠ ও বিবতর্নের ধারায় Through Evaluation)পশুজীবন থেকেই মানবজীবনের সুত্রপাত ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় ১০ লক্ষ বছর পূর্বে৷ তাই পশুবৃত্তির প্রাবল্য (ক্ষুধা নিদ্রা ভয় ও যৌনবৃত্তি) মানব মনে থাকবেই৷ কিন্তু পশুর ন্যায় উক্ত চার প্রকার বৃত্তিই তার মন কে সন্তুষ্ট করতে পারে না৷ এই বৃত্তিগুলি তার মনের প্রাথমিক চাহিদাBasic need) পূরন করলেও, (মনের) মৌলিক চাহিদা পূরন করতে পারে না৷ তার মনের এই মৌলিক চাহিদারই কারণেই সে অন্যান্য জীবের থেকে আলাদা৷ তার মনের মৌলিকত্বই Nomenclature Gnality) তাকে মানুষে উন্নীত করেছে... শ্রেষ্ঠ জীবের পরিচিতি প্রদান করছে৷ তাই এটাই তার প্রকৃত ধর্ম  তথা মানব ধর্ম৷ এই মৌলিক গুন তথা মানব ধর্ম কী? তা তার আচরণ বিশ্লেষন করলেই খঁুজে পাবে৷

মানবধর্ম তথা মানুষের  মৌলিক গুন খঁুজতে  গিয়ে মনোবিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন  যে--- প্রতিটি মানুষের মধ্যে অভাব (অপূর্ণতা) রয়েছে৷ এই অভাব আসলে তার মনের অভাব৷ কতটা অভাব? এই ভাবের শেষ নেই .... অসীম অনন্ত অভাব৷ এই অভাব পূরণের জন্যে সে অনবরত কিছু না কিছু  করে চলেছে প্রতিনিয়ত৷ অভাব মেটানোর তাগিদই আকাঙ্খা৷ আকাঙ্খার পূরণ হলেই সে সুখী হয়৷ অন্যথায় সে সর্বদাই অসুখী৷ এই  আকাঙ্খাকে তৃপ্ত করার জন্যে তার মন সর্বদাই জাগতিক সম্পদের দিকে ধাবিত  হয়৷ জাগতিক সম্পদ যতই  সম্পদশালী হোকনা কেন তা অবশ্যই সসীমঅর্র্থৎ  তার একটা নির্দিষ্ট সীমা পরিসীমা থাকবেই৷  কিন্তু মনের আকাঙ্খা অসীমঅর্র্থৎ যা সমস্ত সীমা পরিসীমার ঊধের্ব৷ তাই মনের আকাঙ্খা যেখানে অসীম সেখানে সসীম জাগতিক সম্পদ কিভাবে তৃপ্ত করতে পারে? অসীম আকাঙ্খা তো কেবলমাত্র অসীম সম্পদেই তৃপ্ত হতে পারে.... সমীম সম্পদে নয়৷ সমাজে এর কতই না নজির খঁুজে পাই --- সম্পদের পাহাড় তৈরী করেও  ধনবান চিরসুখী নয়.... সে চায় আরো আরো (অসীম) সম্পদ সঞ্চয় করতে  একইভাবে যশস্বী আরো আরো (অসীম) যশ খ্যাতি  অর্জন করতে চায়, ক্ষুদ্র নেতা ক্ষমতার আরো আরো (অসীম) শীর্ষস্তরে পৌঁছতে চায়... প্রদেশ নেতা রাষ্ট্রনেতা হতে চায়, রাষ্ট্রনেতা বিশ্বনেতা হতে চায় আবার বিশ্বনেতা হয়েও দিগ্বিজয়ী বীর আলেকজান্ডারের আকাঙ্খা যে অতৃপ্ত ছিল তা প্রতিটি ইতিহাস পাঠক মাত্রেই জানেন৷

মানবমনের গুপ্ত অসীম অভাবকে (আকাঙ্খাকে) উপলদ্ধি  করে দার্শনিক কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থই মন্তব্য করেছন:

        ‘‘যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই

          যাহা পাই তাহা চাই না৷’’

মানব ধর্ম যে তার মৌলিকগুণ তথা অসীম আকাঙ্খাকে  কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে তার পরিতৃপ্তির পথ কোথায় ? আগেই বলেছি এই অসীম অভাব একমাত্র অসীমেই পরিতৃপ্ত হবে সসীম কিছুতে নয়৷  একটা ছোট্ট উদাহরণের সঙ্গে বোঝানো যেতে পারে--- ধরা যাক ১০০ ওয়াটের বৈদ্যুতিক বাল্বের কাছ থেকে যদি ১০০০ ওয়াটের আলো আশা করে থাকি তবে তা  কখনো দিতে পারবে না৷ ১০০০ ওয়াটের আলো পেতে গেলে একমাত্র ঐরকম ক্ষমতাসম্পন্ন বাল্বের কাছেই যেতে হবে, তবেই তা পাওয়া সম্ভব হবে৷

          অনুরূপভাবে অসীম অভাব(আকাঙ্ক্ষা) পূরণ করতে গেলে অসীম সত্তাকেই পেতে হবে... তাঁতেই মনকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে--- সসীম সত্তাতে নয়৷ আনন্দমার্গ দর্শণে ব্রহ্মাকেই অসীম সত্তা বলা হয়েছে৷ ব্রহ্মের অর্থ ব্যাখ্যা করা হয়েছে দুভাবে৷

   এক ঃ- বৃহত্বাৎ ব্রহ্ম অর্র্থৎ ব্রহ্ম হলেন বৃহৎ৷  সংস্কৃত শব্দ বৃহৎআর বিশালএর মধ্যে পার্থক্য আছে৷  বিশাল মানে বড় কিন্তু তার একটা সীমা(পরিসীমা) থাকবেই, যেমন ঐরাবত পর্বত সমুদ্র সূর্য প্রভৃতি৷ কিন্তু বৃহৎমানে অসীমযাঁর কোন সীমানা নাইআদি নাই, অন্ত নাই৷ এই অর্থে ব্রহ্মহলেন একমাত্র অসীম-অনাদি অনন্ত সত্তা৷

   দুই ঃ- বৃহংনত্বাদ ব্রহ্ম অর্র্থৎ অপরকে অসীম করবার যোগ্যতা রাখেন যিনি তিনিই ব্রহ্ম৷ একটিEnlish proverb এ বলা হয়েছে --- () অর্র্থৎ মন যেমন ভাবনা নেবে তেমনই অবস্থা প্রাপ্ত হয়ে যাবে৷  আগেই বলেছি যে অসীমে মন প্রতিষ্ঠিত হলে মনের অসীম আকাঙ্খার পরিতৃপ্তি ঘটবে৷ তখন সসীমের প্রতি আসক্তি কেটে যাবে..... বিষয় তৃষ্ণার চিরনিবৃত্তি ঘটবে সবাই চায় অসীম অভাব পূরণ করে সুখ পেতে৷ কতটা সুখ? সীমিত(অল্প) সুখে যে তুষ্ট হয় না সে চায় সীমাহীন (অসীম), অন্তহীন(অনন্ত) সুখ৷ ‘‘সুখম্ অনন্তম্ আনন্দম্’’--- এই অনন্ত অসীম সুখকেই দর্শনের ভাষায় আনন্দ বাBliss বলা হচ্ছে৷ সকলেই এই আনন্দকে পেতে চায় আর তা পাওয়া যাবে একমাত্র ব্রহ্ম থেকেই ৷ তাইতো সম্পর্কে বলা হয়৷

      ‘‘আনন্দম ব্রহ্ম ইত্যাহ’’ (আনন্দসূত্রম্)

          অর্র্থৎ অসীম অনন্ত সুখই আনন্দ আর আনন্দই হলেন ব্রহ্ম৷ এই আনন্দময় ব্রহ্মে মন প্রতিষ্ঠিত হলে মনের  চিরন্তন আকাঙ্খা মিটে যায়... মনের মৌলিক চাহিদার অবসান হয়৷ মনে আসে পরম প্রশান্তি৷ তাই মনকে অসীমে স্থাপন করাই মানব ধর্ম৷ জ্ঞাতসারেই হোক কিংবা অজ্ঞাতসারে মানুষ পরম শান্তির পথে... আনন্দের পথে  চলতে চায়--- যা তাঁর অন্তরের চিরন্তন অভিলাস৷ যুক্তির আলোকে তাই বলা যায় যে শান্তির মার্গ বা আনন্দের মার্গই প্রকৃতপক্ষে মানবধর্ম৷ এই মানবধর্ম সম্পর্কে আনন্দমূর্ত্তিজীর কালজয়ী একটি মন্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্য পূর্ণ৷ তিনি স্পষ্টই বলেছেন:

‘‘বৃহদেষনা প্রণিধানঞ্চ ধর্মঃ’’ (আনন্দসূত্রম্)

বৃহৎ(অসীম)ব্রহ্মের এষনা তথা তাঁকে পাবার ইচ্ছা প্রতিটি মানব মনেই প্রসুপ্ত থাকে৷ মন তাঁকেই পেতে চায় তাঁকে ভালোবেসে আনন্দে স্থিত হতে চায়---‘‘জেনে বা না জেনে ভালবাসি  একই জনে (ব্রহ্মকে) সে ভালবাসার নাহি অন্ত... সবার তুমি আনন্দ’’ তাঁকে পেলেই সকল অভাব (আকাঙ্খা) বিদূরিত হয়ে যায়৷ মনের অসীম তৃষ্ণা অসীমেই সমাহিত হয়ে গিয়ে পরম প্রশান্তিতে মন প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়৷ ‘‘জ্ঞাতসারে হোক কিংবা অজ্ঞাতসারে মানুষ অন্তরের পানে ছুটে চলেছে৷ মানুষ যখন জ্ঞাতসারে এই বৃহৎকে  বুঝিয়েছেন৷ তাদের মতে এই শক্তিকণাEnergy)পাবার চেষ্টা করে ও তজ্জন্য ঈশ্বর প্রণিধন প্রধান করে তখন  তার সেই ভাবের নাম ধর্ম  ও সেই প্রচেষ্টার নাম ধর্ম সাধনা৷’’     (ক্রমশঃ)