মিষ্টিসিজম্ ও যোগ

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

সূক্ষ্ম নন্দনতত্ত্বের ওপর আধারিত নান্দনিক অভীপ্সা যখন একটা নির্দিষ্ট উচ্চ মানে পৌঁছে যায় তাকে বলে মিষ্টিসিজম্৷ আর এই মিষ্টিসিজম্ যখন মানবীয় গরিমা মহিমার শীর্ষে বা শ্রেষ্ঠত্বের পর্যায়ে চলে আসে তাকে বলে আধ্যাত্মিকতা (spirituality) এখন মিষ্টিসিজম্ কী মিষ্টিসিজম্ হ’ল সীমার সঙ্গে অসীমের, ক্ষুদ্র ‘আমি’র সঙ্গে ৰৃহৎ ‘আমি’র বা আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার সম্পর্ক নির্ণয়ের এক নিরন্তর প্রয়াস৷

মানুষের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে সীমিত কোন কিছুতে সে সন্তুষ্ট হয় না৷ সংস্কৃতে একে বলা হয়–‘‘নাল্পে সুখমস্তি ভূমৈব সুখম্’’–অর্থাৎ খণ্ডবস্তু বা সীমায়িত কোন অস্তিত্ব মানুষের আশা–আকাঙক্ষা, তার ‘ক্ষুধা’র সত্যিকারের নিবৃত্তি ঘটাতে পারে না৷ অসীমকে তথা অনন্তকে খুঁজে পাবার এই যে প্রয়াস তারই ফলস্বরূপ মানুষ একদিন নন্দনবিজ্ঞানের সংস্পর্শে এসেছিল৷ মনে রাখতে হবে নন্দনবিজ্ঞান মানে এই নয় যে তা থেকে সব সময় সুখই পাওয়া যাবে৷ কখনো কখনো তা কষ্টদায়ক হতে পারে, অস্বস্তিকরও হতে পারে৷ কিন্তু এটা নিশ্চিত যে নন্দনবিজ্ঞানের পথে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর অভিব্যক্তির চর্চা করতে করতে মানুষ একদিন ‘সূক্ষ্মতম’–কে পেয়ে যাবে৷ আর সেটাই হচ্ছে মানবীয় অস্তিত্বের পরম চরিতার্থতা৷ তাহলে শিল্পীর (artists) কর্তব্য হচ্ছে, এই যে ভাবধারা এটাকেই সুন্দর করে, স্বচ্ছভাবে ফুটিয়ে তোলা ও বিশ্বের তাবৎ মানুষের সামনে তা উপস্থাপিত করা৷ এটা সকলে করতে পারে না ঠিকই কিন্তু নান্দনিক সৌন্দর্যকে বা অভিপ্রকাশকে প্রাণভরে উপভোগ করবার বা তার আস্বাদ নেবার সামর্থ্য সব মানুষের মধ্যেই আছে৷

এখন পরম আনন্দস্বরূপকে পাবার জন্যে এই যে যাত্রা তারই এক স্তরে মানুষ আধ্যাত্মিকতার সন্ধান পেয়েছিল৷ আর আধ্যাত্মিক অনুশীলন করতে করতে, মিষ্টিক রীতিতে খণ্ডের মাঝে অখণ্ডের সাধনা করতে করতে সে যখন সেই অসীম আনন্দঘন সত্তার সংস্পর্শে চলে এল ও তাঁকে পেয়ে গেল, সেটাকেই বলব ‘যোগ’৷ সাধারণভাবে ‘যোগ’ কথাটার অর্থ হ’ল addition অর্থাৎ (কিছু বস্তু আছে তার সঙ্গে অন্য বস্তু) যোগ করা হ’ল৷ যেমন, দুই–এর সঙ্গে দুই মিলিয়ে চার সংখ্যাটি পাচ্ছি৷ কিন্তু যে মিষ্টিসিজমের পথানুসারী, যে অনন্তের পিয়াসী তার কাছে ‘যোগ’ মানে addition নয়৷ যোগ হ’ল unification অর্থাৎ সংযুক্তি বা একাত্মকরণ৷ কী রকমের সংযুক্তি যেমন চীনী আর জলে মিলে যা হয়৷ addition–এর্ ক্ষেত্রে, একটি–দু’টি–তিনটি–চারটি আপেল মিলিয়ে দিলে তাদের প্রত্যেকের পৃথক অস্তিত্ব সব সময় থেকে যাচ্ছে৷ মেলাবার addition আগে প্রতিটি আপেলের যে স্বতন্ত্রতা, পরেও সেই স্বতন্ত্রতা বজায় থাকছে৷ কিন্তু চীনী জল যখন মিলে এক হয়ে যাচ্ছে তার মধ্যে চীনীর আর পৃথক অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷ এই হ’ল যোগ–সংযুক্তিকরণ৷ মিষ্টিসিজমের অধিক্ষেত্রে যোগ হ’ল এই রকমের addition, দু’য়ে দু’য়ে মিলে চার নয়৷ তাহলে সূত্রপাত বিন্দুটি হচ্ছে নন্দনবিজ্ঞান৷ আর নন্দনবিজ্ঞানের যে অন্ত্যবিন্দু তার থেকে শুরু হচ্ছে অসীম লক্ষ্যের পানে মহান যাত্রা৷ তারই সর্বশেষ পরিণতিতে মানুষ পরমসত্তার সঙ্গে মিলেমিশে একাত্ম হয়ে যায়৷ কেননা তাঁর অধিষ্ঠান হচ্ছে মানবীয় অস্তিত্বের সর্বোচ্চ স্তরে৷

এখন ভূমা–লক্ষ্যের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার জন্যে অণুমনের এই যে গতিধারা, ৰৃহতের সঙ্গে ক্ষুদ্রের এই যে মিলন–প্রয়াস, এইটাই হচ্ছে যোগের পথ৷ প্রতিটি মানুষকেই এই পথে চলতে হবে৷ প্রতিটি মানুষের শারীরিক–মানসিক সংরচনা এই উদ্দেশ্যপূর্ত্তির জন্যেই উপযুক্ত ভাবে তৈরী করা আছে৷ উদ্ভিদ ও পশু তাদের জন্মগত সংস্কারের দ্বারা পরিচালিত হয়৷ তাই যোগের অনুশীলন করার জন্যে যে মানসিক সামর্থ্য থাকা দরকার তা তাদের নেই৷ যেহেতু তাদের মন অবনত তাই তাদের মস্তিষ্কও অনুন্নত৷ তাদের মাথার খুলি (cranium) খুবই ছোট৷ তাদের মনের চেতন অংশটুকু (স্থূল চিত্ত) যথেষ্ট ক্রিয়াশীল, তাই তাদের মনের অবচেতন বা অচেতন স্তরের কোনো প্রয়োজন নেই বা প্রয়োজন থাকলেও তা অত্যন্ত অল্প৷ একটি উদ্ভিদ তার সহজাত বৃত্তি প্রোৎসাহিত বা নিরুৎসাহিত হলে সুখ বা দুঃখের অনুভূতি লাভ করে৷ উদ্ভিদের মত পশুও এইভাবে সুখ বা দুঃখ ৰোধ করে৷ তাদের মন বা মস্তিষ্কের ওইটুকুই কার্যক্ষেত্র৷ কিন্তু মানুষের মানসিকতার ক্ষেত্রে তার মানসাধ্যাত্মিক গতিকে কখনই অবদমিত করা যায় না, রুদ্ধ করা যায় না, কেননা এর মধ্যেই যে মানুষের বৈশিষ্ট্য নিহিত আছে৷

যোগ হচ্ছে মানবীয় বৈশিষ্ট্যের সবচেয়ে উন্নত ও মূল্যবান অভিব্যক্তি৷ তাই যোগের প্রথম স্তরে একজন অবশ্যই সাহিত্য–শিল্পকলা–ব নানা প্রয়াসের মাধ্যমে নিজেকে ব্যক্ত করে৷ সাহিত্য বা বিজ্ঞান যাই বলি, সব কিছুর অন্ত্যবিন্দু তথা মূল উৎস–স্রোত হচ্ছেন পরমপুরুষ৷ তিনি সব শক্তিসামর্থ্যের পরম উৎস, চরম আশ্রয়স্থল৷ তিনিই সকলের পরমপিতা–এই মহাবিশ্বের জৈব–জৈব সব সৃষ্ট সত্তার তিনি মূলীভূত কারণ সত্তা৷ এই জন্যেই ৰুদ্ধিমান বা নিরক্ষর মানুষ, স্বাস্থ্যবান বা রোগা পাতলা, শিক্ষিত বা অশিক্ষিত যেই–ই হোক না কেন, সকলেরই জীবনের চরম ও পরম লক্ষ্য হলেন পরমপুরুষ৷ যখন মানুষ তার গতিপথের এই মূল ভাবধারাকেই খুইয়ে বসে তখনই সে মনুষত্বের স্তর থেকে নীচে নেবে আসে৷ আমার ছেলেমেয়েরা তোমরা সব সময় এই পরম সত্যকে মনে রেখে চলো৷