পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা গেছে, যখনই কোনো মহাপুরুষ প্রচলিত ধর্মীয় কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের বিরোধিতা করেছেন, সামাজিক–র্থনৈতিক নানান শোষণ ও অবিচারের প্রতিবাদ করেছেন, শোষণমুক্ত সমাজের আদর্শ তুলে ধরেছেন, তখনই তাঁর বিরুদ্ধে শোষকশ্রেণী বা কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী ও তাদের স্তাবকরা নানা ভাবে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে, এমন কি তাঁদের পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্যে নানান্ভাবে চেষ্টা চালিয়েছে৷
তাই সক্রেটিসকে হেমলগ বিষ পান করানো হয়েছিল, যীশুখৃষ্টকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল–এমনি অজস্র উদাহরণ ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে৷
শ্রীশ্রীআন্দমূর্ত্তিজীর ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হয় নি৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী (যাঁর লৌকিক নাম শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার) ধর্মের ক্ষেত্রে সমস্ত প্রকারের কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, জাত–পাত–সম্প্রদায়–এ সমস্ত কিছুর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে আনন্দমার্গ নামে নোতুন ধর্মসাধনার পথনির্দেশ করেছেন, ঘোষণা করেছেন ‘সকল মানুষের ধর্ম এক, তার নাম মানবধর্ম’, ‘মানুষ মানুষ ভাই ভাই, উঁচু কিংবা নীচু নাই৷’ সামাজিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও সারা পৃথিবী জুড়ে–কি ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতে–কি মার্ক্সবাদী দেশগুলিতে সর্বত্র মানুষের ওপর শোষণ চলেছে৷ সেক্ষেত্রে এই দুই সামাজিক–র্থনৈতিক ব্যবস্থার তীব্র সমালোচনা করে’–এই দু’য়ের অর্থনৈতিক কেন্দ্রীকরণ সহ অন্যান্য ত্রুটিগুলিতে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে তিনি নোতুন সামাজিক অর্থনৈতিক দর্শন–‘প্রাউট’ দিয়েছেন৷ তাই প্রাউটিষ্টরা সর্বত্র প্রচার করছে, ‘ধনতন্ত্র ভাতে মারে, আঁতে মারে কম্যুনিষ্ট, তাই তো মোরা প্রাউটিষ্ট’, ‘ধনতন্ত্র ও মার্ক্সবাদের গেল দিন, প্রাউট এল জেনে নিন’৷ এইভাবে ধর্ম, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি ও শিক্ষা–সংস্কৃতি–সর্বক্ষেত্রেই দোষত্রুটি তুলে ধরে তিনি মানুষের সামনে সর্বাত্মক শোষণমুক্ত সমাজ ঘটনের আদর্শ সামাজিক অর্থনৈতিক তত্ত্ব উপহার দিয়েছেন৷
এই কারণে একদিকে যেমন, ভারতের পুঁজিপতি গোষ্ঠী তাঁকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ‘আপনি প্রাউটের প্রচার করবেন না, তাহলে আপনার ধর্মীয় ও সমাজসেবামূলক কাজে যত অর্থ লাগবে, আমরা দেব৷’ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ওঁদের প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, বিশেষ করে ‘প্রাউটে’র জন্যেই তো আমি এসেছি৷ অন্যদিকে তাঁর ‘প্রাউট’ দর্শন বিশ্বের সর্বত্র প্রচার হতে শুরু করেছে, তখন কম্যুনিষ্ট দুনিয়ার কেন্দ্র রাশিয়ার কম্যুনিষ্ট প্রধানরা উপলব্ধি করে ‘প্রাউটে’র ব্যাপক প্রচারের মধ্যে তাদের মৃত্যুবাণ নিহিত রয়েছে, তখন তারা তাদের এদেশের এজেন্ট–কম্যুনিষ্ট পার্টিকে দিয়ে প্রথমে ১৯৬৭ সালের ৫ই মার্চ আনন্দমার্গের মূল আশ্রম আনন্দনগরকে হাজার হাজার ভাড়াটিয়া গুণ্ডা দিয়ে ঘিরে ফেলে চারিদিক থেকে আক্রমণ চালায়৷ তখন মার্গগুরু শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী এখানেই অবস্থান করতেন৷ সেসময় ওই গুণ্ডাদের আক্রমণ থেকে মার্গগুরুদেব ও আনন্দমার্গ আশ্রমকে রক্ষা করতে ৫জন সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী প্রথমে এগিয়ে গিয়ে ওদের বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু গুণ্ডাবাহিনী তাদের নৃশংশভাবে হত্যা করে৷ পরে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়৷ ১৯৭০ সালে মেদিনীপুর কোর্টে এই মামলার রায়ে মাননীয় বিচারপতি স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন যে, কম্যুনিষ্ট নেতারা এই আক্রমণের ষড়যন্ত্রের পেছনে ছিল৷
এত করেও যখন শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী হত্যা করা গেল না ও আনন্দমার্গকে ধ্বংস করা গেল না, তখন তারা নূতন ভাবে ষড়যন্ত্র শুরু করে৷ তখন রাশিয়ার শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে ভারতের ইন্দিরা সরকারের গভীর আঁতাত ও বন্ধুত্ব ছিল৷ চীনে কম্যুনিষ্ট নেতারা এই সুযোগ নিতে ভুললো না৷ তারা ইন্দিরা গান্ধীকে বোঝাতে লাগল ‘আনন্দমার্গ ও আনন্দমূর্ত্তিজী’ অত্যন্ত বিপদজনক৷ তারপর তারা সুকৌশলে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা সাজিয়ে মার্গগুরুদেবকে ১৯৭১ সালের ২৯শে ডিসেম্বর গ্রেপ্তার করাল৷ গ্রেপ্তার করার পর সিবিআই থেকে বলাও হয়েছিল, আপনি ‘প্রাউট’ প্রচার বন্ধ করে দিন, তাহলে আমরা আপনার ওপর থেকে সমস্ত মামলা প্রত্যাহার করে নেব৷ তখনও দৃপ্তকণ্ঠে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন৷ সরকার তখন তাঁকে পটনা বাঁকীপুর সেন্ড্রাল জেলে আটক করে রাখেন৷ মার্গগুরুদেবের অনমনীয় ভাবও তাঁকে মুক্ত করার জন্যে দেশব্যাপী আনন্দমার্গীদের আন্দোলন দেখে মদগর্বী সরকার গোপন সিদ্ধান্ত নিল, যেমন করে হোক, শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ধরা থেকেই সরিয়ে দিতে হবে৷ আর সেই ষড়যন্ত্রে ফলস্বরূপ ১৯৭৩ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারী জেলের ডাক্তারকে দিয়ে ওষুধের নাম করে তাঁর ওপর তীব্র বিষ প্রয়োগ করা হয়৷ এর অব্যবহিত পরে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান৷ পরদিন সকালে যখন তাঁর জ্ঞান ফিরে আসে তখন মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা, মস্তিষ্কের অসাড়তা, দুচোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রুপাত, সারা দেহে ব্যথা ও প্রচণ্ড দুর্বলতা দেখা দেয়৷ পরদিন দৃষ্টি শক্তি অত্যন্ত ক্ষীণ হয়ে যায়৷
ওষুধের নাম করে তাঁর ওপর যে বিষ প্রয়োগ করা হয়, তাতে আর কোনো সন্দেহ থাকে না৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী লিখিত ভাবে এর বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবী করেন৷ কিন্তু সরকার বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবীতে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেনি৷ তখন পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন আইনমন্ত্রী শ্রী অমরপ্রসাদ চক্রবর্ত্তী ও শ্রী ভক্তিভূষণ মণ্ডলের নেতৃত্বে এক বেসরকারী তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়৷ ওই বেসরকারী তদন্ত কমিশন পটনায় গিয়ে বিভিন্ন তথ্য ও সাক্ষী প্রমাণের ভিত্তিতে রায় দেন, জেলের ভেতর শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ওপর প্রকৃতই মারাত্মক বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল৷ মার্গগুরুদেব সরকারীভাবে এই বিষ প্রয়োগের বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবীতে ১৯৭৩ সালের ১লা এপ্রিল থেকে অনির্দিষ্টকাল তিনি অনশন শুরু করেন৷ এই ঐতিহাসিক অনশন ১৯৭৮ সালের ২রা আগষ্ট পর্যন্ত–যেদিন হাইকোর্টের রায়ে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার পর জেল থেকে বেরিয়ে এলেন–সেদিন পর্যন্ত অর্থাৎ ৫বছর ৪মাস ২দিন চলেছিল৷ ইতোপূর্বে তাঁর অনশন ভঙ্গের জন্যে শ্রীটলবিহারী বাজপেয়ী, শ্রীসমর গুহ প্রমুখ পার্লামেন্টের ৪ জন সদস্য ও দিল্লীর শাহী ইমাম আবদুল বুখারী পটনা বাঁকীপুর সেন্ড্রাল জেলে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী অনশন ভঙ্গের জন্যে অনুরোধ জানাতে গিয়েছিলেন৷ মার্গগুরুদেব তাঁদের জানান, তিনি ধর্ম ও আদর্শের জন্যে লড়াই করছেন৷ তাঁর জীবনের চেয়ে আদর্শ বড়৷ তাই তিনি অনশন ত্যাগ করবেন না৷
পটনা জেলে মার্গগুরুদেবের ওপর নির্যাতন ও তাঁকে হত্যা করা চেষ্টার প্রতিবাদে ভারতে আচার্য্য দিব্যানন্দ অবধূত, আচার্য্য দীনেশ্বরানন্দ অবধূত ও আচার্য্য অতুলানন্দ অবধূত নিজেরাই গায়ে পেট্রোল ঢ়েলে তাতে অগ্ণিসংযোগ করে আত্মাহূতি দেন৷ ভারতের বাইরেও ৫জন আত্মাহুতি দেন৷ কিন্তু সরকার ওই বিষপ্রয়োগের বিচার–বিভাগীয় তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি দেওয়ার কোনো ব্যবস্থাই করলো না৷
এর মধ্যে ১৯৭৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকার দেশে জরুরী অবস্থা জারী করে আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘ ও এর সমস্ত শাখা সংঘটনগুলিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আনন্দমার্গকে নিশ্চিহ্ণ করার চেষ্টা করেছিল৷ পরে ১৯৭৭ সালে ইন্দিরা গান্ধী নির্বাচনে পরাজিত হলে আনন্দমার্গের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়৷ এর আগেই বলা হয়েছে ১৯৭৮ সালের ২রা আগষ্ট পটনা উচ্চ আদালতের রায়ে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী সম্পূর্ণ নির্দোষ প্রমাণিত হন ও যথারীতি কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন৷ সত্যের ও ধর্মের জয় হয়৷
ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে মার্গগুরু শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ১৯৭৩ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারী কারান্তরালে হত্যা করার জন্যে তাঁর ওপর তীব্র বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল৷ যদিও তাঁর শরীরে এই মারাত্মক বিষের প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই বিষকে তিনি আত্মস্থ করে নেন ও তাঁকে হত্যা করার যে চক্রান্ত তা ব্যর্থ হয়৷
তার পরের বছর থেকে প্রতি বৎসরই সারা বিশ্বের আনন্দমার্গীরা এই ১২ই ফেব্রুয়ারীর দিনটিকে ‘নীলকণ্ঠ দিবস’ হিসেবে উদযাপন করে আসছেন৷ পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে সমুদ্রমন্থনের ফলে উত্থিত ভয়ঙ্কর বিষের প্রতিক্রিয়া থেকে জগৎকে বাঁচানোর জন্যে শিব যেমন এই মারাত্মক বিষকে পান করে ‘নীলকণ্ঠ’ হয়েছিলেন, মার্গগুরদেবও তেমনি পাপশক্তির প্রয়োগ করা মারাত্মক বিষকে আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন৷ এইভাবে তিনি পাপশক্তির ষড়রন্ত্র ব্যর্থ করে মানবতার বিজয়রথকে এগিয়ে নিয়ে চলেছিলেন৷ এই ‘নীলকণ্ঠ দিবস’ স্মরণ করিয়ে দেয় মার্গগুরুদেব বিশ্বমানবতার কল্যাণে কীভাবে কষ্টবরণ করেছেন, কীভাবে তাঁর প্রতি পাপশক্তি ষড়যন্ত্র করেছে ও কীভাবে শেষ পর্যন্ত সত্যের জয় হয়৷
যে মহান আদর্শের জন্যে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী এইভাবে কারান্তরালে চরম নির্যাতন সহ্য করেছিলেন, সেই আদর্শকে বাস্তবায়িত করে’ নিপীড়িত মানবতাকে শোষকশ্রেণীর অক্টোপাশের বন্ধন থেকে মুক্ত করার মহান সংকল্পকে বার বার স্মরণ করার জন্যেই এই নীলকণ্ঠ দিবসের উদ্যাপন৷ অত্যাচারী শাসকের ঔষধরূপি বিষ যেমন শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী হজম করেছেন তেমনি তাঁর মহান আদর্শ মানব সমাজ থেকে সর্বপ্রকার শোষণ অবদমন নিপীড়নের বিষ মুক্ত করে নোতুন পৃথিবী গড়ে তুলবেই৷
- Log in to post comments