এই পরিদৃশ্যমান বিশ্বে রয়েছে তিনটি স্তর–আধিভৌতিক, আধিদৈবিক ও আধ্যাত্মিক বা কারণ৷ এছাড়া রয়েছে একটা মানসাতীত স্তর৷ আবার মানবীয় অস্তিত্বেও রয়েছে তিনটি স্তর–স্থূল, সূক্ষ্ম ও কারণ৷ এ ছাড়া রয়েছে এক প্রতিফলিত চৈতন্য৷ এই চৈতন্যের স্তরে বিকাশের কোন প্রশ্ণ নেই, কারণ আত্মা হ’ল গুণাতীত অতীন্দ্রিয় সত্তা৷ যেখানে রয়েছে অপূর্ণতা ও নশ্বরতা সেখানেই রয়েছে বিকাশের সুযোগ৷ অপূর্ণতা থেকে পূর্ণতার দিকে গতিই হ’ল প্রগতি৷ মানসাতীত স্তরে কোন প্রগতি নেই, কারণ তা’ পূর্ণ ও শাশ্বত৷ কেবল মানসিক স্তরে এই প্রগতির পূর্ণ সুযোগ রয়েছে৷ স্থূল শরীর যে পাঞ্চভৌতিক উপাদানে তৈরী সেই পাঞ্চভৌতিক উপাদান ভূমধ্যসাগরের স্থূল অভিব্যক্তি ছাড়া কিছুই নয়৷ আর এই পাঞ্চভৌতিক সত্তার সমন্বয়েই সকল সত্তার দেহ–সংরচনা গড়ে ওঠে৷
সকল সত্তার যিনি মূল উৎস–তিনিই হলেন পরমপিতা৷ তিনি সমভাবে সবাইকার৷ এই বিশ্ব সৃষ্টি তাঁরই অভিপ্রকাশ৷ তাই এই বিশ্বকে ভোগ করবার ও নিরাপত্তা লাভের জন্মগত অধিকার প্রতিটি সত্তার আছে৷ অতিরিক্ত সম্পদ কুক্ষিগত করার অধিকার কারও নেই৷
অতিরিক্ত ভৌতিক সম্পদ অধিগত করার বাসনা যা তা’ সঞ্চয় করা সমাজের বিরুদ্ধে কৃত অপরাধ ও ঈশ্বরের বিরুদ্ধাচরণ জনিত পাপ৷ এটা একটা বড় ধরণের অনৈতিক ও সমাজ বিরোধী কাজ৷ এই সব কায়েমী স্বার্থের ও সমাজ বিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া ন্যায় সম্মত ও ধর্ম সঙ্গত৷
এই ভৌত দেহ অপূর্ণ ও নশ্বর, কারণ তা স্থান, কাল, পাত্রের বন্ধনে আবদ্ধ৷ আপেক্ষিকতার বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করার এক অপ্রতিহত ও অদম্য স্পৃহা মানুষের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে৷ এই এষণা যদি মানুষের না থাকত, তাহলে তার কোন বৌদ্ধিক বিকাশই ঘটত না৷ যারা দৈহিক অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে দিন–রাত্রি কঠোর সংগ্রাম করে চলেছে তারা মানসিক উন্নতির জন্যে খুব কমই সময় পায়৷ তাদের খাওয়া–পরার সমস্যাই তাদের মনের বিকাশকে স্তব্ধ করে দিয়েছে৷ মনুষ্যত্বের বিকাশ তথা সার্বিক উন্নতির জন্যে প্রতিটি মানুষের সমান সুযোগ ও নূ্যনতম প্রয়োজনের গ্যারাণ্ঢির ব্যবস্থা করা সর্বাগ্রে প্রয়োজন৷
ভৌতদেহ স্থান–কাল–পাত্রের বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে পারে না৷ ব্যষ্টিতে ব্যষ্টিতে এই বন্ধনের ঘনত্বের তারতম্য থাকে বা থাকবে, কিন্তু এই তারতম্যের হার যাই হোক না কেন, প্রতিটি মানুষকে তার বৌদ্ধিক প্রগতির জন্যে সীমাহীন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে৷ এ ছাড়া স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ ঘটা সম্ভব নয়৷ সংগ্রাম জীবনের মূলমন্ত্র আর সংগ্রাম–হীনতাই মৃত্যু৷ সংগ্রাম এড়িয়ে যাওয়া কপটতার নামান্তর মাত্র৷
যারা হীনমনা ও কায়েমী স্বার্থবাদী, যারা মানবতার মুক্তি ও সমাজের প্রগতি চায় না, তারাই নানান্ ধরনের ‘ইজমে’র উদ্ভাবন ও প্রচার করে৷ উদ্দেশ্য হ’ল, এইসব ডগ্মা বা ভাবজড়তার আড়ালে থেকে সমাজের অজ্ঞ জনসাধারণকে শোষণ করা৷ ‘ইজমে’র নামে এরা বিভিন্ন মতপার্থক্য ও বিচ্ছিন্নতাবাদের বীজ বপন করে তাদের শোষণযন্ত্রকে সুরক্ষিত করে৷ মানব–সমাজ এক ও অবিভাজ্য৷ মানুষে মানুষে কোন মূলগত পার্থক্য নেই৷ সকল মানুষই তার প্রাণরস ও জীবনীশক্তি পেয়ে চলেছে সেই এক অদ্বিতীয় উৎস থেকে৷ তাই বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব ও বৈষম্যের কথা মানবতা বিরোধী৷
ভূমার ক্ষেত্রে যেমন স্থূল জগতের ঊর্ধ্বে রয়েছে সূক্ষ্ম জগৎ অণুচৈতন্যের ক্ষেত্রেও তেমনি রয়েছে৷ মানুষকে তার বৌদ্ধিক প্রগতির জন্যে অনলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে৷ অন্যথায় মানুষের মন স্থূল জাগতিক বস্তুর দিকে ছুটবে৷ আর অনবরত স্থূল চিন্তা–স্থূল তরঙ্গের অধ্যারোপণের ফলে মন শেষ পর্যন্ত জড়ে রূপান্তরিত হবে৷ কিন্তু মন তো জড়ত্বের মধ্যে চিরকাল বাঁধা থাকতে পারে না৷ তাই প্রত্যেকেরই উচ্চ ও সূক্ষ্ম বিষয়ের চিন্তা করা বা ভূমাচৈতন্যের ভাবনা নেওয়া উচিত৷
স্থূল শরীর ও সূক্ষ্ম মানসিক দেহ পরমাত্মার মানসদেহেরই অংশবিশেষ৷ সুতরাং আমরা কাউকেই অবজ্ঞা করতে পারি না৷ প্রত্যেকের তার দৈহিক অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে ভৌতিক সম্পদের যথাযোগ্য ব্যবহার করার যেমন অধিকার রয়েছে তেমনি মানসিক প্রগতির জন্যেও প্রত্যেককে সমান সুযোগ দিতে হবে৷
হীনম্মন্যতা একটি মানসিক রোগবিশেষ৷ এমন বহু মানুষ রয়েছে যারা দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব ও সামাজিক অবিচার হেতু নিজেদের নিকৃষ্ট ও অকর্মণ্য ভাবে৷ এই রোগগ্রস্ত মানুষদের তথা নিপীড়িত মানবতার রোগ মুক্তির ব্যবস্থা করা সমস্ত ধর্মপ্রাণ ও শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষেরই কর্তব্য৷ কিন্তু দুঃখের কথা এই যে সমস্ত তথাকথিত উপধর্মীয় (রেলিজিয়াস) নেতারা আবহমানকাল থেকেই মানুষের এই সব মানসিক কমপ্লেক্সগুলোকে জীইয়ে রেখে নানান্ ধরণের ইজমের প্রচার করে চলেছে৷ ভৌতিক ক্ষেত্রে এই সব বিচ্ছিন্নতাবাদী নীতির সমর্থকদের যদি শয়তান আখ্যা দেওয়া যায় বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে এই সব মারাত্মক নীতির প্রবক্তাদের বলতে হবে ‘মার্জিত শয়তান’৷ ভৌতিক বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার অবিরাম প্রয়াস ছাড়া যেমন মানসিক বিকাশ সম্ভব নয়, তেমনি মানসিক ক্ষেত্রে মুক্তির জন্যে বিরামহীন প্রচেষ্টা যদি না থাকে তাহলে আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রেও কোন প্রকার প্রগতি সম্ভব নয়৷ তাই বৌদ্ধিক চর্চা জিনিসটা মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতির স্বার্থেই একান্ত প্রয়োজন যদিও এই বৌদ্ধিক চর্চা যে মুক্তি এনে দেয় তা অস্থায়ী৷
ভৌতিক ও মানসিক উভয় ক্ষেত্রে প্রতিটি গতিই সঙ্কোচ–বিকাশাত্মক৷ সাধারণ ভৌতিক ক্ষেত্রে এটা দৃশ্যমান নয়৷ সঙ্কোচ–বিকাশাত্মক গতি প্রকৃতপক্ষে গতি ও বিরতির সমন্বয়৷ এই বিরতির অবস্থাটা অনুভূত হয় বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে৷ বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে এই বিরতিকে আমরা বলি বৌদ্ধিক মুক্তি৷ যে অবস্থায় মন কিছুক্ষণের জন্যে সকল সন্দেহ ও সমস্যা থেকে মুক্ত হয়, সেটাই বিরতির অবস্থা বা বৌদ্ধিক মুক্তির অবস্থা৷ বৌদ্ধিক স্তরে সংঘর্ষের ফলে যে মানসিক শক্তি তৈরী হয় তা কারণ–মনের ওপর আঘাত হেনে একে চূর্ণ–বিচূর্ণ করে৷ এর ফলে অবশেষে কারণ–মন অণুচৈতন্যে রূপান্তরিত হয়৷ বৌদ্ধিক স্তরে সংঘর্ষের ফলে যে বোধিজ্ঞানের উন্মেষ ঘটে তাই মনকে চৈতন্যে রূপান্তরিত করে দেয়৷ কিন্তু বৌদ্ধিক চর্চা কখনও জড়াভিমুখী হওয়া উচিত নয়৷ মানস–তটিনী স্থূল সূক্ষ্ম উভয় দিকেই প্রবাহিত হতে পারে৷ যদি মনের স্রোতধারা সূক্ষ্মের দিকে প্রবাহিত হয় তা আনে ‘মুক্তি’৷ আর তা যদি স্থূলের দিকে প্রধাবিত হয়, তাতে বন্ধনের গ্রন্থিগুলি আরও দৃৃতর হয়৷ তাই যাঁরা জ্ঞানী, শিক্ষিত, বুদ্ধিমান তাঁরা সত্য ও অমরত্বের পথ বেছে নেবেন, আর লেখাপড়া–শেখা নির্বোধেরা স্থূল ও অন্ধকারের পথ ধরে চলবে৷ রেণেসাঁ আন্দোলনের লক্ষ্য হ’ল মানুষের সূক্ষ্মতর, উচ্চতর চিন্তার রাজ্যকে আলোকিত ও পুনরুজ্জীবিত করা৷
আমি চাই, প্রতিটি মানুষ জীবনের নূ্যনতম ভৌতিক প্রয়োজন–পূর্ত্তির গ্যারাণ্ঢি পাক৷ প্রতিটি মানুষ তার মানসিক ক্ষেত্রের সমস্ত সম্ভাবনার পূর্ণ সুযোগ পাক, প্রতিটি মানুষ শাশ্বত সত্য উপলব্ধির সমান সুযোগ পাক ও বিশ্বের সকল উৎকর্ষ ও গৌরবের অধিকারী হোক৷ প্রতিটি মানুষ সেই শাশ্বত অনন্ত সত্তার দিকে এগিয়ে চলুক৷ এই আন্দোলনের মাধ্যমে মানুষ জীবনের অর্থ ও লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠুক৷ (মূল ইংরেজী থেকে অনুদিত)