নোতুন নীতি নোতুন তত্ত্ব

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট ভারত ব্রিটিশের  কবল থেকে মুক্ত হয়৷ এরপর ভারতের রাষ্ট্রনীতি কী হবে, কীভাবে আমাদের দেশের শাসন ব্যবস্থা চলবে তা নির্ধারণের জন্যে ডঃ বি.আর. আম্বেদকরের নেতৃত্বে এক কমিটি তৈরী করা হয়, তার ওপর ভারতের সংবিধান  লেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়৷ সংবিধান হল সেই নির্দেশক পুস্তক যাতে রাষ্টের আচরণ বিধি, আইন ও আদর্শ লিপিবদ্ধ থাকবে৷ যথারীতি ওই কমিটি তাদের লিখিত সংবিধান তৈরী করে ও ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারী আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়৷

এই সংবিধানে দেশের প্রতিটি মানুষের জাগতিক মানসিক ও আধ্যাত্মিক বিকাশের অধিকার স্বীকৃত আছে৷ দেশের প্রতিটি মানুষের সমানাধিকার, স্বাধীনতার অধিকারও মেনে নেওয়া হয়েছে৷ প্রতিটি মানুষের শিক্ষা ও সাংসৃকতিক অধিকারও স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে৷

সংবিধানের নীতি ও আদর্শ তো আপাতত শুনতে খুবই ভাল৷ কিন্তু বাস্তবে তার প্রয়োগ হচ্ছে কী? এইটেই মূল প্রশ্ণ৷ গত অক্টোবর মাসে ক্ষুধা সূচকে প্রকাশিত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে ভারতের স্থান---১২৫টি দেশের মধ্য ১১১তম৷ আমাদের প্রতিবেশী দেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের অবস্থাও আমাদের থেকে ভাল৷ একাধিক আন্তর্জাতিক উপদেষ্ঠা ও বেসরকারী সংস্থার উদ্যোগে বিশ্ব ক্ষুধা সূচক প্রকাশিত হয়৷  বলা বাহুল্য নম্বর যত উপরে সেই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা তত ভাল৷ ওই পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে ভারতের জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ অপুষ্টির স্বীকার, এই হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষের অবস্থা৷ অপরদিকে কিন্তু ধনকুবেরদের সম্পদ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে৷

এরই নাম কি সমানাধিকার? একদিকে অনাহারে মৃত্যুর মিছিল অন্যদিকে বিপুল সম্পত্তি বৃদ্ধি৷  সংবিধানের আপাতমধুর প্রতিশ্রুতিকে সামনে রেখে  এদেশের রাষ্ট্রনেতা বা রাষ্ট্রনেত্রীবর্গ পুঁজিপতিদের তোষণ করেছেন ও সাধারণ গরীব মানুষদের প্রতি শোষণও অবাধে হয়ে যেতে দিয়েছেন৷ সে শোষণ বন্ধ করার চেষ্টা তো করেননি, বরং সেই শোষণ আরও বেশি করে যাতে চলে তারই ব্যবস্থা করেছেন৷

কেন এমনটা হচ্ছে? এর মূল কারণ হল ভারতের যে  স্বাধীনতা সংগ্রাম হয়েছে , এই স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্রিটিশদের তাড়ানোর মূল লক্ষ্য ছিল৷ কিন্তু জনগণের অর্থনৈতিক শোষণমুক্তির কোন আদর্শ নেতাদের সামনে ছিল না৷ যদিও নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ও এম.এন রায় এ নিয়ে চিন্তা ভাবনা করেছিলেন৷ কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তরকরণ যাদের হাতে হয়েছিল তারা কেউ এ নিয়ে চিন্তা ভাবনা করেননি৷ ফলে স্বাধীনতা লাভের ফলে দেশে যে নোতুন সরকার তৈরীর হয়েছে তার মূল নিয়ন্ত্রণ ভার যাদের হাতে থেকেছে তারা আর কেউ নয় সেই দেশীয় পুঁজিপতি গোষ্ঠী৷ কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরক্ষে বিদেশী পুঁজিপতিগোষ্ঠীও৷ দেশের নেতা নেত্রীরা পুতুল নাচের মতো জনসমক্ষে অভিনয় করে গেছেন কিন্তু তারা এক অদৃশ্য সুতোর দ্বারা পুঁজিপতিদের হাতে নিয়ন্ত্রিত হয়েছেন৷

আর বলাবাহুল্য শুধু ভারতকে নয়, সারা বিশ্বের পুঁজিপতিরা এক সূত্রেই গাঁথা ছিল৷ অর্থনৈতিক মূল নীতি হিসাবে ‘অর্থনৈতিক কেন্দ্রীকরণ’ নীতি সব দেশেই অব্যাহত থাকল৷ ফলস্বরূপ জনগণের হাতে অর্থনৈতিক শক্তি বন্টিত  হ’ল না৷ ফলে  জনগণের শৃঙ্খল মুক্তি ঘটল না৷

কেন্দ্রের শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীতে ধনকুবেরদের সম্পদ বৃদ্ধি ও শাসককুলের বিশেষ বিশেষ নেতা-নেত্রী পার্টি বা গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করাটাই অর্থনৈতিক পরিকল্পনার সঞ্চালিকা  শক্তি থেকে গেল৷ আর বলা বাহুল্য, তারও গোড়ায় থেকে গেল মুনাফালুন্ঠন নীতি৷ প্রফিট মোটিব্‌৷ কনজামসন মোটিব্‌ নয়৷ ফলে দেশের সমস্ত জেলায় সমস্ত ব্লকে কৃষিশিল্পের উন্নতি ঘটানোর নীতি গৃহীত হ’ল না৷  আর তা না করার জন্যে দেশের কোনো কোনো এলাকা  ‘ঘাটতি শ্রম’ এলাকা থেকে গেল, কোনো কোনো এলাকা ‘উদ্‌বৃত্ত শ্রম’ এলাকা থেকে গেল৷ ফলে বেকার সমস্যাটাও জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকল৷ চাকরীর জন্যে সর্বত্র যুবক ছেলে মেয়েরা উদ্‌ভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকল৷

ভারতীয় সংবিধানে বলা হয়েছে, এদেশে সংবিধান ও আইনের  চোখে  কোনো জাত -পাত সম্প্রদায়ের  বিভেদ দেখা হবে না৷ কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, সর্বত্র জাত-পাত-সম্প্রদায় নিয়ে ঘৃণা-বিদ্বেষ ও দ্বন্দ্বের আবহ৷ ‘মানুষ মানুষ ভাই ভাই, সকল মানুষের  সম অধিকার’ ---এটা যুগের নীতি৷ কিন্তু ভারতের সংবিধানের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে আজ সর্বত্র সাম্প্রদায়িক লড়াইয়ের কুচকাওয়াজ  শুরু হয়ে গেছে৷ এর পরিণতি যে অতি ভয়ঙ্কর তা অনুমান করতে  মোটেই অসুবিধা হয় না৷ আজ দেশের তথা বিশ্বের  সামনে এই যে ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে, তা ক্রমশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে৷ এক ভয়ঙ্কর বিষ্ফোরণ সামনে অপেক্ষা করছে৷ এর থেকে বাঁচবার একমাত্র রাস্তা মহান্‌ দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের ‘প্রাউট’ প্রবর্তিত ‘নোতুন নীতি’ নোতুন নেতা’ তত্ত্ব--- প্রাউটের প্রগতিশীল সমাজতন্ত্র, শারীরিক সক্ষম মানসিকতায় দৃঢ় ও আধ্যাত্মিক বলে বলীয়ান সদ্‌বিপ্র নেতৃত্ব ও  অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে জল হাওয়া পরিবেশ অনুযায়ী বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের মাধ্যমে অর্থাৎ ‘আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির পথ ধরে বিশ্বৈকতাবাদের প্রতিষ্ঠা’র নোতুন নীতি৷