মনকে ভারমুক্ত রাখ  

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

বুদ্ধির মান অনুযায়ী জীবকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে–পশু, মানব আর দেবতা৷ আমাদের মানব সমাজেও আমরা পাই মানবীয় আধারে পশু, মানবীয় আধারে মানব আর মানবীয় আধারে দেবতা৷

আমাদের সাধনা কী? সাধনা হচ্ছে পশুত্বের স্তর থেকে মানবত্বের দিকে, আর মানবত্বের স্তর থেকে দেবত্বের স্তরের দিকে যাত্রা৷ আর শেষপর্যন্ত এই দেবত্বের স্তরে উন্নীত হয়ে মানুষের পরমপুরুষের সে৷ এক হয়ে যাওয়া৷ যে নির্দিষ্ট বিন্দুতে দেবত্ব পরমপুরুষের সে৷ একাত্মতা অর্জন করছে, সেই বিন্দুটিই হচ্ছে মানব জীবনের যাত্রাপথের অন্তিম বিন্দু৷ তাই এই জীবন হচ্ছে ক্রমশঃ এগিয়ে চলতে থাকার একটা যাত্রা৷ তাই জীবনে গতিময়তা থাকবেই৷ মানুষের জীবনে কখনো কোনো অবস্থাতেই তমোগুণী তত্ত্বকে সমর্থন করা বা প্রোৎসাহিত করা উচিত নয়৷ গতিই জীবনের নিয়ম৷

তোমরা জান প্রাচীনকালে রোহিত নামে এক বড় পণ্ডিত ছিল৷ সে সর্বশাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিল৷ শাস্ত্র শব্দটির অর্থ কী? ‘শস’–এর অর্থ ‘নিয়ন্ত্রণ করা’, শাসন করা আর ‘ত্র’ মানে ‘মুক্তিদাতা’৷ যা তোমার সমস্ত কর্মকে নিয়ন্ত্রণ করে তোমাকে মুক্তির পথ দেখাচ্ছে–‘এটা কোরো না’, ‘এটা করো’, এইভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে–তাই শাস্ত্র৷ শাস্ত্র স্বগত অভিভাবনের দ্বারা তোমাকে মুক্ত করছে৷ স্বগত অভিভাবনের অর্থ হচ্ছে মন্ত্র৷ ‘মননাৎ তারয়েৎ যস্তু সঃ মন্ত্রঃ পরি কীর্ত্তিতাঃ’৷

যাই হোক্, সেই রোহিত সর্বশাস্ত্রে পণ্ডিত ছিল৷ গুরুগৃহ থেকে ফিরে আসবার পরে যখন তার লৌকিক পিতা তাকে ঘরের কাজকর্ম করতে বললেন তখন সে বলল, ‘‘আরে, আমি অনেক শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছি, আর আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে কর্ম করার কোনো প্রয়োজনই নেই৷ আমাদের সর্বদা জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থাকা উচিত’’৷

তখন তার পিতা বললেন, ‘‘হে রোহিত, যে এগিয়ে চলেছে, যে জীবনে শরীর ও মনে গতিময়তা বজায় রেখেছে, সে ধন্য৷ পরিশ্রমী ও ঘর্মাক্ত শরীরের যে মানুষটি, সেই সবচেয়ে বেশী সুন্দর৷ সেই ঘর্মাক্ত শরীরের একটা ভুবনমোহিনী আকর্ষণ আছে, আর দেবতাদের রাজা ইন্দ্র স্বয়ং সেই পরিশ্রমী মানুষের সে৷ বন্ধুত্ব করতে এগিয়ে আসেন৷ তাই হে রোহিত, এগিয়ে চলো, আরও এগিয়ে চলো৷ জীবনে গতিশীলতাই প্রধান’’৷

‘‘যদি কেউ কোনো কর্ম না করে, যদি কেউ কর্ম করার ব্যাপারে ভয় পায় তাহলে তার ভাগ্যও শুয়ে থাকে৷ যদি কেউ মানসিকভাবে আর শারীরিকভাবে ঘুমিয়ে আছে, তাহলে তার ভাগ্যও ঘুমিয়ে আছে৷ কিন্তু যদি কেউ কিছু কর্মে রত হয়, তাহলে তার ভাগ্যও এগিয়ে চলার দিকে অগ্রসর হয়৷ কেউ দাঁড়িয়ে আছে, তার ভাগ্যও দাঁড়িয়ে আছে৷ আবার কেউ এগিয়ে চলেছে, তার ভাগ্যও এগিয়ে চলেছে৷ তাই রোহিত, কিছু করো, কিছু করো৷’’

‘‘যখন তুমি অজ্ঞতায় আচ্ছন্ন হয়ে ঘুমিয়ে আছ, সেটা তোমার জীবনে কলিযুগ৷ যখন তুমি অনুভব কর যে তোমাকে কিছু করতে হবে তখন তোমার জীবনে সেটা দ্বাপর যুগ৷ আর যদি কেউ কাজ করার জন্যে প্রস্তুত হয়ে যায় সেটা তার জীবনে ত্রেতাযুগ আর কেউ যদি বাস্তবিকভাবে কাজ শুরু করে দেয়, সাধনা শুরু করে দেয়, সেটা তার জীবনে সত্যযুগ৷ তাই রোহিত, কর্ম করো, কর্ম করো৷ জীবন হচ্ছে  অস্থিরতার অবস্থা থেকে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার নিরন্তর প্রয়াস৷ জীবন একটা সংগ্রাম৷ জীবন সর্বদা এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে৷ এইজন্যে জীবন একটা গতিশীল শক্তি৷’’

তাই মানব জীবন হচ্ছে পশুত্বের স্তর থেকে মানবীয় স্তরে উন্নীত হওয়ার পানে গতিশীলতা, তেমনি মানবীয় স্তর থেকে দেবত্বের স্তরকে প্রাপ্ত হওয়া, আবার দেবত্বের স্তর থেকে পরমপুরুষের সে৷ একাত্ম হয়ে যাওয়াই মানব জীবন৷ এটাই তোমার সাধনা৷

কিন্তু তুমি জান, যদি তোমাকে দ্রুত এগিয়ে চলতে হয়, তোমার মনকে হালকা রাখতে হবে যদি মন ভারগ্রস্থ হয়ে থাকে তাহলে সেই মন এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে না৷ মন কেন ভারাক্রান্ত হয়? নানা প্রকারের আবর্জনা মনকে ভারগ্রস্ত করে৷ ভগবান ক্ষুদ্ধ বলেছেন,–

          ‘‘সিঞ্চ ভিক্ষু ইমং নাবং সিত্তা তে লহু মেস্যতি৷’’

                    ***

          ‘‘মুঞ্চ পুরে মুঞ্চ পচ্ছেত মঝ্যে মুঞ্চ ভবস্য পারগু৷’’

‘‘তুমি তোমার মনকে ভারমুক্ত রাখ৷ এইজন্যে সব জাগতিক চিন্তা, নীচ চিন্তা, সব অধোগতিমূলক চিন্তা পরিত্যাগ কর, আর এইভাবে নিজের মনকে হালকা রাখ৷’’ মনকে হালকা রাখার অর্থ মনের আবর্জনা থেকে মুক্ত হওয়া৷ একটি চুম্বক কোনো লৌহখণ্ডকে সহজেই আকর্ষণ করে কিন্তু যদি সেই লৌহখণ্ড ময়লাযুক্ত হয়ে থাকে তাহলে সেই চুম্বক আর লোহাকে আকর্ষণ করতে সক্ষম নাও হতে পারে৷ তাই পরমপুরুষ সর্বদা তোমাকে আকর্ষণ করে চলেছেন৷ কিন্তু মনের আবর্জনা তোমার মনকে ভারগ্রস্ত করে রেখেছে, তাই তুমি সেই আকর্ষণ অনুভব করতে পারছ না৷

এখন প্রশ্ণ হ’ল মনকে কীভাবে ভারমুক্ত রাখব, হালকা রাখব, কীভাবে জাগতিক জীবনের বিভিন্ন ক্ষোঝা থেকে মনকে মুক্ত রাখব? এর একমাত্র উপায় আর্ত মানবতার সেবায় নিজেকে ব্রতী করা, যে সেবায় কোন রকমের জাতি, ধর্ম বা লি৷গত ভেদ থাকবে না৷ তাই তোমরা সাধক, তোমাদের সর্বদা মনে রাখতে হবে যে তোমার জীবন–ধর্ম হচ্ছে জড় থেকে চরম সূক্ষ্মতার দিকে, চরম সূক্ষ্মতা থেকে আত্মার দিকে, আর আত্মা থেকে পরমাত্মার পানে এগিয়ে চলা৷ আর এই জীবন–ধর্ম পালনের সময় তোমাকে আর্ত মানবতার সেবায় নিয়োজিত থাকতে হবে৷ এই কথাটা অবশ্যই ভুলে যাওয়া উচিত নয়৷ যদি তুমি জগতের প্রতি তোমার নিঃস্বার্থ সেবায় সার্থক হতে পার, তাহলে অবশ্যই তুমি তোমার আধ্যাত্মিক জীবনেও সফল হবে৷ শুভমস্তু৷