নারী ও পুরুষ---উভয়েই একই পরম পিতার সন্তান৷ উভয়েই যেহেতু পরম পিতার সন্তান জীবনের অভিব্যক্তি ও স্বাধিকারের ক্ষেত্রে উভয়েরই সমান অধিকার৷ অস্তিত্ব মানে কেবল বেঁচে থাকাই নয়৷ পশুরাও তো ৰেঁচে থাকে! কিন্তু আমাদের কাছে জীবনের তাৎপর্য অনেক---অনেক ৰেশী৷
আমাদের কাছে জীবন হ’ল একটা মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে জীবনধারণ৷ শারীরিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের সমস্ত সম্ভাবনা বিকাশের যে স্বাধীনতা তা অর্জনের প্রয়াসের মধ্যেই নিহিত রয়েছে জীবনের তাৎপর্য৷ কেবল ভালমন্দ কোন কিছু করার ছাড়পত্রকে প্রকৃত স্বাধীনতা ৰলে না৷
মানব-ইতিহাসে আমরা দেখেছি, নারীরা কেবল নারীত্বকে গৌরবান্বিত করেনি, সমস্ত মানবজাতিকে গৌরবান্বিত করেছে৷ দর্শনে, আধ্যাত্মিকতায়, সমাজ-সংস্কারে, শিক্ষার ক্ষেত্রে, বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে---কোথাও নারীরা পুরুষের চেয়ে পেছিয়ে নেই৷ জটিল দার্শনিক তত্ত্বের সমাধানই হোক বা সামাজিক-শিক্ষানৈতিক সংস্কারই হোক সৰক্ষেত্রেই মেয়েরা পুরুষের মতই সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করছে৷ বিপদে আপদে পুরুষকে প্রেরণা জোগাতেও নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য৷
পুরুষের মতই নারীর মধ্যেও প্রভূত সম্ভাবনা লুকিয়ে রয়েছে৷ নারী ও পুরুষের মধ্যে প্রকৃতিগত ও দেহ সংরচনাগত বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে পার্থক্য সম-মৈত্রী-ভিত্তিক সহযোগিতাকেই (co-ordinated co-operation) প্রশস্ত করে, উভয়ের মধ্যে প্রভু-ভৃত্য-সম্পর্ক-সুলভ সহযোগিতা (sub-ordinated co-operation) মোটেই সমর্থনযোগ্য নয়৷
কিন্তু ইতিহাসের ধারা প্রবাহে আমরা দেখেছি, সারা পৃথিবী জুড়ে নারীদের ওপর শোষণের মর্মান্তিক চিত্র৷ শোষণের এই দুরভিসন্ধি থেকেই সৃষ্টি হয়েছে যুগে যুগে নানান ভাবজড়তা(dogma) আর এগুলোর সাহায্যেই চালিয়ে যাওয়া হয়েছে মানস-অর্থনৈতিক শোষণ (psycho-economic exploitation). এই সৰ ভাবজড়তাকে সুকৌশলে জনপ্রিয় করে’ তুলে ও নারীদের মনেও অনুপ্রবেশ করিয়ে দিয়ে তাদের দাসত্বের নিগড়ে আৰদ্ধ করা হয়েছে৷ বিভিন্ন ধর্মানুষ্ঠানের অনেক কিছু প্রতীক প্রকৃতপক্ষে দাসত্বের প্রতীক ছাড়া অন্য কিছু নয়৷ পৃথিবীর ৰহু ধর্মমতেই নারী-পুরোহিতও স্বীকৃত নয়৷
নারীদের ওপর শোষণ সর্বত্রই কমৰেশী একই প্রকার৷ এটা কি সত্য নয় যে অনেক দেশে এমনকি বোটাধিকারের ক্ষেত্রেও নারী-পুরুষের সমানাধিকার স্বীকৃত ছিল না?
আজও পুরুষ-শাসিত সমাজ-ব্যবস্থায় নারীর স্থান প্রায় দাসীর মতই, এটা কেবল মন্দই নয়, এটা নিন্দনীয়ও৷ নারীদের ওপর এ ধরণের অবদমন ও ভাব-জড়তার সাহায্যে তাদের ওপর এ ধরণের মানস-অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার জানানো উচিত৷ এই ভাবজড়তার বিলোপের জন্যে ও মানসিক শোষণের কৰল থেকে নারী ও নারীত্বকে মুক্ত করতে যা চাই তা হ’ল ঃ
(১) বিশ্বের সমস্ত দেশে সমস্ত নারীর জন্যে অবৈতনিক শিক্ষা
(২) সামাজিক, শিক্ষাগত ও ধর্মমতের ক্ষেত্রে সর্বপ্রকার বৈষম্যের অবসান
(৩) সমস্ত নারীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা৷
আমরা, বিশেষ করে নারীদের মধ্যে সৃষ্টি করতে চাই এক বলিষ্ঠ, গতিশীল ও বৈপ্লবিক সমাজ-চেতনা৷ নারীরা নবপ্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে সর্বপ্রকার দাসত্বের প্রতীক ও ভাবজড়তাগুলোকে নিশ্চিহ্ণ করতে উঠে পড়ে লেগে যাক্৷ আমরা চাই, নারীরা সম-মৈত্রীভিত্তিক সহযোগিতার নূতন যুগের সূচনা করুক৷ আজকের নারী-জাতি হোক নূতন বিপ্লবের অগ্রদূত৷ গৌবোজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্যে মানবতার এই অভ্যুত্থান অত্যাৰশ্যক৷ কলিকাতা এপ্রিল, ১৯৮১