‘‘মন এব মনুষ্যানাং কারণং বন্ধমোক্ষয়োঃ৷
বন্ধস্য বিষয়াসঙ্গী মুক্তো নির্বিষয়ং তথা৷৷’’
মনই মানুষের মুক্তি ও বন্ধনের কারণ হয়৷ কোন কাজ করার আগে মানুষ ভেবে নেয় যে সে মনপ্রধান জীব৷ বলা হয়েছে ‘‘মনঃ করোতি কর্মাণি৷’’
যে কাজ মনের সাহায্য ছাড়াই সম্পন্ন হয় তাকে বলে ‘ক্রিয়া’ ও যাতে মনের সাহায্য নিতে হয় তাকে বলে ‘কর্ম’৷
পাতক দু’প্রকারের৷ পাপ ও প্রত্যবায়৷ পাপও তিনপ্রকার হয়– ‘পাতক’, ‘অতিপাতক’ ও ‘মহাপাতক’৷ যা করা উচিত নয় কিন্তু করা হয়েছে তাকে বলে পাপ৷ যা করা উচিত কিন্তু করা হয়নি তাকে বলে প্রত্যবায়৷
পাপ ও প্রত্যবায় দুইই অনুষ্ঠিত হয় মনের দ্বারা৷ মনে মনে পাপচিন্তা করা হ’ল কিন্তু হাত–পা–র মাধ্যমে সেটা বাস্তবরূপ পেল না৷ সেক্ষেত্রে শাস্তিভোগ করতে হয় না৷ কিন্তু যখন মনের এই ভাবনা বাস্তব জগতে রূপ নিয়ে নিল তখন তা হয়ে গেল দণ্ডনীয় অপরাধ৷ কোন সৎচিন্তা যখন বাস্তব জগতে কার্যরূপ পরিগ্রহ করে তখন আধ্যাত্মিক জগতে উন্নতি হয়৷ মনে যখন অসৎ চিন্তা আসে, তখন সৎ চিন্তার দ্বারা তার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া উচিত৷
মনের চিন্তা যখন খণ্ডবস্তুতে লিপ্ত হয় তখন মানুষটি মনের সেই বিষয় অর্থাৎ জড়বস্তুর দাস হয়ে পড়ে৷ এখানেই মন বন্ধনের কারণ হয়৷ আবার মনের ভাবনা যখন পরমপুরুষের দিকে যায় তখন সেই মন মুক্তি ও মোক্ষের কারণ হয়৷
আগেই বলা হয়েছে, যে জীবনে প্রতিটি কাজ মন অর্থাৎ চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হয় সেই জীবনকেই মানবজীবন বলা হয়৷
পাপ অথবা প্রত্যবায় সামাজিক দৃষ্টি থেকে দণ্ডনীয়৷ কিন্তু পরমপুরুষের কাছে সব মানুষই সমান৷
একটি ভজনে বলা হয়েছে যে আমি কী করে নিজের পাপের বোঝা পরমপুরুষকে অর্পণ করব
মানুষ নিজের পাপ ঈশ্বরকে দিতে চায় না৷ কিন্তু কোন সত্তাই তো ঈশ্বরের বাইরে নয়৷ পাপের অস্তিত্বও তাঁর বাইরে থাকতে পারে না৷ এজন্যে তিনি পাপও গ্রহণ করে নেন৷
পাপ অন্যের ক্ষতির কারণ হয়৷ তাই পাপ থেকে বিরত থাকা উচিত৷ অর্থাৎ পাপ সামাজিকভাবে ক্ষতি করে৷ জগতের দৃষ্টিতে ওই মানুষটি অপরাধী হতে পারে কিন্তু ঈশ্বরের কাছে সে ঘৃণ্য নয়৷ সে সমাজের কাছে অপরাধী বলে গণ্য হয়৷ কিন্তু পরমপুরষের কাছে সেও আদরের সন্তান৷
পাপ ও প্রত্যবায় দুইই অনুষ্ঠিত হয় মনের দ্বারাঙ্গ মনে মনে পাপচিন্তা করা হ’ল কিন্তু হাত–পা–র মাধ্যমে সেটা বাস্তবরূপ পেল নাঙ্গ সেক্ষেত্রে শাস্তিভোগ করতে হয় নাঙ্গ কিন্তু যখন মনের এই ভাবনা বাস্তব জগতে রূপ নিয়ে নিল তখন তা হয়ে গেল দণ্ডনীয় অপরাধঙ্গ কোন সৎচিন্তা যখন বাস্তব জগতে কার্যরূপ পরিগ্রহ করে তখন আধ্যাত্মিক জগতে উন্নতি হয়ঙ্গ মনে যখন অসৎ চিন্তা আসে, তখন সৎ চিন্তার দ্বারা তার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া উচিতঙ্গ
এই মনকে যদি ঈশ্বরে সমর্পণ করা যায় তাহলে পাপ ও পুণ্য বলে কিছু থাকে না৷ ভক্তির স্রোতে সব পাপ ধুয়ে সাফ হয়ে যায়৷ পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়ে যায়৷ ঈশ্বরের এক নাম ‘হরি’ কারণ তিনি পাপ হরণ করে নেন৷ কেউই স্বেচ্ছায় পরমপুরুষকে নিজের পাপ দিতে চায় না৷ এই জন্যে পরমপুরুষ পাপ চুরি করে নেন৷
সেবা এই কারণেই করতে হয় কারণ এতে পরমপুরুষের আনন্দ হয়৷ একবার শ্রীকৃষ্ণ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন৷ চিকিৎসকেরা এল, চিকিৎসা করল কিন্তু রোগ সারল না৷ শেষে তিনি বললেন যে, ভক্তের পায়ের ধুলো তার মাথায় দিলে রোগ সেরে যাবে৷ কেউ তা দিতে রাজি হ’ল না, কিন্তু বৃন্দাবনের ভক্তরা তাদের পায়ের ধুলো শ্রীকৃষ্ণের মাথায় নির্দ্বিধায় দিয়ে দিল৷ এতে যে তাদের নরকে যেতে হবে তার পরোয়াও তারা করেনি৷ কারণ ঈশ্বর এর ফলে সুস্থ হয়ে উঠবেন৷
তোমরাও সব কাজ আদর্শ অনুসারেই করে চল এই ভেবে যে এতে পরমপুরুষ আনন্দিত হবেন৷
সন্ধ্যাকালীন দর্শন, ২১ সেপ্ঢেম্বর, ১৯৭১, কলিকাতা