মনকে একাগ্র করার উপায়

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

আজ একজন সাধক মনকে একাগ্র করার পদ্ধতি সম্বন্ধে জানতে চেয়েছিল৷ তার প্রশ্ণ ছিল কীভাবে মন একাগ্রতার চরমাবস্থায় পৌঁছতে পারবে? এর উত্তর সব সাধকেরই জানা উচিত৷ বৌদ্ধিক বিচারে প্রতিটি জীবই তিন শ্রেণীভুক্ত–পশু, মানব ও দেবতা৷ আধ্যাত্মিক সাধনা হ’ল এক বিশেষ অভ্যাস যা পশুত্ব থেকে মানবত্বে ও মানবত্ব থেকে দেবত্বে প্রতিষ্ঠিত করে৷

আমাদের মানুষের সমাজে এই তিন শ্রেণীরই জীব আছে অর্থাৎ মনুষ্য দেহধারী পশু রয়েছে, রয়েছে মনুষ্য দেহধারী মানুষ ও মনুষ্য দেহধারী দেবতা৷ আর আমাদের সমাজের সব সমস্যা সৃষ্টি করে এই মনুষ্য দেহধারী পশুরা, যত কষ্ট ভোগ করে মনুষ্যদেহী মানুষেরা, আর সমস্ত সমস্যার সমাধান করেন মনুষ্য দেহধারী দেবতারা৷ তাই একজন আধ্যাত্মিক সাধক সমস্যার সমাধান করেন, নোতুন সমস্যার সৃষ্টি করেন না৷

সাধনা সবার জন্যে, আধ্যাত্মিক অভ্যাস সবার জন্যে৷ তোমরা জান যে সমাজে মনুষ্যদেহী পশু রয়েছে, রয়েছে পশু দেহধারী পশু৷ এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য কী? –না, এই পশু দেহধারী জানোয়ারেরা জানে না যে তারা পশু৷ কিন্তু মনুষ্য দেহধারীরা বুঝতে পারে যে তাদের ভেতরে রয়েছে একটি পশু৷ তাই এদের অবশ্যই ভালো ভালো কাজ করা উচিত, মহৎ কাজ করা উচিত৷

প্রথম স্তরে মানসিক একাগ্রতার পদ্ধতি হচ্ছে শারীরিক ও মানসিক, আর দ্বিতীয় স্তরে মানসাধ্যাত্মিক৷ একটি মানুষের শরীর আছে, মন আছে, আর আছে আত্মিক অস্তিত্ব৷ তাই প্রাথমিক ক্ষেত্রে সাধনা অবশ্যই দৈহিক পরিভূ থেকে শুরু হয়ে দৈহিকতা ও মানসিকতার সাধারণ বিন্দুতে গিয়ে শেষ হবে৷ এটাকেই বলা হচ্ছে শারীরিক ও মানসিক প্রয়াস৷ তার পরে মানসাধ্যাত্মিক প্রয়াস শুরু হবে মানসিক অধিক্ষেত্র থেকে আর শেষ হবে আধ্যাত্মিকতার পরমাস্থিতিতে৷

বিভিন্ন বৃত্তির তাড়নায় মানুষের মন ছুটে চলেছে৷ জীবমনের জটিলতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক সংরচনা জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে৷ একটি পশুর শরীরে জটিলতা মানুষের চেয়ে কম, কেননা মানুষের মানসিক সংরচনা পশুর চেয়ে অনেক বেশী জটিল৷ মানুষের শরীরে গ্রন্থির সংখ্যা তথা বৃত্তির সংখ্যা একটা পশুর থেকে অনেক বেশী৷ তাই শারীরিক ও মানসিক প্রয়াসের প্রথম স্তরে বৃত্তিমুখী মনকে জাগতিক বস্তুসমূহের আকর্ষণ থেকে প্রত্যাহার করে নিয়ে মানসিক ক্ষেত্রে বিন্দুস্থ করতে হবে৷ তারপরে আবার বিভিন্ন মানসবিষয় বা মানসাভোগ থেকে মনকে প্রত্যাহার করে নিয়ে সেই মনকে ছুটিয়ে দিতে হবে পরমপুরুষের দিকে৷ এটাই হচ্ছে মানসিক একাগ্রতার সঠিক পদ্ধতি৷

অবশ্যই  একাগ্রতার অভ্যাস আধ্যাত্মিক সাধনার প্রধান দিক৷ এছাড়া সাধনার অন্যান্য  সহায়ক অঙ্গও  আছে৷ যেমন–আসন, প্রাণায়াম৷ এদের বলা হয় সাধনাঙ্গ৷

এখন এই যে একাগ্রতার সাধনা তাতে মনই যদি পুঞ্জীভূত সংস্কারের বোঝায় ভারাক্রান্ত হয়ে থাকে, তাহলে সেই মন এগিয়ে চলবে কি করে? ধর, তুমি নদী পার হচ্ছো৷ যদি ছিদ্র দিয়ে জল ঢুকে তোমার নৌকো ভারী হয়ে যায় তাহলে তো তুমি নদী পার হতে পারবে না৷ তাই তোমাকে নৌকো থেকে জল বের করে দিতেই হবে৷

মনকে এই বোঝা থেকে মুক্ত করা কীভাবে সম্ভব? শ্রেণী, সম্প্রদায়, জাতীয়তা, লিঙ্গ ইত্যাদি সম্পর্কে মনে কোন বৈষম্যের ভাবনা না রেখে নিঃস্বার্থ সমাজসেবার মাধ্যমে এটা সম্ভব৷ তাই মুক্তি পেতে গেলে সমাজসেবা করতেই হবে৷

এই কর্মময় জগতে সাফল্য লাভের আবশ্যিক তত্ত্বগুলি কী? শিব পার্বতীকে বললেন–দৈহিক, মানসিক বা মানসাধ্যাত্মিক কর্মে সফলতা লাভের জন্যে সাতটি উপাদান অপরিহার্য৷ সেগুলি হ’ল–

‘‘ফলিষ্যতি ইতি বিশ্বাস সিদ্ধের্প্রথম লক্ষণম্৷

দ্বিতীয়ং শ্রদ্ধয়া যুক্তং তৃতীয়ং গুরু পূজনম্৷৷

চতুর্থো সমতাভাব পঞ্চম ইন্দ্রিয়ঃ নিগ্রহ৷

ষষ্ঠঞ্চ প্রমিতাহার সপ্তমং নৈব বিদ্যতে’’৷৷

–শিবসংহিতা

আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছবই এই দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ই প্রথম তত্ত্ব৷ দ্বিতীয় আবশ্যিক তত্ত্ব হচ্ছে নিজের লক্ষ্যের প্রতি শ্রদ্ধা জাগাতে হবে৷ তাহলে জানতে হবে শ্রদ্ধা জিনিসটা কি? ইংরেজী বা লাতিন ভাষায় শ্রদ্ধার সমার্থক কোন শব্দ নেই৷ শ্রদ্ধা মানে–‘‘শ্রত সত্যং তস্মিন্ ধীয়তে ইতি শ্রদ্ধা’’৷ মানুষের জীবনে লক্ষ্য কী? পরমসত্তা বা পরমপুরুষ হলেন পরম বিষয়ীভূত সত্তা৷ তাই আধ্যাত্মিক সাধনার ক্ষেত্রে তিনি সকল জীবের আরাধ্য, তাই তাঁর প্রতি অর্থাৎ সেই একের প্রতি শ্রদ্ধা থাকতে হবে৷ মনকে সমস্ত বিষয় থেকে প্রত্যাহূত করে শ্রৎ রূপ পরমসত্যের দিকে যে ছুটিয়ে দেওয়া সেটাই হ’ল শ্রদ্ধা৷ আগেই বলেছি যে শ্রদ্ধার কোন সমার্থক একক শব্দ ইংরেজি বা লাতিন বা অন্য কোন ভাষায় নেই৷ তাই দ্বিতীয় উপাদান হ’ল শ্রদ্ধা৷

তৃতীয়ং গুরুপূজনম্–নিজের গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা হ’ল তৃতীয় উপাদান৷

চতুর্থ সমতাভাব–চতুর্থ তত্ত্ব হ’ল মানসিক সাম্যাবস্থা৷ ‘তিনি ব্রাহ্মণ সুতরাং তাঁকে সম্মান দিতে হবে৷ অন্য আরেক জন ইড়াবা সম্প্রদায়ভুক্ত, সে আমার থেকে অনেক নিচু জাতের৷’ এই যে ভাবনা এটা খুবই বিপজ্জনক৷ যারা এই ভেদভাব পোষণ করে তাদের পক্ষে পরমপথ পাওয়া দুরূহ৷

আর পঞ্চম তত্ত্ব হচ্ছে ইন্দ্রিয় নিগ্রহ৷ ব্যষ্টি মাত্রেরই নিজ নিজ কর্মেন্দ্রিয় ও জ্ঞানেন্দ্রিয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে৷ যা আমার মনকে দূষিত করে আমি তেমন বস্তু দেখব না, তেমন কথা শুণবো না৷ এইভাবে চললেই সমস্ত ইন্দ্রিয়ের প্রতি নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকবে৷ বুদ্ধ বলেছেন ‘‘চক্ষুণা সংবরো সাধু’’৷ হে সাধু তুমি তোমার চক্ষুরিন্দ্রিয়ের প্রতি নিয়ন্ত্রণ রাখো৷ উপরি–উক্ত শ্লোকটি পালি ভাষায় লিখিত৷ ইন্দ্রিয়ের ওপর সর্বাত্মক সংযম থাকতেই হবে৷

‘‘ষষ্ঠঞ্চ প্রমিতাহারো’’–আহারের ওপর সম্যক নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে অর্থাৎ খাদ্য হবে পুষ্টিকর, কিন্তু তা কখনই অতিভোজন হবে না৷

‘‘সপ্তমং নৈব বিদ্যতে’’৷ আমি বলেছি সাতটি তত্ত্ব কিন্তু এখন আমি বলছি সপ্তম তত্ত্বের অস্তিত্ব নেই৷ এই ছয়টি তত্ত্ব থাকলেই মানুষ জীবনে সফলতা প্রাপ্ত হবে, পরমপদ লাভ করবে৷ আমার বিশ্বাস তোমরা এগুলি মনে রেখে সেইমত অনুসরণ করার চেষ্টা করে চলেছ৷