নির্বাচন পরবর্তী সমীক্ষা ঃ কী পেল বাঙলা ও বাঙালী

লেখক
সুকুমার সরকার

উনিশের লোকসভা নির্বাচন শেষ হয়ে গেল৷  প্রচণ্ড মোদি ঝড়ে আঞ্চলিক  দলগুলি সহ বৃহত্তর বিরোধী দলগুলিও খড় কুটোর মতো উড়ে গেছে৷ বাঙলা ও বাঙালির ভাগ্যাকাশেও নেমে এসেছে এক পরিবর্তনের ইঙ্গিত ! এই পরিবর্তনের ইঙ্গিত বাঙলা ও বাঙালির জন্যে কতটা ইতিবাচক ও কতটা নেতিবাচক তার হিসেব যদি বাঙালিরা না করে ভবিষ্যতে পস্তাতে হবে৷  

ভারতবর্ষ ভৌম-বৈচিত্র্যের দেশ৷ প্রতিটি ভৌম-অঞ্চল নিজের নিজের মতো করে আর্থ- সামাজিক, ভাষা-সাংস্কৃতিক ও সম্পদ-সম্ভাবনা বৃদ্ধির পথে এগিয়ে বৃহত্তর ভারতীয় ঐক্য গড়ে তোলার মতো সর্ব সংস্কারমুক্ত কোনো প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের শরণাপন্ন হবে এটাই কাম্য হওয়া উচিত ছিল৷ কিন্তু তা হয়নি৷ প্রথমত, আঞ্চলিক দলগুলি পরস্পর বিরোধী ও বিচ্ছিন্ন চিন্তার ফলে নিজেদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলে প্রতিক্রিয়াশীল ও পূঁজিবাদ সমর্থিত বিজেপির মতো বৃহত্তর দলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি৷

দ্বিতীয়ত, আঞ্চলিক দলগুলিও প্রগতিশীল কোনো উপযোগ তত্ত্বের আদর্শে আদর্শায়িত নয়৷  তারাও কোথাও সাম্প্রদায়িক, কোথাও প্রতিক্রিয়াশীল, কোথাও ক্ষয়িষ্ণু বামপন্থী৷ আর এই সবগুলির পিছনে আছে পূঁজিবাদীদের সমর্থন৷ ফলে বৃহত্তর পূঁজিবাদী সমর্থিত বিজেপির কাছে টিকতে পারেনি৷

পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক দল তৃণমূলের পরাজয়ের পিছনেও এই কারণগুলিই দায়ী৷ যতই  বাঙালী জাতি অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের হোক, মমতা সরকারের অবিরাম মুসলিম তোষণ ও নিজের মুসলিম লেবাস ধারণ হিন্দু বাঙালিরা পছন্দ করেননি৷ বোটে তার প্রভাব পড়েছে৷ তা না করে মমতা সরকার যদি  হিন্দু-মুসলিম সকল বাঙালির কথা ভেবে বাঙালি সেন্টিমেন্ট জাগাতে  পারতেন তা হলে এমনটা হতো না৷ তার উদাহরণ, বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার আগের ও পরের বোট সমীক্ষা৷ বিদ্যাসাগরের মূর্তি যারাই ভাঙুন, আঘাতটা এসেছে বাঙালির  সেন্টিমেন্টে ৷ পশ্চিমা হিন্দি সাম্রাজ্যবাদী বিজেপি যে বাঙালি বিদ্বেষী তা নতুন করে কাউকে  বলতে হয়নি৷ নইলে এবারের এত বিজেপি ঝড়ের সামনে যাদবপুরের মতো লোকসভা আসনে মিমির  মতো অপরিণত ফিল্মষ্টারের জেতার কথা নয়৷ এটা এই ইঙ্গিত করে যে, যতই পশ্চিমা ঝড় আসুক বাঙালি সেন্টিমেন্ট জাগাতে পারলে তা প্রতিহত করা সম্ভব৷ মমতা সরকারের পূর্র্বহ্ণে তা বোঝা উচিত ছিল৷ তিনি সে সব বোঝার চেষ্টা তো কখনো  করেনইনি, উল্টে বাঙালি সেন্টিমেন্ট নিয়ে আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির লক্ষ্যে যারা কাজ করছে সেই ‘আমরা বাঙালী’র মতো দলগুলির বিরুদ্ধাচারণ করেছেন৷

উনিশের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে যে পরিবর্তনের ইঙ্গিত উঠে এসেছে তা একুশে  বিধানসভার জন্য মমতা সরকারের চিন্তার কারণ৷ অনেকে বলতে শুরু করেছেন, একুশ পর্যন্ত  অপেক্ষা কেন? তৃণমূলের বিধায়কদের বিজেপিতে টেনে পূর্র্বহ্ণেই  পশ্চিমবঙ্গে  বিজেপি সরকার  গড়া যেতে পারে৷ নির্লজ্জ দল বদলকারী বিধায়করা তা করলে অবাক হাওয়ারও কিছু থাকবে না৷

উনিশের বিজেপি ষোলকলা পূর্ণ হলেও, বাঙালি তথা ভারতবর্ষের আপামর জনসাধারণের  কিন্তু ওই ‘উন’ মানে এক কম রয়ে গেল৷ সেই এক হলো, সকল মানুষের ‘‘আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক’’ শ্রীবৃদ্ধি৷ বিগত লোকসভা বোটে রামমন্দির সেন্টিমেন্টে যেমন ভারতবর্ষের আপামর জনসাধারণের কোনোই লাভ হয়নি এবারের পাকিস্তান বিরোধী সেন্টিমেন্টেও  ভারতবর্ষে আপামর জনসাধারণের কোনই লাভ হবে না৷ সাধারণ মানুষের জন্য শিল্প কলকারখানা গড়া ও  বেকার যুবক-যুবতীদের জন্য কর্মসংস্থান গড়ে তুলতে না পারলে কাজের কিছুই হবে না৷

হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ ভারতবর্ষের কোনো ভৌম-জাতিসত্তারভৌম-অর্থনীতি, ভৌম-বৈচিত্র্যের জন্যে শুভঙ্কর হয়নি৷ উল্টে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ ভারতবর্ষের ভৌম-জাতিসত্তা, ভৌম-বৈচিত্র্য ও ভৌম-অর্থনীতি ধবংস করে পূঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা মজবুত করার জন্যে মরিয়া হয়েছে৷ এর থেকে বেরিয়ে আসতে ভারতবর্ষের  প্রতিটি ভৌম অঞ্চলকে স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক  উন্নয়নের পথ ধরে বিশ্বৈকতাবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে   এগিয়ে আসতে হবে ৷ এরজন্যে ভৌম-বৈচিত্র্যের পথে ভাষা-সংসৃকতি- অর্থনীতি ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সেন্টিমেন্ট গড়ে তুলতে হবে৷ মনে রাখতে হবে, নেশনবোধ গড়ে ওঠে  সেন্টিমেন্টের কারণে৷ সেই সেন্টিমেন্টের তাস খেলেই মোদি এবারের লোকসভা নির্বাচনের বৈতরণী পার হলেন৷

এত কিছুর পরেও বাঙলা ও বাঙালি যা পেলো, তা পূঁজিবাদ সমর্থিত হিন্দি বলয়ের  শাসন  শোষণেরইঙ্গিত---যা বাঙালির ভৌম-জাতিসত্তা, ভৌম-ভাষা-সংসৃকতি, ভৌম-অর্থনীতি ও ভৌম-বৈচিত্র্যের ধবংসেরই কারণ হবে!

সুতরাং বাঙলা ও বাঙালিকে ঘুরে দাঁড়াতে  হলে, বাঙালি জাতি-সত্তার প্রকৃত আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বাঙালি সেন্টিমেন্ট জাগিয়ে তোলাকেই হাতিয়ার  করতে হবে৷

---না, এ সেন্টিমেন্ট কোনো সংকীর্ণ সেন্টিমেন্ট নয়! এ সেন্টিমেন্ট আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির  পথ ধরে বিশ্বৈকতাবাদ প্রতিষ্ঠার  লক্ষ্যে ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ গড়ে তোলার বৃহত্তর সেন্টিমেন্ট৷

আসুন, উনিশের ‘উন’-র ‘এক’ কমের পূর্ণ পূর্তি ঘটিয়ে একুশ কিংবা চবিবশে নোতুন সেই ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ গড়ে তোলার লক্ষ্যে নোতুন কোন আর্থ-সামাজিক- রাজনৈতিক দলের শরণাপন্ন হই৷ নইলে এই প্রাপ্তি একদিন চরম হতাশা ডেকে আনবে! সেদিন ‘আমরা বাঙালী’ এই পরিচয় দেওয়ারও কেউ থাকবে না৷