মনের একাগ্রতা ও মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ

লেখক
অবধূতিকা আনন্দরসধারা আচার্যা

কথায় বলে যে যন্ত্র যত বেশী সূক্ষ্ম তার শক্তিও ততোধিক৷ মন শরীর থেকে অনেক অনেক বেশী সূক্ষ্ম, তাই তা অধিকতর শক্তিসম্পন্ন৷ সেই জন্যেই প্রত্যেকটি কাজ শরীর থেকেই শুরু করতে হয়৷

মানুষ ও পশুর মধ্যেকার একটি প্রধান পার্থক্য হ’ল মনের একাগ্রতা৷ মানুষ তার মন একাগ্র করার ক্ষমতা রাখে, কিন্তু পশু তা রাখে না৷ যে কোনও কাজে সাফল্য লাভ করতে হলে চাই মনের একাগ্রতা৷ এই একাগ্রতার সঙ্গে আমরা সকলেই অল্পবিস্তর পরিচিত৷ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে একাগ্রতার ফল প্রতিনিয়ত চোখে পড়ে চলেছে৷ সঙ্গীতচর্চা, কলাবিদ্যা, বিজ্ঞানসাধনা এমনকি অধ্যাত্ম সাধনার জন্যেও একাগ্রতা অত্যন্ত প্রয়োজন৷ একাগ্রতা বিনা কোনও সাধনাই সম্ভব নয়৷ আর এই একাগ্রতা পশুদের মধ্যে একেবারেই নেই৷ পশুরা যা শেখে বা তাদের শেখানো হয়, তা তারা খুব তাড়াতাড়ি ভুলে যায়৷ কোন কিছুতেই তাদের অধিকক্ষণ মনোনিবেশ করার ক্ষমতা থাকে না৷ কিন্তু মানুষের অনেকক্ষণ মনোনিবেশের ক্ষমতা আছে ও শিক্ষাগত জিনিস মনের মণিকোঠায় (স্মৃতিতে) ধরে রাখতে পারে৷ মানুষ ও পশুর মধ্যে এখানেই পার্থক্য৷ আবার একটি মানুষের সঙ্গে অন্য একটি মানুষের পার্থক্য দেখা যায়৷ ওই একাগ্রতার তারতম্যের জন্যে৷

প্রত্যেকটি মানুষের মন কোন না কোন বিষয়ের ওপর একাগ্রতা লাভ করে, যে বিষয়টির ওপর তাঁরা মনোনিবেশ করেন, কালক্রমে সেই বিষয়টি তাঁদের প্রিয় হয়ে ওঠে, আবার কখনও কখনও তাঁরা, তাঁদের প্রিয় বিষয়টার ওপর মনোনিবেশ করে থাকে৷ উদাহরণ স্বরূপ জননী সদা সর্বদা সন্তানের ওপর মনোনিবেশ করে থাকেন৷ তাই তাঁর সন্তান সাধারণ বা অসাধারণ বা অতি কদাকার যাই হোক না কেন সন্তানের মুখখানি মায়ের কাছে অতি সুন্দর, অতি প্রিয়---প্রিয়তম সুন্দরতম বলে মনে হয়৷ মায়ের মুখখানি তার সন্তানের ওপর নিবিষ্ট রয়েছে বলেই না, তার মুখখানি এত সুন্দর এত প্রিয় বলে মনে হয়৷ আমরা সকলেই যদি সেই শিশুটির ওপর মন বসাতে পারি, তাহলে আমাদের সকলেরই তার ওপর ভালবাসা জন্মাবে৷ আমাদের সকলের কাছেই ওই শিশুটি অতি সুন্দর, অতি প্রিয়, অতি আপনার হয়ে উঠত৷ তখন আমাদের সকলেরই মনে  হ’ত এত সুন্দর চাঁদপানা মুখ বুঝি আর কারো হয় না৷ অতএব আমরা দেখতে পাই বা বুঝতে পারি, যা কিছু আমরা ভালবাসি তারই ওপর আমাদের মনোনিবেশ ঘটে৷ প্রভাত সঙ্গীত শ্রবণে আমাদের মন সেই সঙ্গীতের দিকেই ছুটে যায়, মন সেখানেই আবদ্ধ থাকতে চায়, সেখান থেকে মন আর সরে আসতে চায় না৷ অনেক বড় বড় সঙ্গীতজ্ঞরা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে মন ভরিয়ে দেন, সেখান থেকে মনকে বাস্তব জগতে সরিয়ে আনতে তাদের একটু আধটু সময় অবশ্য লেগে যায়৷ আবার এটাও সত্য উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে যাদের মন আকৃষ্ট হয়, তাদের আবার সাধারণ পর্যায়ের সঙ্গীতে মন ভরে না৷ আবার অল্প বয়সের ছেলেমেয়েরা একটু আধটু হালকা সঙ্গীতই বেশী পছন্দ করে, কারণ এতে লয়ের দ্রুতি রয়েছে৷ সেই কারণে মনকে বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে যাওয়ার কোনও সুযোগই সে পায় না৷ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের জটিলতা ভেদ করে তা অনুধাবন করা অত্যন্ত দূরূহ ব্যাপার৷ এই সঙ্গীত অনুধাবন করতে হলে বা এর জটিলতা ভেদ করতে হলে চাই অধিকতর মানসিক একাগ্রতা৷ তাই আমরা সাধারণত দেখতে পাই, যে বা যারা সাধারণ সঙ্গীত ভালবাসে সে বা তারা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ধারেকাছেই ঘেঁষে না বা তাদের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত ভাল লাগে না৷ তাছাড়া মনের একটা বড় দোষ হ’ল সুযোগ পেলেই অধোগতির দিকে বয়ে যায়৷ মনকে অধোগতির দিকে ধাবিত করলে সে লাগামবিহীন ঘোড়ার মত নীচের দিকে বিরামবিহীনভাবে ছুটতে থাকে, তাই যত সব স্থূথল সঙ্গীত তার ভাল লাগে, তাতে তার মন লাগে৷ এই ধরণের মানসিক একাগ্রতার বড় দোষ হ’ল এই যে, মন মানুষের আয়ত্তের বাইরে চলে যায়, সে আর মানুষের আয়ত্তের মধ্যে থাকে না৷ আর এই ধরণের মানুষের আয়ত্তের বাইরে চলে যাওয়া মনই মানুষকে পরিচালিত করতে থাকে৷ এইরূপ বহির্মুখী মন সর্বদাই বাইরের কোনও বস্তুর দিকে ছুটে যেতেই বেশী পছন্দ করে, আর যতক্ষণ খুশী ওই বহির্মুখী মন মানুষটাকে ওই অধোগতির দিকে ধরে রাখে বা ধরে রাখতে সাহায্য করে৷ আবার যখন একটি অতি সুমধুর সঙ্গীত আমরা শ্রবণ করি বা একটি অতি সুন্দর চিত্র দর্শন করি, তখন আমাদের মন ওই সুমধুর সঙ্গীতে অথবা ওই মনোরম চিত্রে দৃঢ়ভাবে আকৃষ্ট হয়ে যায়৷ তখন আমরা কেউ ওই মনকে সেখান থেকে তুলে আনতে পারি না৷ অতএব আমরা দেখতে পাই, মন খারাপ দিকে আকৃষ্ট হয়ে যেমন খারাপের দিকে ধাবিত হয়, ঠিক তেমনি ভালর দিকে আকৃষ্ট হয়ে---শুভের দিকে আকৃষ্ট হয়ে মন ভালর দিকে, শুভের দিকে অগ্রসর হয়৷ এমতাবস্থায় মন একাগ্র হয়৷

মনকে একাগ্র করার সঙ্গে সঙ্গে মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ চাই---যাতে অশুভ থেকে মনকে তুলে শুভের দিকে চালিত করা যায়৷ মানুষ কি মনকে নিজের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে?  যোগীদের উত্তর---পারে৷ তাঁদের মতে তাঁরা তাঁদের মনকে সম্পূর্ণ নিজের বশে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে না পারেন, মনকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার একটি কৌশল আছে৷ মনের একাগ্রতা কেবল বাড়ালেই হবে না, কোনও একটি বিষয়ের প্রতি মন একাগ্রতার পর সেখান থেকে মনকে সরিয়ে আনতে না পারলেই বিপদ৷ মন যে বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে একাগ্র হয়েছে, সেখান থেকে আর সরে আসতে চাইছে না, সেখানে সে আনন্দ উপভোগ করছে, তার খুবই ভাল লাগছে৷ এরূপ পরিস্থিতিতে মনকে সেখান থেকে সরিয়ে আনা খুবই যন্ত্রণাদায়ক৷ এরূপ অবস্থা থেকে মনকে সরিয়ে আনতে না পারাটা---মনকে সেখান থেকে তুলে আনতে না পারাটা দুঃখের একটা প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়৷  এতে মনের একাগ্রতা শক্তি তো অবশ্যই বাড়াতে হবে৷ তার সঙ্গে মনকে সেখান থেকে তুলে এনে বস্তু জগতে মনোনিবেশ ঘটানোর শক্তিটাও অর্জন করতে হবে৷ মনকে কেবলমাত্র বস্তু বিশেষে মনোনিবেশ করলেই চলবে না, তাকে সদা সর্বদা বিষয় থেকে বিষয়ান্তে পরিচালিত করতে হবে৷ একে বিষয় থেকে বিষয়ান্তে পরিচালিত করবার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে৷ এইরূপ ক্ষমতার অধিকারী মানুষের কোনও বিপদের সম্ভাবনা নেই৷ সে নির্ভয়ে বুকে সাহস ও মুখে হাসি নিয়ে সমুখের পানে এগিয়ে যেতে কোনও মতেই পিছপা হয় না, তার মানসিক একাগ্রতাই তার মনের সাহস ও শক্তি যুগিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে৷

এটাকেই মনের প্রণালীবদ্ধ ক্রমোন্নতি বলে৷ আমার পরমারাধ্য বাবা (গুরুদেব)-এর মতে, ‘‘মনের একাগ্রতা সাধনাই শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র৷’’ অনেক অনেক বই পড়ে দু’চারটে পাশ করা বা গাদা গাদা তথ্য সংগ্রহ করা শিক্ষার মাপকাঠি নয়, শুধুমাত্র শিক্ষণীয় বিষয় নিয়ে মাথা ঘামালেই চলবে না, মনের একাগ্রতা ও মনের নির্লিপ্ততার শক্তিকে বাড়িয়ে তোলার মত ক্ষমতা বর্ধনের শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা৷ এই শিক্ষাই শিশু থেকে শুরু করে সবার মধ্যে দেওয়া একান্ত প্রয়োজন৷  আজকের শিশুই ভবিষ্যতের সুনাগরিক৷ সুনাগরিক নিয়ে এক-একটি দেশ, মহাদেশ, বিশ্ব, মহাবিশ্ব তৈরী হয়৷ আর ওই সমস্ত দেশ-মহাদেশ, বিশ্ব-মহাবিশ্বের নাগরিক সুশিক্ষিত হলে একাগ্রতা ও নির্লিপ্ততায় প্রতিষ্ঠিত হলে এই মহাবিশ্ব একদিন স্বর্গে পরিণত হবে৷ তখন সকলেরই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা কবিতার লাইনটি মনে পড়বে৷---‘কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক, কে বলে তা বহু দূর / মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক, মানুষেই সুরাসুর৷’ যাইহোক শিক্ষা প্রণালী কেবলমাত্র বহির্জগতেই খুঁজলে চলবে না, খুঁজতে হবে অন্তর্জগতেও৷ কথায় বলে ‘যা আছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তাই আছে নিজ ভাণ্ডে৷’ যখন সব কিছুই নিজের ভাণ্ডারে রয়েছে, তখন তাকে খুঁজতে, বাইরে যাওয়ার কী প্রয়োজন? মানুষ ইচ্ছা করলেই মনের একাগ্রতা, শক্তি বাড়িয়ে নিজের মনকে অনেক বড় বড় কাজে লাগিয়ে দেশের দশের তথা এই মহাবিশ্বের কল্যাণ সাধন করতে পারে৷ শৈশব হতেই শিশুর নির্মল চিত্তে আক্ষরিক জ্ঞান প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে একাগ্রতা ও নির্লিপ্ত হওয়ার ক্ষমতা বর্ধনের শিক্ষাও প্রদান করা বিধেয়৷ নতুবা শিশুর নির্মল মন বড় হতে না হতেই জাগতিক আবর্জনায় ভরে যাবে৷

যে কোনও বিষয়ের ওপর মানুষ ইচ্ছামত মনোনিবেশ করতে পারে৷ তবে মানুষের মন যেন বিষয়ের দ্বারা আকৃষ্ট না হয়ে বিষয়ের দিকে প্রভাবিত হয়৷ মানুষের মন কোনও বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়েই সেখানে আটকে যেতে বাধ্য হয়৷ কোনওভাবেই মানুষ তা থেকে বিরত থাকতে পারে না, বা মনকে সংযত করতে পারে না৷ বিষয় যেন মানুষের মনকে তার কাছে টেনে আনে৷ বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি আকর্ষিত হয়ে মন সেই সব বিষয়ের দ্বারা প্রতি প্রভাবিত হতে বাধ্য হয়৷ কেউ চাইলেও আর মনকে বাধা দিতে পারে না৷ এইরূপ অবাধ্য মনকে সংযত করতে হলে তাকে নিজের বশে আনতে হলে, যেখানেই ইচ্ছা নিবিষ্ট করতে হলে, চাই এক বিশেষ শিক্ষাপ্রণালী৷ এই বিশেষ প্রকার শিক্ষা প্রণালীই মানুষের মনকে শান্ত করতে, একাগ্র করতে, সংযত করতে সাহায্য করবে৷ এই প্রকার বিশেষ শিক্ষা বিনা মন কোন মতেই শান্ত হওয়ার, একাগ্র হওয়ার পাত্র নয়, তাকে শান্ত করতে গেলে বা একাগ্র করতে গেলে এক বিেৃশষ শিক্ষা প্রণালী বা ধর্মের অনুশীলন প্রয়োজন৷ এই প্রকার অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষ তার মনকে ঘুরিয়ে ঈশ্বরের ওপর নিবিষ্ট করতে পারবে৷ তার নিজের মনের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারবে৷ এই প্রকার ধর্মানুশীলন বা ধর্মসাধনার উদ্দেশ্য,মানুষের সর্বাত্মক উন্নতি সাধন৷ ইহা মানুষের সমস্ত স্থূল ও সূক্ষ্ম সম্পদকে যথাযথভাবে কাজে লাগায়৷ আমার পরমারাধ্য গুরুদেব তার চর্যাচর্য (প্রথম ভাগ) বইটির ‘সাধনা’ নামক অধ্যায়ের প্রথম পঙক্তিতেই বলেছেন---‘সাধনা, জগৎকে বর্জনকে করতে শেখায় না---সমস্ত স্থূল ও সূক্ষ্ম সম্পদকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোই সাধনা৷ অতএব সুস্থ শরীর ও সুস্থ মন যথাযথভাবে নিয়মকানুন মেনে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে এগিয়ে চলে নিজ লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব৷ আমাদের এই শরীর ও মনকে সুস্থ রাখতে গেলে কতগুলি স্তরের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে রাখতে হবে৷ এই স্তরগুলিকে পতঞ্জলী,অষ্টাঙ্গিক যোগ বলে আখ্যায়িত করেছেন৷ অষ্টাঙ্গিক যোগ সাধনার প্রত্যেকটি স্তর যদি কোনও মানুষ উত্তীর্ণ হতে পারে, তবে সে মানুষ অবশ্যই দেবত্বে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে৷ আমাদের বাবা দিয়েছেন তার জন্যে প্রত্যেককে ওই অষ্টাঙ্গিক যোগের প্রত্যেকটি স্তর পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেনে চলতে হবে৷ এই স্তরগুলি যথাক্রমে ১ম যমসাধনা, ২য়-নিয়ম সাধনা, ৩য়-আসন সাধনা, ৪থ -প্রাণায়াম সাধনা, ৫ম-প্রত্যাহার সাধনা, ৬ষ্ঠ-ধারণা সাধনা, ৭ম-ধ্যান সাধনা ও ৮ম-সমাধি সাধনা৷ প্রথম ও দ্বিতীয় স্তর মানুষকে জগতের সঙ্গে সুসঙ্গত ব্যবহার করতে শেখায়৷ এই সাধনায় প্রতিষ্ঠিত মানুষ ষড়রিপু অক্টোপাশের বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করে৷ এই যম নিয়ম শিক্ষাই আদর্শ মানবত্বের শিক্ষা৷ এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে আদর্শ মানবত্বের বীজ৷ তাই যে বা যারা ধর্মানুশীলন বা ধর্ম সাধনার দ্বারা নিজের সর্বাঙ্গীন উন্নতি সাধনে আগ্রহী তাদের প্রত্যেককেই এই যম ও নিয়ম সাধনায় প্রতিষ্ঠিত হতেই হবে৷

তিন ঃ আসন ঃ শুরুতেই বলেছি, প্রত্যেকটি কাজ শরীর থেকেই শুরু করতে হয়৷ কাজেই শরীর সুস্থ ও নীরোগ না থাকলে ও শরীরের গ্রন্থিসমূহ ত্রটিমুক্ত না হলে মনকে কাজে লাগানো অর্থাৎ মনকে সাধনার উপযুক্ত করে গড়ে তোলা সম্ভব নয়৷ আসন করলে মন স্থির হয় ও গ্রন্থিসমূহ সক্রিয় হয়৷ তাই বলা হয়, যে ভঙ্গিতে বা যার অভ্যাসে দীর্ঘ সময় অনায়াসে সুস্থভাবে বসে থাকা যায়, তাই আসন৷ আসনে মেরুদণ্ড ভারমুক্ত থাকে, এই অবস্থায় দেহের ভার বক্ষপঞ্জরের ওপর বিরাজ থাকবে৷ তাই ধর্ম সাধনায় আসনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ৷ তবে সতর্কবাণী লক্ষণীয়৷ কোনও স্বকপোল কল্পিত কৌশলে মনকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করা উচিত নয়৷ একমাত্র বিশেষ কোন ব্যষ্টি, যিনি এই বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত তার কাছ থেকে,এই কৌশল শিক্ষা লাভ করাই বিধেয়৷ টিভি দেখে অথবা লোকের মুখে শুনে অথবা বই পড়ে অথবা বিবিধ কঠোর সাধনার সাহায্যে আসন করলে হিতে বিপরীতই হবে৷ নিজেকে ঠকানো হবে, নিজের জীবনে একটা বিরাট ভুল হয়ে যাবে৷ তাই এসব থেকে সাবধান থাকাই ভাল৷

চার ঃ প্রাণায়াম ঃ মানুষের মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ আসে প্রাণায়াম থেকে৷ প্রাণবায়ুর সঙ্গে মনের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক৷ এদের কারও মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা দিলে অন্যদেরও চাঞ্চল্য বোধ হয়৷ তাই মন ও প্রাণ বায়ুর প্রতি নিয়ন্ত্রণ আনতে গেলে আমাদের প্রাণায়াম করা অতি আবশ্যক৷ নিয়ন্ত্রিত শ্বাসক্রিয়া অভ্যাসের ফলে দেহে আসে সমতা৷ আর এই সমতাই মনকে ধরতে সাহায্য করে৷ প্রাণায়াম একটি বিজ্ঞান ভিত্তিক বায়ু নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি৷ এতে মনেরও নিয়ন্ত্রণ ঘটে৷ তাই এই প্রাণায়াম যেমন তেমন ভাবে বা যেখানে সেখানে বা যখন খুশী তখন করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ৷ প্রাণায়াম একটি বিজ্ঞানসম্মত আধ্যাত্ম সাধনা৷ যার সাহায্যে শরীর ও মন দুইই তরতাজা হয়ে ওঠে৷ কর্ষক যেমন মাটি কর্ষণ করে সোনার ফসল ফলায়, সাধকও তেমনি প্রাণায়াম সাধনায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে এই দেহরূপী ক্ষেত্রকে মনরূপী হাল দ্বারা কর্ষণ করে ও ইষ্টমন্ত্রের বীজ বপন পূর্বক সাধনারূপী ফসলের প্রত্যাশা করে৷ এই কথাটি সাধক রামপ্রসাদ খুব ভাল করে বুঝিয়েছিলেন৷ তাই তিনি রামপ্রসাদী সঙ্গীতে বলেছেন---‘মনরে কৃষি কাজ জানো না / এমন মানব জমিন রইল পতিত / আবাদ করলে ফলত সোনা / মনরে কৃষিকাজ জানো না৷

প্রত্যাহারঃ শরীর যেমন মনের ওপর ক্রিয়াশীল, ঠিক তেমনি মনও শরীরের ওপর ক্রিয়াশীল৷ দুজনেই দুজনের ওপর ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে থাকে৷ প্রত্যেক মানুষের মানসিক অবস্থার অনুরূপ অবস্থা, যেমন শরীরের ওপর প্রস্ফূটিত হয়, ঠিক তেমনি শরীরের প্রতিটি ক্রিয়ার---অনুরূপ প্রতিক্রিয়া মনের ওপর প্রতিফলিত হয়৷ স্থূল দেহ শরীরের স্থূল অংশ আর মন শরীরের সূক্ষ্মতম অংশ বলে ধরে নিতে পারি৷ আবার ভাবতে পারি শরীর ও মন দুটি পৃথক সত্তা৷ শরীরের স্থূলাংশ দেহ যা দৃশ্যমান বা বাহ্যিক, আর মন হ’ল সূক্ষ্মাংশ যা অদৃশ্যমান-আভ্যন্তরীণ৷ অথচ এই দুটিই দুটির ওপর প্রতিনিয়ত ক্রিয়াশীল বা প্রতিক্রিয়াশীল৷ মনের এই ক্রিয়াশীলতার জন্যেই মন বড় চঞ্চল৷ এই চঞ্চল বা অবাধ্য মন, সদাসর্বদা বিষয় থেকে বিষয়ান্তে ছুটে চলে৷ মনের এই গতিকে ইচ্ছামত চলতে দিলে, তাকে বশে আনা বা তাকে নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে৷ লাগামবিহীন ঘোড়ার মত সে চলতে থাকে৷ এমতাবস্থায় মনের গতি নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে৷ মনের ভারসাম্য হারিয়ে যায়৷ এই প্রকার চঞ্চল নিয়ন্ত্রণবিহীন অবাধ্য মনকে বিষয়ান্তর থেকে ফিরিয়ে আনার যে নিরলস প্রয়াস তাকেই বলে প্রত্যাহার সাধনা৷ ইষ্টের উদ্দেশ্যে---গুরুর উদ্দেশ্যে, বর্ণাঘ্যদানই প্রত্যাহার সাধনার একমাত্র সহজ উপায়৷

ধারণা-সাধনা ঃ স্থির বা শান্ত মনকে শরীরের অভ্যন্তরের একটি নির্দিষ্ট স্থানে, নির্দিষ্ট জায়গায় ধরে রাখা বা আটকে রাখার যে বিশেষ পদ্ধতি তাকেই বলে ধারণা, সাধনা বাconception৷ ধারণা প্রতিষ্ঠিত মানুষ ধীর-স্থির ও শান্ত স্বভাবের হয়৷ তাদের মন বিশ্বব্যাপী বিরাট মনেরই অংশে পরিণত হয়ে যায়৷ প্রত্যেক মনের সঙ্গে তার মনের সংযোগ হয়ে যায়৷ তার মন যেখানে থাক না কেন, গোটা বিশ্বের সাথে তারা সত্যিকারের যোগাযোগ হয়ে যায়৷ সেই কারণেই হয়ত যোগীরা বলে থাকেন মন নিরবিচ্ছিন্ন, তা বিশ্বব্যাপী৷ ছোট বড় সব মনই সেই এক বিরাট মনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ মাত্র, আবার বলতে পারি ওই সমস্ত মন একই সমুদ্রের কয়েকটি ছোট ছোট তরঙ্গ বিশেষ৷

ধ্যান সাধনা ঃ মনের সমস্ত বৃত্তি সমূহকে ধ্যেয়ের দিকে, ঈশ্বরের দিকে নিবদ্ধ রাখার নিরলস প্রয়াসকে ধ্যান সাধনা বলে৷ একটি বিরাট তেলের পাত্রের ঠিক নীচের দিকে একটি ছোট্ট ছিদ্র করে দিলে, ছিদ্র থেকে অনর্গল ধারায় তেল বের হতে থাকে৷ বলতে পারি তেলের ধারাটি নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে বয়ে চলেছে৷ ওইরূপ নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে মনকে ঈশ্বরের দিকে ধাবিত করার নামই ধ্যান সাধনা৷ এই ধ্যান সাধনায় প্রতিষ্ঠিত মানুষই তার ভিতরের সত্যিকারের মানুষ গড়ে তোলা, সর্বাধিক জ্ঞানদান শিক্ষার আদর্শ হওয়া উচিত৷  শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘের সর্বক্ষণের কর্মীরা সর্বক্ষণ ওইরূপ শিক্ষাদানের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর সেবাকার্যে রত রয়েছেন৷