গীতায় বলা হয়েছে–
‘‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত৷
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্৷৷
পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্৷
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে৷৷’’
গীতা কী? ‘যা ভগবতা সা গীতা’–যা ভগবান দ্বারা গীত হয়েছে তাই গীতা৷ ভগবান গেয়েছেন৷ ভগবান কী? ভগবানকে আমরা ভগবান কেন বলি? যাঁর ‘ভগ’ আছে তিনিই ভগবান৷ সংসৃক্তে ‘ভগ’ শব্দের অর্থ কী? একটি অর্থ ‘মূল কারণ’ আর অন্যটির শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা হচ্ছে–ভগ ছ’টি বস্তু বা গুণের সমষ্টি বা সমাহার৷ প্রথমটি ‘ঐশ্বর্যঞ্চ সমগ্রঞ্চ’৷ যত ঐশ্বর্য আছে–অণিমা, লঘিমা, মহিমা, ঈশিত্ব, বশিত্ব, প্রাপ্তি, প্রকাম্য, অন্তর্যামিত্ব–এ সবগুলিকে ঐশ্বর্য বলে৷ ঐশ্বর্যকে ইংরেজীতে অলৌকিক শক্তি (occult power) বলা হয়৷ যে শক্তি মানুষ কষ্টকর প্রয়াসের মাধ্যমে অর্জন করে ইংরেজীতে তাকে (occult power) বলে৷
সাধনায় অগ্রগতি হলে কিছু শক্তি এসে যায়৷ সাধককে ওই শক্তির ব্যাপারে কখনও গুরুত্ব দেওয়া উচিত নয়৷ শক্তি এলে বা না এলেও কোন ক্ষতি নেই৷ বরং শক্তি এসে গেলে অসুবিধায় পড়তে হয়৷ মনের মধ্যে ইচ্ছা জাগবে যে সেই শক্তির প্রদর্শন করি৷ আর এতে সাধকের হবে অধোগতি৷ নাম যশের পেছনে দৌড়িয়ে মানুষ শেষ পর্যন্ত কাঙ্গাল হয়ে যায়৷ যাই হোক, এই যে অণিমা, লঘিমা এগুলিই অষ্টৈশ্বর্য৷ অণিমা অর্থাৎ খুব ছোট হয়ে যাওয়া অর্থাৎ একেবারে ছোট্ট শিশুর মত সহজ, সরল হয়ে যাওয়া৷ লঘিমা একেবারে হালকা হয়ে যাওয়া৷ মহিমার অর্থ খুব ক্ষৃহৎ বা বিরাট হয়ে যাওয়া, সবার আদর্শস্বরূপ হয়ে ওঠা৷ ঠিক সেইরকমই অন্তর্যামিত্ব যার অর্থ সবার মনের ভেতরে প্রবেশ করতে পারা৷ কে কী করছে জেনে যাওয়া৷ শুধু তাই নয়, কে কী চিন্তা করছে সেটা পর্যন্ত দেখে নেওয়া৷ যাঁর মধ্যে এই আটটি ঐশ্বর্য আছে তিনিই ভগবান৷
দ্বিতীয় হ’ল প্রভাব বা প্রতাপ–যাঁর মানুষের ওপর পুরো শাসন আছে৷ তৃতীয় হচ্ছে–যশ যার ইংরেজী Reputation, যার দ্বারা বা যার কারণে বিশ্বে মেরুকরণ হয়ে যায়৷ সেটা কী? ভগবান সম্বন্ধে বিশ্বে কোন মধ্যবর্তী সিদ্ধান্ত নেই৷ দু’নৌকোয় পা রেখে কেউ থাকতে পারে না৷ কেউ হয় ভগবানের পরম ভক্ত আর কেউ হয়ে যায় ঘোর বিরোধী৷ কেউ হয় সুদামা, কেউ হয় কংস৷ মাঝখানে কেউ থাকে না৷ অর্থাৎ একটা স্পষ্ট মেরুকরণ হয়ে যায়৷ একজন উত্তর মেরু তো অন্যজন দক্ষিণ মেরু৷ ভগবান শিব প্রায় সাড়ে সাত হাজার বছর আগে পৃথিবীতে এসেছিলেন৷ তখন শিবের অনেক ভক্ত ছিল আবার অনেক বিরোধীও ছিল৷ ভক্তও নয়–আবার বিরোধীও নয় এমনটি হয় না৷ দুই এর মধ্যে একটা, খুব যশ, না হলে খুব অপযশ৷ এর একটাই হবে৷ কৃষ্ণ এসেছিলেন সাড়ে তিন হাজার বছর হয়ে গেল৷ এখনও কেউ কৃৃষ্ণের ভক্ত আর কেউ কট্টর বিরোধী৷ এই হ’ল যশ৷
চতুর্থ ‘শ্রী’৷ ইংরেজীতে Charm আকর্ষণ (attraction)৷ যে পরমপুরুষের কাছে এসে যায় সেই তাঁর প্রেমে বাঁধা পড়ে যায়, তাঁকে ছাড়তে পারে না৷ একে বলে ‘শ্রী’৷ তালব্য ‘শ’, ‘র’ আর ‘ঈ’ মিলে তৈরী হয় ‘শ্রী’ শব্দ৷ ‘শ’ রজো গুণের ৰীজমন্ত্র, ‘র’ শক্তি তথা Energy–র ৰীজমন্ত্র, আর ‘ঈ’ যোগ করে স্ত্রীলিঙ্গ হয়৷ তো যার মধ্যে রজোগুণী কর্মতৎপরতা আছে, আর ‘র’ অর্থাৎ Energy আছে, কাজ করার সামর্থ্য আছে সে হ’ল ‘শ্রী’৷ সবাই ‘শ্রী’ চায়৷ এজন্যে প্রাচীন ভারতে প্রত্যেক নামের আগে ‘শ্রী’ লেখার প্রথা ছিল৷ অর্থাৎ আমি ‘শ্রী’ চাই৷ ‘শ্রী’ শব্দের আর এক অর্থ পরমাপ্রকৃতি৷ এজন্যে পরমপুরষের এক নাম ‘শ্রীনাথ’, ‘শ্রীপতি’৷ তাই পরমপুরুষের শ্রী–ও থাকতে হবে৷
এবার জ্ঞান ও বৈরাগ্য–এই নিয়ে হ’ল ছয়৷ জ্ঞান মানে ‘আত্মজ্ঞান’–পুস্তকের জ্ঞান নয়৷ পুস্তকীয় জ্ঞান আজ পড়লে কাল ভুলে গেলে৷ এ জ্ঞান জ্ঞান নয়৷ এছাড়া আর একটা কথা হচ্ছে বইতে যা লেখা আছে তা সত্য হতে পারে আবার মিথ্যাও হতে পারে৷
মনে কর আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে যে বই লেখা হয়েছিল তাতে ছিল উত্তরপ্রদেশের রাজধানী এলাহাবাদ৷ কিন্তু এখনকার বইয়ে আছে রাজধানী লখনউ৷ পঁয়ত্রিশ বছর আগে যে ইউ, পি–র রাজধানী এলাহাবাদ ছিল এটা তখন সত্য ছিল, কিন্তু এখন রাজধানী লখনউ৷ তাই ওই বই আজকের দিনে মিথ্যা৷ ঠিক তেমনি এখনকার বইয়ে যে লখনউ লেখা আছে এমনও তো হতে পারে আবার রাজধানী অন্য কোথাও পরিবর্তিত হয়ে গেল৷ তাই বই–এর জ্ঞান চরম তথা পরম নয়৷ আর একটা কথা হচ্ছে ছাপার ভুলও হয়৷ তুমি বলবে, ‘আমি নিজের চোখে দেখেছি তিব্বতের রাজধানীর নাম ‘খাসা’ (ছাপার ভুলের জন্যে ‘লাসা’ হয়ে গেছে ‘খাসা’)৷ জ্ঞান হচ্ছে তাই পুস্তকীয় জ্ঞান, বাহ্যিক জ্ঞান৷ তাছাড়া তোমার চোখের ত্রুটি তো হতে পারে৷ তাহলে জ্ঞান কী? আত্মজ্ঞানই জ্ঞান আর অন্য জ্ঞান জ্ঞান নয়৷ কারণ যেখানে জ্ঞানক্রিয়া আছে সেখানে থাকে তিনটি সত্তা৷ জ্ঞেয় অর্থাৎ যাকে তুমি জানছো, দুই জ্ঞাতা আর তৃতীয় জানারূপ ক্রিয়া৷ এই তিন নিয়ে জ্ঞানক্রিয়া নিষ্পন্ন হয়৷ এতে ত্রুটি থাকতে পারে জ্ঞেয়–তে৷ জ্ঞানক্রিয়াতেও ত্রুটি হতে পারে আবার জ্ঞাতাতেও তা হতে পারে৷ কিন্তু আত্মজ্ঞান কী? নিজেকে জানা অর্থাৎ এই ক্ষেত্রে জ্ঞেয় আর জ্ঞাতা দুই–ই এক হয়ে গেছে৷ তাই কোন পার্থক্য নেই৷ জ্ঞেয় আর জ্ঞাতা যখন এক হয়ে যায় তখন সম্বন্ধ–নির্ধারক যে সত্তা তাও থাকে না৷ যদি দু’টি সত্তা থাকে তবে না তাদের মধ্যে সম্পর্ক–নির্ধারক জ্ঞানক্রিয়াও থাকবে৷ দু’টো এক হয়ে গেলে জ্ঞানক্রিয়া বলে কিছু থাকবে কি? আত্মজ্ঞানের ক্ষেত্রে জ্ঞান, জ্ঞেয় ও জ্ঞানক্রিয়া তিনই এক হয়ে যায়৷ তাই এখানে ত্রুটি থাকার কোন উপায়ই নেই৷ যাঁর মধ্যে ঐশ্বর্য, বীর্য, যশ, শ্রী, আত্মজ্ঞান সবই আছে তিনি ‘ভগবান’৷
(ক্রমশঃ)