ভারত মহাসাগরের ভিতরে নিমজ্জিত অবস্থায় আছে নিকিটিন সমুদ্র-পর্বত (সিমাউন্ট)৷ এই পর্বতেই রয়েছে কোবাল্টের খনি৷ যাকে ভারত মহাসাগরের গুপ্ত ‘যকের ধন’ বলছেন কেউ কেউ৷ভূতত্ত্ববিদেরা জানিয়েছেন, ভারত মহাসাগরের নীচে এক সময় বিশাল একটি আগ্ণেয়গিরি ছিল৷ তার অগ্ণ্যুৎপাতের ফলে নিকিটিন পর্বত তৈরি হয়েছে৷ সমুদ্রে নিমজ্জিত এই পাহাড়েই কোবাল্টের খনি রয়েছে৷ যা কয়েক লক্ষ কোটি টাকার সম্পদের উৎস৷সম্প্রতি সেখান থেকেই কোবাল্ট উত্তোলন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে ভারত৷ নয়াদিল্লি থেকে গত জানুয়ারি মাসে সরকারি আধিকারিকেরা গিয়ে আন্তর্জাতিক সমুদ্রতল কর্তৃপক্ষের (ইন্টারন্যাশানাল সিবেড অথরিটি) কাছে কোবাল্ট উত্তোলনের জন্য আবেদন জমা দিয়ে এসেছেন৷নিকিটিন পাহাড় ভারত মহাসাগরের যে অংশে রয়েছে, তা কোনও নির্দিষ্ট দেশের সমুদ্রসীমার মধ্যে পড়ে না৷ আন্তর্জাতিক সমুদ্রতল কর্তৃপক্ষ ওই অংশের দায়িত্বে৷ তাই সেখানে কোনও কাজের জন্য তাঁদের অনুমতি নিতে হয়৷ভারতের সমুদ্রসীমা থেকে নিকিটিন পাহাড় খুব একটা দূরে নয়৷ তাই হিসাব মতো সেখান থেকে কোবাল্ট উত্তোলনের অনুমতি পেতে নয়াদিল্লির খুব একটা অসুবিধা হওয়ার কথা নয়৷ কিন্তু বাধা এসেছে অন্য দিক থেকে৷সমুদ্রের নীচের পর্বত থেকে কোবাল্ট উত্তোলনের জন্য আবেদন জানিয়েছে শ্রীলঙ্কাও৷ ভারতের দক্ষিণের ছোট্ট এই পড়শি দেশ কিন্তু দূরত্বের দিক থেকে নিকিটিন পাহাড়ের বেশি কাছে অবস্থিত৷ ফলে সে দিক থেকে তাদের দাবি জোরালো৷ কোবাল্ট তুলতে চেয়ে আবেদন জানিয়েছিল মলদ্বীপও৷ কিন্তু সমুদ্র থেকে ধাতু উত্তোলনের মতো প্রযুক্তি তাদের হাতে না থাকায় সেই আবেদন গ্রাহ্য না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি৷ এখন প্রশ্ণ, শ্রীলঙ্কার কি সমুদ্রে পুরোদমে খনির কাজ চালানোর মতো ক্ষমতা রয়েছে?
কোবাল্টের বাণিজ্যে এমনিতে এগিয়ে আফ্রিকার কঙ্গো প্রজাতন্ত্র৷ বিশ্বের সবচেয়ে বড় কোবাল্টের খনি রয়েছে তাদের সমুদ্রসীমায়৷ সেখান থেকে সারা বিশ্বের অন্তত ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কোবাল্ট উত্তোলন করা হয়৷ভারত মহাসাগরের কোবাল্টের খনি থেকে নিয়মিত উত্তোলন শুরু হলে এই ব্যবসায় ভারতও এগিয়ে আসতে পারবে৷ সে ক্ষেত্রে কোবাল্টের বাণিজ্যে কঙ্গোর উপর নির্ভরশীলতা কিছুটা কমবে৷
ভারত, শ্রীলঙ্কা, মলদ্বীপ কেউ এখনও কোবাল্ট উত্তোলনের প্রয়োজনীয় অনুমতি পায়নি৷ আন্তর্জাতিক সমুদ্রতল কর্তৃপক্ষের দফতর রয়েছে জামাইকায়৷ সব দিক বিবেচনা করে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে কোনও একটি দেশকে অনুমতি দেওয়া হবে সেখান থেকে৷
কোবাল্ট নিয়ে কেন এত কাড়াকাড়ি? কী বিশেষত্ব রয়েছে এই ধাতুর? বস্তুত সমুদ্র থেকে উত্তোলিত কোবাল্ট বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতি নির্মাণ শিল্পে বিশেষ ভাবে কাজে লাগে৷ এই ধাতু দিয়ে ব্যাটারি তৈরি হয়৷
ছোট পেনসিল ব্যাটারি থেকে শুরু করে মোবাইল, ঘড়ি কিংবা আরও বড় কোনও যন্ত্র, কোবাল্ট ছাড়া ব্যাটারি তৈরি করা যায় না৷ ব্যাটারি তৈরির অত্যাবশ্যকীয় উপাদান লিথিয়াম৷ তার সঙ্গে কোবাল্টও প্রয়োজন হয়৷
সভ্যতা যত আধুনিক হয়েছে, বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতির ব্যবহার তত বৃদ্ধি পেয়েছে৷ আর ব্যাটারি এই ধরনের যন্ত্রপাতির প্রাণ৷ ফলে কোবাল্ট খনিতে দখল পেলে ব্যাটারি শিল্প থেকে ভারত প্রভূত রোজগার করতে পারবে৷
কিছু দিন আগেও ভারতের দক্ষিণের এই দ্বীপরাষ্ট্র চরম আর্থিক সঙ্কটে ভুগছিল৷ সরকারের অপদার্থতার বিরুদ্ধে পথে নেমেছিলেন সাধারণ মানুষ৷ সে দেশের প্রেসিডেন্ট দেশছাড়া হয়েছিলেন৷ সে সময়ে শ্রীলঙ্কাকে অর্থসাহায্য করে ভারতই৷
তাই শ্রীলঙ্কা ভারতের চূড়ান্ত বিরোধিতা করবে বলে অনেকেই মনে করছেন না৷ একাধিক রিপোর্টে দাবি, কোবাল্ট তোলার ক্ষেত্রে ভারতের আবেদন গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে৷ কারণ ভারত এ ক্ষেত্রে নিকটবর্তী দেশগুলির তুলনায় সবচেয়ে বেশি যোগ্য৷
কোবাল্ট উত্তোলনের অনুমতি আদৌ ভারত পায় কি না, পেলে চিনের মদতপুষ্ট শ্রীলঙ্কাকে টপকে কী ভাবে ওই এলাকায় কাজ চালায়, সমুদ্রের ক্ষেত্রে কোন নীতি নেয় নয়াদিল্লি, সে দিকে নজর থাকবে৷