নব্যমানবতাবাদই শেষ আশ্রয়

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

নব্যমানবতাবাদ কী? নব্যমানবতাবাদ তত্ত্বের প্রবক্তা মহান দার্শনিক শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর রচিত ‘প্রভাত সঙ্গীতের’ ভাষায় বলেছেন---

        ‘‘ মানুষ যেন মানুষের তরে সব কিছু করে যায়৷

  একথাও যেন মনে রাখে পশু-পাখী তার পর নয়

        তরুও বাঁচিতে চায়৷’’

---সমস্ত মানুষ, পশুপক্ষী-তরুলতাসবাইকে ভালবাসাই নব্যমানবতবাদের সারকথা৷ মানুষের অবশ্যিক গুণ হ’ল---তার মানবতা তথা মানবিকতা ৷ অথচ বাস্তবে দেখছি, আজকের মানুষের মধ্যে এই মানবতাবোধ তথা মানবিকতাবোধের দারুণ অভাব৷ প্রকৃতি মা এককোষী জীব থেকে নানান অনুুন্নত ও পরে উন্নত জীবের সৃষ্টি করতে করতে সবশেষে  মানুষ সৃষ্টি করেছেন৷ মানুষকে সযত্নে দিয়েছেন সবচেয়ে বেশী বুদ্ধি, দিয়েছেন উন্নত মনীষা৷ সমগ্র সৃষ্টিতে তাই বড় ভাইয়ের মত মানুষের কর্তব্য জীবজগৎকে---অন্যান্য অনুন্নত জীবকে রক্ষা করা৷ সৌরজগতের একমাত্র পৃথিবীতেই প্রাণের বিকাশ হয়েছে৷ প্রাণের সন্ধানে বিজ্ঞানীরা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তোলপাড় করে তুলছেন৷ কিন্তু পৃথিবী ছাড়া আর কোথাও এখনও পর্যন্ত প্রাণের সন্ধান পাচ্ছেন না৷ সৌরজগতের একমাত্র পৃথিবীতেই প্রাণের বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ আছে৷ তাই এই পরিবেশের বিশুদ্ধতা রক্ষা করা এই পৃথিবীর অভিভবাক হিসেবে মানুষের অবশ্যিক কর্তব্য৷কিন্তু-মানুষ এই পরিবেশকে ভালবেসে রক্ষা করার পরিবর্তে দানবের মত ধবংস করে চলেছে৷ এমনি ভাবে মানুষ তো নিজের পায়ে কুড়ুল মারছে!

বৈজ্ঞানিক নিউটনের তৃতীয় সূত্রে বলা হয়েছে প্রতিটি ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে৷ বস্তু জগতের ক্ষেত্রে এটা যেমন সত্য, মানসিক জগতের ক্ষেত্রেও এটা সত্য৷ বিশ্বপ্রকৃতির ক্ষেত্রেও এটা সত্য৷ মানুষের বিবেকহীন কর্মের প্রতিক্রিয়া, মানবতা তথা মানবিকতাকে অগ্রাহ্য করে হিংসা, দ্বেষ নিষ্ঠুরতার প্রকাশের বিরূপ প্রতিক্রিয়া থাকতে বাধ্য৷

পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট জনিত প্রাকৃতিক বিপর্যয়, আবহাওয়ার উষ্ণতাবৃদ্ধি, বিভিন্ন সময়ে নানান ধরনের বাইরাস জনিত বা সাইকো-সোমেটিক দুরারোগ্য ব্যাধি---এ সমস্তকিছুর জন্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে দায়ী মানুষই৷ বর্তমানে করোনা বাইরাস ঘটিত কভিড-১৯ এর জন্যেও দায়ী মানুষই- মানুষের নির্দয় নিষ্ঠুর প্রকৃতি-বিরুদ্ধ ক্রিয়া-কান্ড৷

এর আগে পর্যন্ত ইতিহাসে যতগুলি মহামারি সৃষ্টিকারী বাইরাস দেখা গেছে এদের প্রায় সবগুলি সৃষ্ট হয়েছে নিহত প্রাণীদেহ থেকে৷ বিভিন্ন তথ্যে প্রকাশ, করোনা বাইরাসের সৃষ্টি চীনের উহান শহরে মাংসের বাজারে৷ যদিও মতান্তরে এও বলা হচ্ছে, চীন সরকার প্রতিপক্ষ শক্তিকে পর্যুদস্ত করার জন্যে তাদের ল্যাবোরেটারিতে এই মারণ বাইরাসের সৃষ্টি করেছে৷ কারণ যেটাই হোক না কেন মানুষের মানবতা বিরোধী কর্মকান্ড থেকেই যে এই ক্ষুদে দানবের সৃষ্টি তাতে কোন সন্দেহ নেই ৷

পূর্বেই বলা হয়েছে, মানুষ যেমন সমস্ত মানুষকে ভালোবাসবে, আপন করে দেখবে, তেমনি এই সৃষ্ট জগতের অভিভাবক হিসেবে অন্যান্য অনুন্নত জীবদেরও রক্ষণাবেক্ষণ করবে৷ এও বলা হয়েছে, মানুষ এই বিশ্ব পরিবারে বড় ভাইয়ের মতোই৷ এটা ভুললে চলবে না৷ মানুষ মানুষকে তো ভালবাসবেই, শুধু তাই নয় তার মানবতার মাধুর্যকে--- ভালবাসা, দয়া, মায়া এ সবকে কেবল মানুষের সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে না রেখে অন্যান্য প্রাণী ও তরুলতাতেও ছড়িয়ে দেবে৷ এটাই তার কর্ত্যব্য৷ মাবতাবাদের এই ব্যাখাকেই মহান দার্শনিক শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন---নব্যমানবতবাদ৷

আর মানুষ যে মানুষকে আপন করে ভাববে, সবাইকে ভালোবাসবে, সমস্ত জীবকে ভালোবাসবে, বিশ্বপ্রকৃতিকেও ভালোবাসবে, এটা যাতে শুধু ক্ষণস্থায়ী সেন্টিমেন্ট মাত্র না হয়, মনে স্থায়ীভাবে জাগ্রত থাকে, তার জন্যে দরকার এর পেছনে অফুরন্ত প্রেরণার উৎস৷ সেটা কি ? সেটা হ’ল গভীর অধ্যাত্মিক চেতনা৷ সমস্ত বিশ্বব্রহ্মান্ড যে একই ভূমাচৈতন্যের প্রক্ষেপ---সবার মধ্যে যে একই আত্মা বিরাজিত---প্রাত্যহিক অনুশীলনের মাধ্যমে মনের মধ্যে এই চেতনাকে সদাজাগ্রত রাখতে হবে৷ তবেই মানুষ নব্যমানবতাবাদে প্রতিষ্ঠিত হবে৷ আর এই নব্যমানবতাবাদই আজকের মানুষের একমাত্র আশ্রয়---সমস্ত হতাশার আশ্বাস৷

নব্যমানবতাবাদের বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ের ওপর বর্তমানে বিশেষ করে আমাদের নজর দিতে হবে৷ যেমন---

(১) মানুষের মধ্যে জাত-পাত-সম্প্রদায় ভেদ মানা চলবে না৷ নব্যমানবতাবাদের প্রবক্তা দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেছেন, ‘’মানব সমাজ এক ও অবিভাজ্য’’, ধর্মের সাথে জাত-পাত সম্প্রদায়ভেদ মানার পেছনে কোনো যৌক্তিকতাই থাকতে পারে না৷  ঈশ্বর এক এটা সবাই মানে৷ এক ঈশ্বরের সন্তনদের মধ্যে তাই জাতি বা সম্প্রদায় ভেদ-হয় কী করে ? যারা জাত-পাত সম্প্রদায়ভেদ মানে, বুঝতে হবে, তারা পরমপিতা ঈশ্বরকেই মানে না৷ কারণ এক পিতার সন্তনদের মধ্যে ভিন্ন জাত বা ভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রশ্ণই ওঠে না৷

(২) যাঁরা আবার ঈশ্বর মানেন না অথবা বিশ্বভ্রাতৃত্বের কথা বলেন, তাঁদের চিন্তায় ও কথায় ও কাজে অনেক ফারাক৷ পিতাকে না মানলে ভ্রাতৃত্ব আসে কোথা থেকে?

(৩) গাছপালা প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ৷ গাছপালা খাদ্য দিয়ে, অক্সজেন দিয়ে, অজস্রভাবে মানুষ  কে সাহায্যে করে৷ তাই যথেচ্ছভাবে বনজঙ্গল নষ্ট করা বন্ধ করতে হবে৷ একটি গাছ,কেবল একটি প্রাণ নয়, অনেক প্রাণের সমান৷ তাই অবিবেকীর মত বৃক্ষচ্ছেদন বন্ধ করতে হবে৷ গাছপালাকে ভালবাসতে হবে৷ ব্যাপকভাবে বৃক্ষরোপণের জন্যে উদ্যোগ নিতে হবে৷

(৪) খাদ্য-নির্বাচনের ক্ষেত্রে মানুষকে সতর্ক হতে হবে৷ খাদ্য মানুষের দেহকোষ তৈরী করে৷ তাই গলিত দুর্গন্ধযুক্ত খাদ্য বা জৈব বস্তু থেকে অথবা হীন-বৃত্তি- প্রবল পশুমাংসকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করলে তা থেকে যে দেহকোষ তৈরী হবে, তাতে মানুষের হীন-বৃত্তিগুলির প্রাবল্য হওয়া স্বাভাবিক৷ তাই মানুষের নিরামিষ ও সাত্ত্বিক খাদ্য আহার্য্য হিসেবে গ্রহণ করা কর্তব্য৷খাদ্যনীতি সম্পর্কে-নব্যমানবতাবাদের প্রবক্তার বক্তব্য, খাদ্য নির্বাচন যতদূর সম্ভব অবিকশিত-চৈতন্যশীল জীবের মধ্য থেকেই  করৈ উচিত৷ অর্থাৎ দানাশস্য, শাক-সব্জী,ফল-মূল প্রভৃতি নিরামিষ ও সাত্ত্বিক খাদ্যই গ্রহণ করা উচিত৷

অনেকে মনে করেন, আমিষ না খেলে শরীরের বুঝি  প্রয়োজনীয় পুষ্টি আসে না, বুদ্ধির বিকাশ হয় না, কারণ নিরামিষ খাদ্যে নাকি প্রয়োজনীয় প্রোটিন পাওয়া যায় না৷ তারা জেনে রাখুন, তাঁদের এ ধারণা একেবাে ভুল৷ মাংসে যেখানে ১৮-২ % প্রোটিন থাকে, সেখানে সোয়াবিন গুঁড়োয় ৪'% প্রোটিন অন্যান ডাল ও শুঁটি জাতীয় খাদ্যও প্রোটিন সমৃদ্ধ৷

সাত্ত্বিক ও নিরামিষ ভোজীদের শরীরে রোগ প্রতিষেধক শক্তিও অনেক বেশি৷ তার সঙ্গে দৈনিক যোগোভ্যাস করলে রোগ প্রতিরোধক শক্তি প্রচণ্ড রকমের বৃদ্ধি পায়৷

তাছাড়া প্রকৃতির নিয়মে যারা মাংসাশী জীব তাদের শিকার ধরে খাবার জন্যে ধারাল বাঁকা নখ ও মাংস টেনে ছেঁড়ার জন্যে মুখের ভেতর ছুঁচলো দাঁত (Canine teeth ) থাকে৷ কিন্তু মানুষের এর কোনোটিই নেই৷ অপরপক্ষে যারা নিরামিষাশী তাদের খাদ্যকে চিবানোর জন্যে পেষক দন্ত বা মাড়ির দাঁত থাকে৷ মানুষের তা আছে৷ নিরামিষাশী জীবরে মতই মানুষের পরিপাক যন্ত্র, সুদীর্ঘ-অন্ত্র (শরীরের বারোগুণ) (মাংসাশী প্রাণীর ক্ষেত্রে শরীরের মাত্র তিন গুণ)--- এ সবই প্রমাণ করে মানুষ প্রকৃতিনির্দিষ্ট নিরামিষাশী প্রাণী৷ লালাসার বশবর্তী হয়ে প্রকৃতির বিরুদ্ধে গেলে প্রকৃতির কোপে পড়াতেই হবে৷ প্রকৃতির স্নেহময় কোলে মানুষ লালিত-পালিত৷ মানুষ, পশু-পক্ষী, তরুলতা ---এ তিনের ‘প্রমা’ বা সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যের মধ্যেই রয়েছে জগতের হিত৷ তেমনি মাটি, জল, বাতাস---এঁদের বিশ্বদ্ধতার মধ্যে ‘প্রমা’র(ভারসাম্যর) প্রকাশ৷ মানুষের শরীর, মন, ও আত্মার বিকাশের ক্ষেত্রেও ‘প্রমা’ বা পরিপূর্ণ সামজ্ঞস্য জরুরী৷ এই সব নিয়েই সামগ্রিক ভাবে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষিত হয়, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষতি হয়, ও দূষণমুক্তি ঘটে৷ মানুষকে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে৷ না হলে সমাজের সমূহ বিনষ্টি! মানুষ যেন অবিলম্বে সতর্ক-হয় ৷  বিবেকের দ্বারা পরিচালিত হয়ে বিশ্বের সামগ্রিক ‘প্রমা’ রক্ষায় সচেষ্ট হয়৷ এতেই মানুষের সামূহিক কল্যান৷

এটাই দিশাহীন মানুষের কাছে নব্যমানবতাবাদের বার্তা৷