নামের উৎপত্তি খুলনা

লেখক
প্রণবকান্তি  দাশগুপ্ত

বাংলাদেশের খুলনা জেলার পূর্বনাম ছিল ‘নয়া আবাদ’৷ সুন্দরবনের ২,২৯৭ বর্গমাইল যশোর ও খুলনা জেলার অন্তর্গত৷ সুন্দর বনের এক তৃতীয়াংশ খুলনার অন্তর্ভুক্ত৷ সুন্দরবনের কাঠ ছিল তখনকার দিনে বাণিজ্যিক সম্পদ৷ ঐ কাঠ কাটতে লোকে সুন্দর বনে যেতো৷ বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও এই সুন্দরবনের পথ ছিল অপরিহার্য৷ কাঠ সংগ্রহই করুক আর বাণিজ্যই করুক নয়াবাদই ছিল অভিযাত্রীদের শেষ ঠেক৷ অর্থাৎ নয়াবাদের পরে আর কোন বসতি নেই৷ সন্ধ্যা হলে নয়াবাদেই সবাই নৌকা নোঙর করতো৷ রাতে সুন্দর বনের দিকে অগ্রসর হওয়া ছিল বিপজ্জনক৷ যদি  কোন দুঃসাহসী যাত্রী নৌকা খুলে এগোতে চেষ্টা করতো, বনের মধ্য থেকে তখনি  বন-দেবতার নিষেধাত্মক বাণী শোণা যেত---‘‘খুলো না, খুলো না৷’’ খুলো না থেকেই নয়বাদের নাম  হয়ে গেল ‘খুলনা’৷

অনেকের কাছে এ ঘটনা বিশ্বাসযোগ্য  নয়৷ খুলনা নামের  উৎপত্তি বিষয়ে তারা বলেন অন্যকথা৷

মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে (দ্বিতীয়খণ্ড) আমরা ধনপতি সদাগরের সন্ধান পেয়েছি৷ ধনপতির ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল সারা বাংলাদেশ ব্যাপী৷ বিরাট ধনীলোক ছিলেন তিনি৷ তার দুই স্ত্রী---লহনা ও খুল্লনা৷ সংসারে দুই সতীনের ঝগড়া লেগেই ছিল৷ জ্যেষ্ঠা লহনা ছিল অত্যন্ত  হিংসাপরায়না৷ সে তার সতীন খুল্লনাকে সর্বদা নির্যাতন করতো৷ কিন্তু খুল্লনার পতি ভক্তি ছিল অটুট৷ সর্বাধিক সদ্‌গুণসম্পন্না খুল্লনা সতী-সাধীরূপে  প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল৷ এই খুল্লনার নামানুসারেই ‘খুলনা’ নামের উৎপত্তি বলে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে৷

সেকালে ডিঙ্গার সাহায্যে আন্তঃরাজ্য ও বৈদেশিক বাণিজ্য যথেষ্ট প্রসার লাভ করেছিল৷ চাঁদসাগর ও ধনপতি সওদাগররা ছিলেন সেকালের টাটা-বিড়লা৷ তাঁদের বানিজ্য-তরী যেত না---হেন জায়গা নেই৷ ধনপতি দক্ষিণবঙ্গে বাণিজ্য করতে এসে নয়াবাদে তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীর স্মৃতি রক্ষার্থে ভৈরবের দক্ষিণকূলে খুল্লনেশ্বরী নামে একটি চণ্ডীদেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন৷ খুল্লনার দ্বারাই বণিককুলে প্রথম চণ্ডীদেবীর মাহাত্ম্য প্রচারিত হয়৷ তাই খুল্লনেশ্বরীর নাম থেকে ‘খুলনা’ নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে অনেকে অনুমান করেন৷

ভাষাবিদ শ্রীযুক্ত সুকুমার সেন মহাশয় ‘খুলনা’ নামের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করেছেন এই ভাবে খুল্লনাবা অর্থাৎ ক্ষুদ্র নৌকা (যেখানে ছোট ছোট নৌকা ভাসে?)৷ এ অনুমান অসঙ্গত নয়৷ কারণ নদীতে ব্যবসায়ীরা সেকালে বাণিজ্য-সম্ভার সাজিয়ে চুটিয়ে বাণিজ্য করতেন৷ খুলনা জেলার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর৷ পূর্ব-দক্ষিণ কোণে মধুমতী, গৌরী, কুমার, ইচ্ছামতী, যমুনা ও কালিন্দী নদী৷ অতএব সওদাগরের বাণিজ্য-তরী খুলনা নৌকার সমারোহ জেনে দেখেই এই জেলার নাম খুলনা হওয়া অস্বাভাবিক কিছু  কিছু নয়৷