সমাজ–চক্রের পরিঘূর্ণনে, একটা বিশেষ যুগে তার পরবর্ত্তী যুগ আসার আগে একটা বিশেষ শ্রেণীর আধিপত্য থাকে, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে৷ এই বিশেষ শ্রেণী যখন রাজনৈতিক ক্ষমতায় থাকে, তাদের দ্বারা সমাজে শোষণ চলার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যায়৷ ইতিহাসের শিক্ষা এই যে, শোষণের সম্ভাবনাই শুধু নয়, যুগে যুগে এই শোষণের পুনরাবির্ভাব ঘটেছে৷
একেকটি যুগে একেকটি বর্ণ (শ্রেণী) শাসকের ও শোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়৷ যে মুহূর্তে একটি শ্রেণী শোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, সেই মুহূর্ত থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠের জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিসহ৷ সংখ্যাগরিষ্ঠের দুর্ভোগের বিনিময়ে কতিপয় মানুষ সুখের স্বর্গে বিচরণ করতে থাকে৷ শুধু তাই নয়, সমাজে যখন এই ধরণের শোষণ চলতে থাকে, তখন কতিপয় শোষক আর সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিত–উভয়েরই অধঃপতন ঘটে৷ কতিপয় শোষকের অধঃপতন ঘটে–কারণ তারা অত্যধিক জাগতিক ভোগ–সুখে নিমজ্জিত হয়৷ আর যেহেতু জাগতিক সমস্যা সমাধানের জন্যেই সংখ্যাগরিষ্ঠের সমস্ত কর্মশক্তি ব্যয়িত হয়ে যায়, সেহেতু তারা নিজেদের উত্তরণ ঘটাতে পারে না৷ মানস–ভৌতিক(psycho-physical) সমান্তরালতা রবায় সদা নিয়োজিত থাকায় তাদের মানসিক তরঙ্গ দিনে দিনে স্থূলতর হয়ে যায়৷ এই কারণেই শাসক ও শাসিত উভয় পক্ষেরই জাগতিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি বিধান করতে হলে কাউকেই সমাজের অন্যদের ওপর শোষণ করার কোন রকম সুযোগ দেওয়া চলবে না৷
ক্ষত্রিয়ের ওপর সমাজের ভার ছেড়ে দিতে পারা যায় না, কারণ সে ক্ষত্রিয়–রাজ্রত্ব কায়েম করতে চাইবে–অক্ষিত্রয়কে শোষণ করবে, দুর্বলকে চিবিয়ে খাবে৷ বিপ্রের ওপর সমাজের ভার ছেড়ে দেওয়া যায় না, কারণ সে বিপ্র রাজত্ব কায়েম করতে চাইবে–অবিপ্রকে শোষণ করবে, বুদ্ধিহীনকে চিবিয়ে খাবে৷ বৈশ্যের হাতেও সমাজের ভার ছেড়ে দেওয়া যায় না, কারণ তারা বৈশ্য রাজ্রত্ব কায়েম করতে চাইবে– অবৈশ্যকে শোষণ করবে, মেহন্নতি মানুষকে চিবিয়ে খাবে৷ শূদ্র সমাজের নেতৃরত্ব নিতে পারে না৷ তাই কোনো বর্ণবিশেষের (শ্রেণীবিশেষের) রাজত্ব চলতে দেওয়া কিছুতেই উচিত নয়৷
সমাজে কারোরই প্রাধান্য থাকা উচিত নয়৷ একের প্রাধান্য থাকলে বাকীদের ওপর শোষণ চলবেই৷
যারা মুখে বড় বড় আদর্শের বুলি কপ্চে বেড়াচ্ছে, বত্তৃণতা–মঞ্চে দাঁড়িয়ে জনসাধারণকে পথ নির্দেশনা দেবার অভিনয় করছে, অথচ মনের ভেতরে ক্ষুদ্র স্বার্থের কীটগুলোকে সযত্নে পুষে রেখেছে তারা যে কোন দুর্বল মুহূর্ত্তে জনসাধারণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে’ ফেলবে, অন্ততঃ করাটাই তাদের পক্ষে স্বাভাবিক কাজ হবে৷ নিজেকে তৈরী করবার সাধনায় না নেবে যারা কল্যাণধর্মী সমাজ গড়তে চায়, অধঃপতনটা যে কেবল তাদেরই হবে তা নয়, তারা গোটা মানুষ জাতটাকে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে যাদের নিয়ে তাদের কাজ সেই মানুষকে তারা মনে–প্রাণে বিশ্বাস করতে পারবে না৷ গোড়ার দিকে নেতৃত্ব লাভের জন্যে হয়তো নিজেরা কিছুটা যোগ্যতা অর্জনের চেষ্টা করবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেদের যোগ্যতা অর্জনের চাইতে অন্যকে অঙ্গুলিহেলনে পরিচালনা করাটাই জীবনের সারবস্তু হয়ে দাঁড়াবে৷ ব্যষ্টিপ্রাধান্য বা দল প্রাধান্যের মতলব নিয়ে মানুষজাতকে নিজেদের যন্ত্র হিসেবে বেশী দিন ধরে’ ব্যবহার করা যে সম্ভব নয়, ও অবদমিত গণমানস যে একদিন না একদিন মাথা চাড়া দিয়ে উঠবেই একথাটা ঠেকে শেখার সঙ্গে সঙ্গে মানুষকে দাবিয়ে রাখবার একটা অপচেষ্টা তাদের মধ্যে নিশ্চয়ই জাগবে৷ মানুষের মন অবদমিত হয়ে থাকতে চায় না, তাই তাদের মন স্ফূরণের পথ খুঁজতে চাইবে৷ ব্যষ্টি বা দলগত স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ যতই মাথা তুলতে চাইবে স্বৈরতন্ত্রীরাও তত শক্তি–সম্প্রয়োগ করবে, ও এর ফলে তাদের মধ্যে শেষ পর্যন্ত যোগ্যতা অর্জনের চেষ্টা কিছুমাত্র থাকবে না, থাকবে শুধু শক্তি–র্জনের প্রয়াস৷ যারা একদিন কল্যাণকৃৎ হিসেবে কাজে নেবেছিল তারাই শেষ পর্যন্ত জড়শক্তিসর্বস্ব হয়ে দাঁড়াবে৷ কোন মানব–গোষ্ঠীর বৃহৎ অংশ জড়শক্তিকে বেশী প্রাধান্য দিয়ে ফেললে শেষ পর্যন্ত সবাই স্ব–স্বপ্রধান হয়ে দাঁড়াবে, নীতিজ্ঞানের বিন্দুমাত্র অবশেষ থাকবে না৷ সমাজে দারুণ মাৎস্যন্যায় দেখা দেবে৷
বৃহতের ভাবনা যেখানে নেই, উদার ও অসাম্প্রদায়িক ভাবে সর্বগ–বুদ্ধি ব্রহ্মকে যে একমাত্র ধ্যেয় হিসেবে নিতে শেখেনি কোনও প্রকার কাজে হাত লাগাবার প্রয়াস তার পক্ষে একেবারেই অর্থহীন৷ কারণ একথা ধ্রুব সত্য যে, সে নিজের ও সমাজের চরম ক্ষতি করে’ দিয়ে শেষ পর্যন্ত যবনিকার অন্তরালে সরে’ যেতে বাধ্য হবে৷
তাই সমাজ নিয়ন্ত্রণের ভার শারীর–শক্তিপ্রধান ব্যাষ্টিদের হাতে থাকা উচিত নয়, সাহস–প্রধান ব্যষ্টিদের হাতেও থাকা উচিত নয়, বিষয়–বুদ্ধিপ্রধান ব্যষ্টিদের হাতেও থাকা উচিত নয়–থাকা উচিত তাদের হাতে যারা একাধারে আধ্যাত্মিক সাধক, বুদ্ধিমান ও সাহসী৷
সদ্বিপ্রের নেতৃত্ব ঃ সর্ববর্ণের জয়
সদ্বিপ্ররা একাধারে বিপ্র, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র তাই তাদের অধিনায়কত্বের অর্থ হ’ল সর্ববর্ণের জয়৷ যথাবিধি ক্ষত্রিয়, বিপ্র, বৈশ্যের অভ্যুত্থান হবে, কিন্তু সদ্বিপ্রের অধিনায়কত্ব থাকলে ওই অভ্যুত্থানের ফলে তারা সমাজ জীবনে কিছুটা প্রাধান্য লাভ করলেও কোনো কালেই সর্বময় কর্তা হয়ে বসতে পারবে না৷
সদ্বিপ্র ঃ সংজ্ঞা
যম নিয়মে প্রতিষ্ঠিত হয়ে, সুসংবদ্ধ চিন্তাধারা ও সুপরিকল্পিত কার্য–প্রণালীর ভিত্তিতে মানবজাতির দৈহিক, মানসিক উত্তরণের জন্যে যাঁরা সর্বদা সচেষ্ট, সেই সব আধ্যাত্মিক বিপ্লবীরাই হচ্ছেন ‘সদ্বিপ্র’৷ তাঁরাই হচ্ছেন সদ্বিপ্র যাঁদের পরমলক্ষ্য কেবল আনন্দপ্রাপ্তি৷ তাঁরা অস্তি সম্পর্কে সচেতন ও তাঁদের মধ্যে ভাতির ছয়টি তত্ত্বের উপস্থিতি রয়েছে৷ তাঁরা নৈতিকতায় শক্তিশালী অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সব সময়েই প্রস্তুত৷ সদ্বিপ্রগণ অনৈতিকতা ও অন্যায়জনক প্রবণতার বিরুদ্ধে আপোষহীন ও বিশ্রামহীন সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন৷
সদ্বিপ্রদের কর্তব্য
নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী এই সদ্বিপ্রদের সমাজের প্রতি মৌলিক ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কর্ত্তব্য সম্পাদন করতে হবে৷ সদাবিপ্রদের কর্ত্তব্য হবে, সমাজে যে শ্রেণীর আধিপত্য থাকবে, সেই শ্রেণী যেন শোষণ করার সুযোগ না পায় তা দেখা৷
প্রাধান্যবশতঃ ক্ষত্রিয় যুগে ক্ষত্রিয় যদি শাসকের ভূমিকা থেকে শোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, বিপ্রযুগে বিপ্র যদি শোষকের ভূমিকা গ্রহণ করে, অথবা বৈশ্য যুগে বৈশ্য যদি শোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, সেক্ষেত্রে শক্তি সম্প্রয়োগের দ্বারা সৎ ও শোষিত জনগণকে রবা করা, তথা অসৎ ও শোষকগণকে দমন করা সদ্বিপ্রদের ধর্ম৷
সদ্বিপ্র নিষ্ক্রিয় সাক্ষীগোপাল নয়৷ কোন ব্যষ্টি অথবা শ্রেণী যাতে অন্যদের ওপর শোষণ করতে না পারে সেজন্য সদাবিপ্ররা থাকবে সদা কর্মতৎপর৷ এই কারণে সদ্বিপ্রদের হয়তো স্থূল শক্তি–সম্প্রয়োগও করতে হতে পারে, কারণ তাদের লড়তে হবে সেই শক্তি–কেন্দ্রর বিরুদ্ধে যারা শোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চলেছে৷
একের পর একটা যুগ আসতেই থাকবে৷ সদ্বিপ্র তা আটকাতে পারবে না৷ তবে বিপ্লবোত্তর বাত্রযুগের প্রতিষ্ঠার পরে তার সতর্ক দৃষ্টি থাকবে যেন ক্ষত্রিয় সমাজের প্রতিভু হিসেবে কেবলমাত্র শাসনই করে যায়–শোষকের ভূমিকায় নামতে না পারে৷ শোষকের ভূমিকায় নামবার উপক্রম করলেই সঙ্গে সঙ্গে প্রতিশ্লেষণ সৃষ্টি করে’ বাত্রযুগের অবসান সে ঘটাবে৷ অনুরূপ ব্যবহার সে বিপ্রযুগ ও বৈশ্যযুগ সম্বন্ধেও করবে৷
সদ্বিপ্ররা সমস্ত দেশে সবসময়ে কোনো বিশেষ তত্ত্বের এ্যাণ্ঢিথীসিস তৈরী হওয়া পর্যন্ত অপেবা করবে৷ যতদিন পর্যন্ত না এ্যাণ্ঢিথীসিস তৈরী হয়, ততদিন সদ্বিপ্রের দল পরবর্তী অধ্যায়ে এ্যাণ্ঢিথীসিস তৈরী করবার জন্যে পৃথিবী ব্যাপী এক মনস্তাত্ত্বিক পটভূমিকা তৈরী করবে৷ যে মুহূর্ত্তে সংশ্লেষণের (সিন্থীসিসের) পুণ্য ঊষা নেমে আসবে সেই মূহূর্ত্তেই সদ্বিপ্ররা সমাজের নেতৃত্ব নিজের হাতে গ্রহণ করবে৷
সদ্বিপ্রের দল প্রচলিত বর্বরতা, অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মনোবৃত্তিকে উৎসাহিত করে’ তুলবে, ও এই সংগ্রামের গতিকে বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করবে৷ তারপর সীনথীসিস–এর অবস্থায় তারা নিজেদের হাতে সমাজের নেতৃত্ব গ্রহণ করবে৷ দেশ–কাল–পাত্রের সঙ্গে সঙ্গতি(adjustment) রাখতে সদ্বিপ্র–প্রবর্তিত এই সংশ্লেষাণাত্মক যুগ চিরস্থায়ী হতে পারে৷ সমাজ এই সমস্ত সদ্বিপ্রের দ্বারা শাসিত ও পরিচালিত হবে৷ সমাজের সংশ্লেষণাত্মক কাঠামো বর্ত্তমান থাকবে, যদিও বিভিন্ন যুগ আসবে–যাবে৷
প্রয়োগভৌমিক সিদ্ধান্ত
সমাজচক্রের পরিঘূর্ণন কেউই বন্ধ করতে পারবে না, সদ্বিপ্ররাও পারবে না৷ সদ্বিপ্ররা সমাজচক্রের চক্রনাভিতে অধিষ্ঠিত থেকে ঘূর্ণন ক্রিয়ার ওপর সজাগ ও সতর্ক দৃষ্টি রেখে চলবে৷চক্রপরিধিতে স্থান এঁদের নয়৷ কারণ এঁরা করবেন চক্রের নিয়ন্ত্রণ–এঁরা চক্রের ধুরী বা প্রাণকেন্দ্র রূপে অধিষ্ঠিত থাকবেন৷