গতকাল রাতে বলেছিলাম–মন যাঁর ভাবনা নিতে পারে না ও মনের ভাববার যে শক্তি আছে, সেই শক্তি যাঁর থেকে আসে, তিনিই হচ্ছেন পরমপুরুষ৷ এইজন্যে পরমপুরুষের কাছে লুকোনো কিছু নেই৷ এই যে মন, তা আসলে কী জিনিস? পরমপুরুষের মৌলিক সত্তা যখন ঘনীভূত হয়ে যায়, তাতে জড়জগৎ–প্রপঞ্চের্ উৎপত্তি হয়ে থাকে৷ আর সেই প্রপঞ্চ যখন পরমপুরুষের আকর্ষণে তাঁর দিকে চলা শুরু করে দেয়, তখন অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের কারণে জড়সত্তা চূর্ণীভূত হয়ে মনে রূপান্তরিত হয়ে থাকে৷ যেখানে মনের বিকাশ নেই সেখানে আমরা পাই গাছপালা, জীবজন্তু৷ আর যেখানে মনের অধিক বিকাশ হয়েছে, সেখানে আমরা পাই মানুষকে৷
জীবাত্মা সকলের মধ্যেই রয়েছে৷ জীবাত্মা কী? পরমপুরুষ জীবমনে প্রতিফলিত হন, ঠিক যেমন একটি ফুল একগুচ্ছ দর্পনের মধ্যে একাধিক ফুল হিসেবে প্রতিফলিত হয়৷ সেক্ষেত্রে পারমার্থিক দৃষ্টিতে দর্পণের ফুল আসলে নেই, কিন্তু জাগতিক দৃষ্টিতে দেখতে গেলে আছে৷ এইজন্যেই আমি বলি–এই যে জগৎ তাকে মিথ্যাও বলা যায় না, আবার চরম সত্যও বলা যায় না৷
একে যখন দেখি, আস্বাদ নিই, এর সংস্পর্শে আসি–তখন একে কি করে মিথ্যা বলি? কিন্তু আবার এটা তো মনের ওপর পরমপুরুষের প্রতিফলন৷ এই যে প্রতিফলন, একে সত্যই বা বলি কী করে? অতএব প্রপঞ্চ সম্বন্ধে মানুষের উচিত ভাবনা কী হবে? যখন তুমি জাগতিক বস্তুর সংস্পর্শে আসবে কিংবা মৌলিক সমস্যার সংস্পর্শে আসবে, অন্ন–বস্ত্র–শিক্ষা–বা ইত্যাদির কথা যেখানে আছে–সেখানে নিজ নিজ কর্তব্য যথাবিধি পালন করে যাবে৷ ৰুঝে নিতে হবে এগুলি চরম সত্য নয়৷ কিন্তু মানুষ যতক্ষণ স্থূল আধারে বা স্থূল শরীরে আছে, ততক্ষণ জাগতিক এই সব কিছুর তাৎকালিক প্রয়োজনীয়তা আছে৷ এই জন্যে এদের অবহেলা কিংবা উপেক্ষা করা উচিত নয়৷ বরং জাগতিক সমস্যাবলীর সমাধানের ব্যাপারে তৎপর হওয়া উচিত৷ কেননা মানুষ যতক্ষণ সমস্যার কারণে নাকাল হতে থাকবে ততক্ষন স্থিরচিত্তে সাধন–ভজন–কীর্ত্ত করতে পারবে না৷ যাতে সব মানুষের সাধনা করার সম্পূর্ণ সুযোগ মেলে সেজন্যে সমষ্টিগত স্তরে মানবিক সমস্যার সমাধানে ৰুদ্ধিমান মানুষের সচেষ্ট হওয়া উচিত৷
যে মানুষ অনাহারে আছে তাকে প্রথমে অন্ন দেবো৷ ওই সময়ে সেই ক্ষুধার্ত মানুষটিকে আমি কখনোই বলব না যে সাধনায় বসে যাও৷ আগে তাকে আহার দেবো, তারপর বলব যে, যাও, সাধনায় বস৷ অতএব জাগতিক সমস্যাবলীর সমাধান করা চাই, দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে করা চাই৷ অবহেলা করলে কী হবে? পরে এই সমস্যা দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে তোমাকেই আক্রমণ করবে৷ এই জন্যেই ‘বর্তমানেষু বর্ত্তেত’–এই শিবোক্তিতে বলা হয়েছে–বর্তমান সময়ে পৃথিবীতে তোমার সম্মুখে যে সমস্ত সমস্যা রয়েছে তাদের সমাধানের জন্যে তুমি তৎপর হয়ে যাও৷ সবাই মিলে প্রয়াস চালাও৷ মিলিত চেষ্টায় কোন বড় কাজ বড় থাকে না, ছোটই হয়ে যায়৷
জীবমনের ওপর পরমপুরুষের যে প্রতিফলন, তাই জীবাত্মা৷ মানুষের মন বিকশিত মন, মানুষের মন খুবই সুন্দর৷ এই জন্যে পরমপুরুষের প্রতিফলন মানব মনের উপর খুবই সুন্দর ভাবে হয়ে থাকে৷ এই জন্যে যত জীবাত্মা আছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর মানবাত্মা৷ এই যে মানবাত্মা, তার দ্বারা অনেক বড় কাজ হতে পারে৷ কিন্তু মানুষ ভুলে যায় যে–সে মানুষ, সে মানবাত্মা৷ সে পশুর মত জীবনযাপন করে৷ আহার–তৃষ্ণানিবারণ––এগুলিই মানবজীবনের ব্রত হয়ে দাঁড়ায়৷ মানুষের শরীর পেয়েও তাকে অবহেলা করা হতে থাকে, পশুর মতই থেকে যায়৷ আর এর ফল এই হয়ে দাঁড়ায় যে, পাশবিক ভাবনাকে প্রশ্রয় দেবার কারণে সে আবার পশু হয়েই জন্মায়৷ মানুষ যদি সেটা না করে, উন্নত মন ও উন্নত আত্মার মানুষ অল্প একটু চেষ্টা করে, তাহলেই পরমাত্মার কাছে সে পৌঁছোতে পারে৷ কিন্তু মানুষ সেরকম করে না কেন?
বলা হয়ে থাকে–তুমি মানুষের শরীর পেয়েছ৷ তুমি ভাগ্যবান যে তুমি জান যে তুমি মানুষ৷ টাকা–পয়সা জানে না যে সে টাকা–পয়সা৷ উদ্ভিদ জানে না যে সে উদ্ভিদ৷ তারা সহজাত সংস্কার অনুসারে কাজ চালিয়ে যায়, কিন্তু তাদের জ্ঞান নেই, সঠিক ৰোধশক্তি নেই৷ জন্তু–জানোয়ারের মধ্যেও ৰোধশক্তি অনেক কম থাকে৷ এই যে অতুলনীয় মানুষের শরীর পাওয়া গেছে, এর সম্পূর্ণ উপযোগ হওয়া চাই৷ ধর, তোমার কাছে একটি দামী যন্ত্র আছে৷ এই যন্ত্র দিয়ে তুমি অনেক কিছু তৈরী করতে পার, কিন্তু তুমি তা করলে না৷ সেক্ষেত্রে যন্ত্রটির অবস্থা কী হবে? –না, যন্ত্রে মরচে পড়ে যাবে৷ এই অবস্থায় যন্ত্রটির উপযুক্ত মূল্য তো তুমি পাবে না, কেননা তুমি তার সদুপযোগ কর নি৷ মানবদেহ তথা মানুষের এই যে শরীর তা অত্যন্ত মূল্যবান একটি যন্ত্র৷ তাই এই দেহ–যন্ত্রটির যথার্থ উপযোগ করো৷ এই দেহযন্ত্রের সাহায্যে তুমি পরমপুরুষের নিকট থেকে আরও নিকটে পৌঁছে যাও৷
তুমি ভাগ্যবান যে তুমি মানবদেহ পেয়েছে–‘‘সুকৃতৈর্মানবো ভূত্বা জ্ঞানীচেন্মোক্ষমাপ্ণুয়া৷’’ জন্ম–জন্মান্তরের সুকৃতির কারণে মানবদেহ পাওয়া যায়৷ আর এই শরীর নিয়ে একটু সাধনা করে মানুষ ৰুঝে নেয় যে–সে পরমপুরুষের ও পরমপুরুষ তার৷ মানুষ এইভাবে ক্রমশঃ পরমপুরুষের অধিক নিকটে পৌঁছে যাবে৷ আর তার মধ্যে যদি পাপও থাকে, তার মধ্যে যদি কোন দোষও থাকে–পরমপুরুষের কাছে পৌঁছে যাবার সঙ্গে সঙ্গে পরমপুরুষ কী করবেন? –না, তার কাপড়–চোপড় পরিষ্কার করে নিয়ে তাকে কোলে বসিয়ে নেবেন৷ জীব পরমপুরুষের সৃষ্টি, তাঁর কাছে কেউ পৌঁছে গেলে তিনি তাকে ভালবাসা না দিয়ে থাকতে পারেন কি? – না–ভালবেসে তিনি থাকতে পারেন না৷ মানুষের উচিত অতীতের কথা ভুলে যাওয়া৷ আজ থেকে এই মুহূর্তে থেকে সাধনা করে যাও, তোমার যিনি ইষ্ট তথা অভীষ্ট অর্থাৎ পরমপুরুষের নিকটে দ্রুত পৌঁছে যাও৷ আর শান্তি তথা পরমাশান্তি লাভ কর, যা মানবজীবনের চরম ও পরম ধ্যেয়৷ (২৯ জুন ১৯৮০, বেতিয়া)