‘জাগ্রৎ–স্বপ্ণ–সুষুপ্ চৈতন্যং যদ্ প্রকাশতে৷
তদ্ ব্রহ্মামিতি জ্ঞাত্বা সর্বক্ষন্ধৈঃ প্রমুচ্যতে৷৷’
মানুষের মনের চারটে স্তর–জাগ্রৎ, স্বপ্ণ, সুষুপ্তি ও তুরীয়৷ যখন চেতন মন পুরোপুরি সচেতন ও সক্রিয় সেটা মনের জাগ্রৎ অবস্থা৷ আমরা সবাই এই জাগ্রৎ অবস্থায় বেশীর ভাগ সময় কাটাই৷ যখন চেতন মান সচেতন ও সক্রিয় নয়, কিন্তু অবচেতন মন সজাগ ও কোন কিছুর দ্রষ্টা তাকে বলি স্বপ্ণ বা dream৷ যেখানে চেতন ও অবচেতন দুই–ই নিষ্ক্রিয় অবস্থায় চলে যায় তাকে বলে সুষুপ্তির অবস্থা৷ আর যেখানে চেতন, অবচেতন ও অচেতন–মনের এই তিন অবস্থাই নিষ্ক্রিয় থাকে ও চিতিশক্তিতে সমাহিত থাকে সেখানে তাকে মনের তুরীয়াবস্থা বলা হয়৷
জাগ্রৎ অবস্থা কাকে বলে? জীবাত্মা কী? জীবের মানসপটে পরমাত্মার প্রতিফলনকে বলা হয় জীবাত্মা৷ যথার্থ বিচারে একমাত্র পরামাত্মাই আত্মা পদবাচ্য৷ জীবাত্মা হ’ল এই পরমাত্মার প্রতিফলন মাত্র৷ তাই প্রায়শঃই বলা হয়ে থাকে ঃ
‘যথা দর্পণাভাব আভাসহানৌ
মুখং বিদ্যতে কল্পনাহীনমেকম্৷
তথা ধীর্বিয়োগে নিরাভাসকো যঃ
সঃ নিত্যোপলব্ধিঃ স্বরূপোড়য়মাত্মা’
ধর, কারো একটা মুখ বা একটা ফুল–একটা লাল টুকটুকে ফুল৷ চারদিকে সাজানো রয়েছে কতকগুলো আর্শী৷ সেই একটা মুখ বা একটা লাল ফুল অতগুলো আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে অতগুলো ফুল বা মুখের রূপ নিয়েছে৷ আয়নার স্বভাব বা স্বচ্ছতার মাত্রা অনুযায়ী প্রতিফলিত মুখ বা ফুলের ছবি ফুটে উঠবে৷ সবগুলি প্রতিফলন ঠিক একই রকমের হবে না৷ প্রতিফলিত ছবিগুলো কেমন হবে তা নির্ভর করবে আয়নাগুলো স্বচ্ছতার ওপর৷ একটাই মুখ বিভিন্ন আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে নানান মুখের রূপ নেবে৷ অনুরূপভাবে পরমপুরুষ বা চিতিশক্তি বা আদিকারণ অজস্র মানসমুকুরে প্রতিফলিত হয়ে ওঠে৷
সকল জীবিত সত্তার, সকল প্রাণীরই একটা করে মন আছে৷ সেই মন কোথাও অবিকশিত, কোথাও বিকশিত, কোথাও অতি বিকশিত৷ অর্থাৎ যেখানে প্রাণ আছে, যেখানে প্রতিফলন আছে সেখানে মন থাকবেই৷ আর যেখানে মন আছে সেখানে জীবাত্মা থাকবেই৷ মনের ওপর প্রতিফলিত অণুচৈতন্যই জীবাত্মা আর মূল আত্মা বা জীবের মানসপটে প্রতিফলিত তার নাম প্রত্যগাত্মা৷ প্রতিফলন অংশটুকুই জীবাত্মা আর মৌলিক অংশটুকু প্রত্যগাত্মা৷ প্রত্যগাত্মা বস্তুতঃ পরমাত্মার সঙ্গে অভিন্ন, জীবাত্মা পরমাত্মা নয়–পরমাত্মার প্রতিফলন৷
‘মুখং বিদ্যতে কল্পনাহীনমেকং’৷ মুখের সামনে থেকে আয়নাগুলোকে যখন সরিয়ে নেওয়া হয় তখনও মূল মুখটা যথাপূর্বং থেকে যায়–তার কোন প্রতিফলন থাকে না৷ ঠিক তেমনি যখন সকল মনগুলোকে সরিয়ে নেওয়া হয় তখন প্রত্যগাত্মা এক অদ্বিতীয় সত্তা হিসেবে থেকেই যান, কিন্তু জীবাত্মা বলে কিছু থাকছে না৷’
‘ধীর্বিয়োগে নিরাভাসকো যঃ’৷ অর্থাৎ মন না থাকায় পরমাত্মার প্রতিফলন ঘটতে পারছে না৷’ ‘সঃ নিত্যোপলব্ধিঃ স্বরূপোড়য়মাত্মা’৷ তিনিই সর্বসত্তার, সর্বজীবের উপাস্য, তিনিই হলেন চরম ও পরম চিতিশক্তি৷’
এই একটু আগেই মনের চারটে অবস্থার কথা বললুম–জাগ্রৎ, স্বপ্ণ, সুষুপ্তি, তুরীয়৷ তুরীয় অবস্থায় হয় কী? আত্যন্তিকী একাগ্রতার দরুণ, সর্বপ্রকার মানস বৃত্তির বিন্দুস্থীকরণের দরুণ চেতন মন পুরোপুরি সমাহিত হয়ে যায়৷ অর্থাৎ চেতন মন বিন্দুস্থ হয়ে অবচেতনে মিশে যায়, আবার অবচেতনও বিন্দুস্থ হয়ে অচেতনে মিশে যায়৷ আর এই অচেতন মন স্নায়ুতন্তু ও স্নায়ুকোষের সাহায্য না নিয়েই পরম চিতিশক্তির সঙ্গে একীভূত হয়ে থাকে৷ ধ্যানের সহায়তায় চেতন মন ভূমাচৈতন্যের সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে যায়৷ সেই অবস্থায় মনের সম্পূর্ণ বিলয় ঘটে, মনের যাবতীয় ক্রিয়াশীলতা ক্ষন্ধ হয়ে যায় অর্থাৎ মনের তিনটি অবস্থাই তখন পরম জ্ঞাতৃভাবের সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে যায়৷ এই অবস্থাকে বলা হয় তুরীয় বা কৈবল্যাবস্থা৷
‘কেবল’ মানে ‘শুধু এক’৷ সেই অবস্থায় মাত্র একটি সত্তাই থাকে–পরমাত্মা৷ তাই এই অবস্থাটাকে বলা হয় কেবলাসিদ্ধি৷
‘জাগ্রৎ–স্বপ্ণ–সুষুপ্ চৈতন্যং যদ্ প্রকাশতে’৷ এখানে জাগ্রৎ, স্বপ্ণ ও সুষুপ্তি এই তিনটে হ’ল মনের ব্যক্ত অবস্থা আর তুরীয় হ’ল মনের প্রত্যাহারের চরম অবস্থা৷
এই যে মনের চার অবস্থা এরা উৎসারিত হয় কোত্থেকে? –না, এরা উৎসারিত হয় ভূমাচৈতন্য থেকে, পরমপুরুষ (Macrocosmic Entity, Supreme Entity) থেকে কারণ এরা হ’ল সেই পরম সত্তার প্রতিফলন৷
‘চৈতন্যং যদ্ প্রকাশতে’৷ সেই পরম চৈতন্যময় সত্তা (Supra-Paychic Entity, Supreme Cognition) মনের জাগ্রৎ, স্বপ্ণ ও সুষুপ্তি অবস্থার অভিব্যক্তির কারণ৷
তদ্ক্ষ্রহ্মামিতি জ্ঞাত্বা’৷৷ সেই যে পরমপুরুষ তিনিই হলেন জীবের প্রকৃত ‘আমি’, শুদ্ধ ‘আমি’ ত্নব্ভব্জন্দ্ব ‘ঢ’, ন্তুব্ধব্ভ্ত্রপ্ত ‘ঢ’গ্গ৷ মানুষের এই যে মন যার সঙ্গে সংযোগ রয়েছে জাগ্রদবস্থা–স্বপ্ণাব্, যার সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে প্রতিফলিত জীবাত্মার–সে কিন্তু জীবের প্রকৃত ‘আমি’ নয়৷ মানুষ যখন এই সব মানস স্তরের সুখ–দুঃখের সঙ্গে জড়িত হয়ে থাকে তখন সে নিত্যানন্দ বা ভূমাচৈতন্যের পারমার্থিক আনন্দের অনুভূতি পেতে পারে না৷ আর যখন তুমি ক্ষুদ্র ‘আমি’–কেন্দ্রিক সুখ–দুঃখের অনুভূতির ঊর্ধ্বে উঠতে পারবে তখনই হবে তোমার চরম আত্মিক প্রতিষ্ঠা৷ সেইটাই সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক স্তর৷ একেই বলে নির্বিকল্প সমাধি–এটা যথার্থ সমাধি পদবাচ্য৷
‘তদ্ ব্রহ্মড়য়মিতি জ্ঞাত্বা সর্ববন্ধৈঃ প্রমুচ্যতে*৷ অধ্যাত্মসাধক যখন অনুভব করে যে পরমপুরুষই তার সত্যিকারের ‘আমি’, কেবল তখনই সে যাবতীয় জাগতিক বন্ধন থেকে মুক্তি পায়৷
(পটনা, ২৩শে সেপ্ঢেম্বর, ১৯৭৮)