নির্ভয় হও

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

‘‘এষ হ দেবঃ প্রদিষোনুসর্বাঃ পূর্বো হ জাতঃ স উ গর্ভে অন্তঃ৷

স এব জাতঃ স জনিষ্যমানঃ প্রত্যঙ জনাংস্তিষ্ঠতি সর্বতো মুখঃ৷৷’’

(শ্বেতাশ্বেতরোপনিষদ)

কখনও কোনো অবস্থাতেই কোনো মানুষের মনে হীনম্মন্যতা থাকা উচিত নয়৷ আমি ছোট, এই বোধ থাকা উচিত নয়৷ কেউ নীচু নয় কেননা সকলেই পরমপিতার পুত্র, পরমপিতার সন্তান৷

একটি ক্ষুদ্র পতঙ্গ৷ সে কি তুচ্ছ? – না, সেও পরমপিতার মহিমান্বিত সন্তান৷ ছোট ছোট পাখী যাকে লোকে লাল মুনিয়া বলে, সেও কি তুচ্ছ? – না, সেও পরমপিতার সন্তান৷ আবার কালো মেঘ যা চারিদিকে আকাশকে ঘিরে নিয়েছে, মানুষ যাকে ভয় পায়, এতে বিদ্যুতের ঝলক আছে৷ সে কি খুব বড় জিনিস হয়ে গেল? – না, না, সেও পরমপিতারই সন্তান৷ সকলের একই পরিচয়৷ একই গোত্র৷

এই যে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত ঋতু দেখ প্রতিটি ঋতুর– নিজেস্ব বৈশিষ্ট্য বা বৈচিত্র আছে৷ কখনো গরমে, কখনো শীতে ভয় পাও  এই যে গরমকাল, শীতকাল, এসব তাঁরই বিকাশ, তাঁরই সৃষ্টি৷ তাহলে তুমি কাকে ভয় পাবে? সকলে একই পিতার সন্তান, সবাই তোমার ভাই, সাহসের সঙ্গে সব একসাথে থাক৷ আর কাউকেই ভয় পাবে না৷ সবই তো তোমার সঙ্গী–সাথী৷ তোমারই ভাই৷

এই যে তোমাকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চলতে হয়, এই রকম চলতে চলতে কখনো শুণলে মেঘের হুংকার৷ যদি তাতে অন্য কেউ ভয় পায় তুমি ভয় করবে না৷ কেননা তোমরা দু’জনেই তো ভাই–ভাই৷ বজ্রের হুংকারেই বা কেন তুমি ভয় পাবে? তোমারই হুংকারেই বা বজ্র কেন ভয় পাবে? এক সঙ্গে মিলেমিশে চলো৷ বজ্র থেকে কাজ নেবে অর্থাৎ বজ্রেরও উপযুক্ত ব্যবহার করবে৷ আর চলতে চলতে হতে পারে তুমি অনেক দূর চলে গিয়েছ৷ দেখলে, অনুভব করলে যে চারদিকে যা কিছু আছে, সে সব তোমার ভাই নয়৷ সে কথা ঠিক নয়৷ কেননা তুমি যেখানেই যাবে, পরমপিতা সেখানে আছেন৷ আর যত বস্তু আছে, সব তার সন্তান৷ তাই সকলেই তোমার ভাই৷

কখনও এই পরিস্থিতি আসতে পারে তুমি বিরাট শক্তিশালী সত্তার কাছে পৌঁছে গেছ, যাকে তুমি খুব ভয় পাও৷ এই যে শক্তিশালী সত্তা, তার শক্তি বা তার সাহস আসছে কোথা থেকে? সেও তোমার পিতার কাছে থেকেই আসছে৷ নিজের শক্তি বলে কারোর কিছু আছে কি? না, তা নেই৷ খাদ্য, হাওয়া, জল, মাটি ইত্যাদি দ্বারা পরমপিতা শক্তি প্রদান করেন৷ ধর, এক বিরাট শক্তিশালী পালোয়ান– সেটা কি তার নিজের শক্তি? না, তা নয়৷ সে শক্তি তোমার পরমপিতার৷ তাই তার থেকে তুমি ভয় কেন পাবে? আর যে শক্তিমান, তার মনে যদি অহংকার এসে যায়, তাহলে তার পতন হয়ে যাবে কেননা তা তার নিজের শক্তি নয়৷ একথা তার মনে রাখা উচিত যে, যে শক্তির কারণে তার এই অহংকার, সেই অহংকারের কোনো যুক্তি নেই কেননা সেই শক্তি তার নিজের নয়৷

মানুষ নিজে থেকে কিছু তৈরী করতে পারে না৷ তার কাছে যা কিছুই আছে তার প্রভু  পরমাত্মা৷ শক্তির যেখানে দুরুপযোগ হবে সেখানে শক্তি ছিনিয়ে নেওয়া হবে৷ তাই তুমি ভয় করতে পার বা ভয়ার্ত হতে পার এরকম কোনো বস্তুই বিশ্বক্ষ্রহ্মাণ্ডে নেই৷ তোমার মধ্যে যে শক্তি, যে বুদ্ধি তা তাঁরই৷ তিনি এটাই চান, এই যে সৃষ্টিলীলা, এতে তোমার যে ভূমিকা আছে, তুমি তাকে যথাযথভাবে পালন কর৷ শক্তি–সাহসের সঙ্গে জগতের সেবা কর৷ মনীষার দ্বারা আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধন কর, অন্যকে প্রকৃত পথ প্রদর্শন কর, খাও দাও আনন্দে থাক৷ পরমাত্মার গুণগান কর, সকলকে ভালবাস–সেটাই মানুষের কর্তব্য৷ সর্বদাই যে চিন্তিত থাকে কাল কী হবে, পরশু কী হবে, সে বোকা সে আসলে জানে না যে তার জন্যে ভাবনা–চিন্তা করা পরমাত্মার কাজ, তোমার কাজ হ’ল কর্তব্য করে যাওয়া৷ তুমি পৃথিবীতে এসেছো নিজের কর্তব্য করে যাও৷ তোমার জন্যে ভাবা বা চিন্তিত হওয়া, এটা পরমাত্মার কাজ৷ তুমি নিজের কাজ কর, আর তাঁর কাজ তাঁকে করতে দাও৷

তুমি যখন নিজের সম্পর্কে ভাবতে শুরু করে দেবে তখন পরমাত্মা ভাববেন যে, ‘পুত্র এত উপযুক্ত হয়ে গেছে, সেই নিজের সম্পর্কে ভাবতে পারে৷ তাহলে নিজের সম্পর্কে সেই–ই ভাবুক, আমিও তার সম্পর্কে আর ভাবব না৷’ এইজন্যে পরমাত্মাকে তাঁর কাজ করতে দাও৷ যখন তিনি নিজে থেকে বলবেন যে, ‘পুত্র, নিজের সম্বন্ধে নিজেই ভাব, এখন থেকে আমি আর ভাবব না’–তখন তুমি নিজের সম্বন্ধে ভাবতে পার৷ তখন তুমি বলবে–‘হে পরমাত্মা ভাববার বুদ্ধি তুমি আমাকে দাও৷’ তা নাহলে তাঁর ওপর সবকিছু ছেড়ে দাও৷ তুমি খাও, দাও, ভালো করে সাধনা কর, জনসেবা কর, মিলেমিশে থাক, ভগবানের ভজন কর আর সামনে এগিয়ে চল৷ যিনি তোমাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, তুমি কীভাবে থাকবে, বিপদের সম্মুখীন কীভাবে হবে, বিপদ থেকে কীভাবে রক্ষা পাবে, এসব তিনি ভাবুন, তিনি বুঝুন৷ তোমার মধ্যে যে বুদ্ধি আছে অর্থাৎ পরমাত্মা তোমাকে যে বুদ্ধি দিয়েছেন, তার সদুপযোগ কর৷