নিছক উৎসব নয়---বাঙলার নববর্ষের দিন হোক বাঙলার মর্যাদা রক্ষার শপথের দিন

লেখক
স্নেহময় দত্ত

ঋতুচক্রের পরিক্রমণ ও বর্ষ পরিক্রমার নিয়মানুযায়ী বাঙলার ১৪২৩ সনকে পিছনে ফেলে আর মাত্র কয়েকটা দিন পরেই আসবে ১৪২৪ সন ১লা বৈশাখ, বাঙলার নববর্ষারম্ভ---বাঙলার নববর্ষের দিন বসন্তের তথা চৈতের শেষ লগ্ণ থেকেই শুরু হয় বর্ষবরণের দিন গোনা মন-প্রাণ ভরে ওঠে অনাবিল উৎসবের মেজাজে ঋতুর আবর্ত ছন্দ ---কালিক বৈচিত্র্য প্রকৃতির এক অন্যতম অবদান স্থান বিশেষে তার প্রকাশও ভিন্নতর বাঙলার বুকে বিশাখা তনয় বৈশাখ সাধারণত ভৈরব দ্যুতি নিয়েই আবির্ভুত হয় নিয়ে আসে গ্রীষ্মের দাবদাহ কখনও আনে কালবৈশাখীর ভয়াবহতা যার বর্ণনা দেওয়া যেতে পারে শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের রচিত ও সুরারোপিত প্রভাত সঙ্গীত থেকে - 

ঈশান কোণেতে মেঘ জমিয়াছে,

খরতর বায়ু বহিতেছে,

(আজি) কাল বৈশাখী আসিয়াছে

গবাক্ষ দ্বার বন্ধ করিয়া,

অশনি ধবনিতে ত্রস্ত হইয়া,

গৃহকোণে বসে সকলে এখন,

নীর নর্তন শুণিতেছে

কত প্রিয় তরু উপড়িয়া যায়,

আহত ফলেরা ঝড়ে পড়ে যায়,

ঝঞ্ঝা-গতিতে শিলাবৃষ্টিতে

নীড়হারা পাখী কাঁদিতেছে

নিদাঘের মাঝে বজ্র রূপেতে,

রুদ্র দেবতা এ কী  নাচে মাতে!

জলে থাকা তরী মহা আতঙ্কে,

ঢেউয়ের দোলায় দুলিতেছে

এইভাবেই বৈশাখ ধরার প্রতিটি অণুতে অণুতে রুদ্রঝলক ভরে দিয়ে তার ঋতু পরিচয় দিয়ে চলেছে তথাপি মাস, দিন, তিথি, বৎসর ঋতু পরিক্রমা অন্তে নতুন করে দেখা দেয় বৈশাখ---নববৎসর পুরাতনের জীর্ণতা, গ্লানি মুছে ফেলে শুদ্ধ চিত্তে মানুষ গানের সুরে বৈশাখকে বরণ করে চলে

এসো, এসো এসো, হে বৈশাখ

তাপস নিশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,

বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক

থাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি,

অশ্রু বাষ্প সুদূরে মিলাক

মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,

অগ্ণিস্নানে শুচি হোক ধরা  (রবীন্দ্রসঙ্গীত)

বৈশাখ যেমন রূপ নিয়েই আসুক না কেন, ১লা বৈশাখ নববর্ষারম্ভ---আনন্দ উৎসবের দিন---কল্যাণ ভাবনার দিন আর এই কল্যাণ ভাবনা কেবল মানুষের জন্য নয়, উদ্ভিদ, পশুপাখী সকল জীবকূলের জন্যে সেই সঙ্গে মানুষের মানুষে যে ভেদ-বিদ্বেষ, শক্তির আস্ফালন তারও চাই বিনাশ নব্যমানবতাবাদী এই চিন্তা সুন্দরভাবে অভিব্যক্ত হয়েছে ঋষি প্রভাতরঞ্জন সরকার রচিত ও সুরারোপিত প্রভাত সঙ্গীতে বলা হয়েছে---

বৎসর, নব বৎসর, তুমি কল্যাণ এনো চারিদিকে,

নূতন ভোরের হাতছানিতে নূতন ঊষার নবালোকে

বৃক্ষ-লতারা সবুজে ভরুক, বন্য পশুরা নিরাপদ হোক,

পাখীরা কণ্ঠে অমিয় ভরিয়া উড়িয়া বেড়াক দিকে দিকে

মানুষে মানুষে ভেদ দূর হোক, বুদ্ধির অপচয় রোধ হোক,

শক্তির সর্বনাশা প্রতাপ সংযত হোক সব দিকে

১লা বৈশাখ, বাঙলার নববর্ষ প্রতি বছরই দিনটি আসে, বাঙালী তার নিজের মত করে আনন্দে, আবেগে উৎসবে মেতে উঠে দিনটি পালন করে থাকে তারপর আবার হারিয়ে যায় প্রাত্যহিকতায় বাঙলার সন, তারিখের হিসাব ওই একটা দিনে তারপর আর বাঙলার সন, তারিখ নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন অনুভব করে না অবশ্য একটু বোধ হয় ভুল বলা হল, কারণ একটা বাঙলা তারিখ বাঙালীর মনে গেঁছে আছে সেটা এই বৈশাখ মাসেরই একটা দিন---২৫শে বৈশাখ করিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিনতাপর আর বাঙলার সন, তারিখের খোঁজ রাখার প্রয়োজন প্রায় কারোরই পড়ে নাঅবশ্য কোন সামাজিক অনুষ্ঠানাদির সময় বাঙলা মাস, তারিখের খোঁজ পড়ে, কিন্তু পাঁজি দেখে সময়ক্ষণ নিরীক্ষণ করা ছাড়া তারআর প্রয়োজন থাকে না

এসব কথার অবতারণা অর্থ এই নয় যে, সর্ব ভারতীয় বা আন্তর্জাতিক ভাবধারার বিরোধিতা করা প্রাত্যহীক জীবনে বা কাজকর্মে সন তারিখের হিসাব যে ভাবে চলে আসছে প্রতিটি মানুষকে যে সেইভাবে চলতে হবে---সেকথা অনস্বীকার্য আক্ষেপটা অন্যত্র

বাঙালী এখন যেভাবে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানাদি করে থাকে তাতে বাঙালীর আর সক্রিয়তা দেখা যায় না সবই প্রায় বদলে গেছে পোষাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস চিন্তাভাবনা সবেতেই এসেছে পরিবর্তন এমনকি ভাষার ক্ষেত্রেও নববর্ষের অনুষ্ঠানের অধিকাংশটাই জুড়ে থাকে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের হালখাতার অনুষ্ঠানের মধ্যে কিন্তু সেখানে ভাবধারা আমূল বদলে গেছে আগেকার আন্তরিকতার পরিবর্তে ব্যবসার প্রতিযোগিতায় নিজ নিজ বৈভব দেখাতে সকনলে  ব্যস্ত নানা আকর্ষণের মোহজালে কীভাবে পুঁজি তোলা যায় নজর সেই দিকে বাঙলা নববর্ষের দিনে সুমধুর বাঙলা গানের পরিবর্ত্তে লাউড স্পিকারের গগনভেদী আওয়াজে রমরমিয়ে বাজে চটুল হিন্দী গান বাঙালীর জীবন-মন  ধাবিত হয়ে চলেছে ভিন্ন ছন্দের ভিন্ন সুরে

এইভাবে চলতে থাকলে বাঙলা ও বাঙালীকে অনেক কিছু হারাতে হবে এমনিতেই হারিয়ে যেতে বসেছে মাধূর্যভরা বাঙলা গান, হারাচ্ছে মোদের গরব মোদের আশা---আ-মরি বাঙলা ভাষা

বিদগ্দ সমাজ রবীন্দ্রসঙ্গীত, দ্বিজেন্দ্রগীতি, অতুলপ্রসাদ, নজরুলগীতি, রজনীকান্ত সেনের গানের প্রতি আধুনিক যুগ মানসের আকর্ষণ নেই বললেই চলে আধুনিক রচনায় বাঙলা গানের সেই ঐতিহ্য, ভাষার সেই মাধূর্য, ব্যঞ্জনা, গানের ভাব আর পাওয়া যাচ্ছে না সাহিত্য-সংসৃকতির উৎকৃষ্ট ভাবের পরিবর্তে বাণিজ্যিক প্রয়োজনে চটুল হিন্দী গানের অনুকরণে এমন সব গান রচিত হচ্ছে যা একেবারেই নিম্নগামী এ ধরণের গান যুব মানসকে বিপথগামী করছে, কলুষিত করছে, শিশুমন ব্যাপক অবক্ষয় ডেকে আনছে সমাজের

বাংলা ভাষার ব্যবহারের ক্ষেত্রেও আধুনিক বাঙালী সমাজের অনীহা নিজ নিজ সন্তানদের মুখের মা ডাকের পরিবর্তে মাম্মী ডাক শেখাতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে আধুনিকা মায়েরা তেমনি বাবাকে ড্যাডি বা ড্যাড কাকা-কাকিমা, মামা-মামি, মেসো-মাসিদের আঙ্কল, আণ্টি, ঠাকুমা-দিদিমাকে গ্র্যানি ইত্যাদি ডাক হামেশাই শুণতে পাওয়া যায় যেমন দেখা যায়, শোণা যায়, দূরদর্শনের সিরিয়াল অনুষ্ঠানে, তেমনই মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে অনেক মা-বাবাই এতে বেশ গর্ব বোধ করে এছাড়াও বাঙালী প্রাত্যহিক জীবনে প্রয়োজনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাঙলা শব্দের এমন এমন অপপ্রয়োগ হচ্ছে যা সাহিত্যের কথা নয় যেমন লোড নেওয়া যা ব্যবহার হয় টেনশন অর্থে, তেমনই দারুণ বলতে চলছে ঝিনচ্যাক্ বা ঝক্কাস ফাঁসানো ---কেস খাওয়া, দুর্নীতি---ঘাপলা, হতাশ শব্দের ফাষ্টু, অভিমান--- সেণ্টি ইত্যাদি নানা ধরণের শব্দ যা বাঙলা অভিধানে শব্দ ভাণ্ডারে খঁুজেও পাওয়া যাবে না এসব শব্দ আধুনিক যুব-সমাজর    নিজেদের সৃষ্ট মনোভাবাপন্ন যুবসমাজের প্রচলিত শব্দ

ভাষা হল জননী সমা, সেই ভাষা জননীর অমর্যাদার ফল সুদূরপ্রসারী এ ধরণের প্রবণতা শব্দের এহেন প্রয়োগ বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে শব্দ দূষণ এইভাবে দূষণ বাড়তে থাকলে বাঙলার শব্দ ভাণ্ডার কমে যাবে---ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলা ভাষা---ধীরে ধীরে অবক্ষয়ের পথে তলিয়ে যাবে সমগ্র বাঙালী জনগোষ্ঠী

এই বাঙলাকে, বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছেন ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র, ঈশ্বরচন্দ্র, মাইকেল মধুসুন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন, নজরুল ইসলাম সহ আরও কত কবি-সাহিত্যিক বাঙলাকে বিশ্বের দরবারে বিশেষ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, স্বামী বিবেকানন্দৃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ন্যায় মনীষীবৃন্দত্যাগে-শৌর্যে-বীর্যে- সাহসিকতায় সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে বাঙালীকে বীর জাতির গৌরবে অধিষ্ঠিত করেছেন ঋষি অরবিন্দ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, রাসবিহারী বসু, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর ন্যায় মহান বিপ্লবীরা অত্যন্ত অনুতাপের বিষয় যে সেই বাঙালী জাতীয় আজ অনুকরণতিপ্রিয়তায়্ মত্ত ভুলতে বসেছে মনীষীদের জীবন কথা বাঙলার গৌরবময় অতীতের কথা হারিয়ে ফেলছে নিজের মাতৃভাষা বাঙলার সমধুর ভাবের কথা হারিয়ে ফেলছে মধুর আমার মায়ের হাসি-র মত সমধুর মা-ডাক---এ যে বাংলা বাষার প্রতি কত বড় আঘাত তা ভাবলে হৃদয় বিদীর্ণ করে

বাঙলা নববর্ষের প্রাক্কালে এ সব কথার অবতারণার কারণ এই যে বাঙালী-নববর্ষ তথা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হোক তার স্বকীয়তার মধ্য দিয়ে অনুকরণের বন্ধ্যা পথ দিয়ে নয় নিছক আনন্দ উৎসব নয়---বাঙলা নববর্ষের দিন হোক বাঙলার মর্যাদা রক্ষার শপথের দিন বাংলা ভাষা, বাংলা গান, বাংলার মনীষীগণের প্রতি যথাযথ মর্যাদা বজায় রাখুক বাংলা ভাষার ওপর যে দূষণ ছড়ানো হচ্ছে সর্বশক্তি দিয়ে তা প্রতিরোধ করার মানসিকতা গড়ে উঠুক

প্রসঙ্গ যেহেতু নববর্ষ সেই কারণে মোটেই অপ্রাসঙ্গিক হবে না যদি স্মরণ করা হয় দার্শনিক শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকারের বাঙলা নববর্ষ প্রবচন থেকে কয়েকটি কথা বাঙালী নামধেয় জনগোষ্ঠী যে এগিয়ে চলেছে---তা এগিয়ে চলার সঙ্গে সাল তিথি তারিখও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত এবং একে কাটছাঁট করা যায় না

আবার সেই বাঙলার নতুন বছর এসেছে সুতরাং বাঙালী নামধেয় জনগোষ্ঠী অতীতে জীবিত ছিল আজও জীবিত  এবং আমি আশা করব, ভবিষ্যতে আরও দুর্দান্তভাবে জীবিত থাকবে

সেই জনগোষ্ঠীর আজ নোতুন করে শপথ নিতে হবে---এই নোতুন বছরটা তারা কিভাবে আরও সফল করে তুলবে, নিজেদের অস্তিত্বকে কীভাবে আরও প্রাণবান, প্রাণোচ্ছ্বল করে তুলবে আজ আনন্দের দিন, আর এই আনন্দের মধ্যেই তার কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে ও ভবিষ্যতের রসদ সংগ্রহ করে নিতে হবে নান্যঃপন্থা বিদ্যতে অয়নায় এছাড়া একটা জীবিত জনগোষ্ঠীর সামনে দ্বিতীয় কোনও পথ নেই আলস্যের সময় এটা নয়, বহুল কর্মৈষণার সময় সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত্তকে যেন কাজে লাগানো হয়

পরিশেষে শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকারের প্রভাতসঙ্গীতেরই কথায় ও সুরে বলি---

নববর্ষ এলো আজি সবারে আনন্দ দিতে

ফুলে ফলে পাতায় রসে সুরভিতে মন মাতাতে