কিছু দিন আগে বাঙ্গালোরে সাধকদের সামনে পাপ ও পুণ্য সম্পর্কে কিছু বলেছিলুম কিন্তু এখানে একটি ছেলে আমাকে অনুরোধ করেছে সে সম্পর্কে আরও কিছু বলবার জন্যে৷ তাই আমি তার ‘আদেশ’ প্রতিপালন করছি মাত্র৷ বলা হয়েছে,
‘‘ত্যজ দুর্জনসংসর্গং ভজ সাধুসমাগমম্৷
কুরুপুণ্যমহোরাত্রং স্মর নিত্যমনিত্যতাম্ ৷৷’’
***
‘‘কুরুপুণ্যমহোরাত্রম্’’ অর্থাৎ ‘‘তোমার অহোরাত্র পুণ্যকর্মে রত থাকা উচিত’’৷ এখন পুণ্য কী? পাপই বা কী? তার আগে ‘অহোরাত্র’ শব্দটির অর্থ জানতে হবে৷ অহোরাত্র হচ্ছে ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যার একটি অংশ৷ সৌরবিধি আর চান্দ্রবিধির অর্থ সূর্যের গতি অনুসারে গণনা আর চন্দ্রের গতি অনুসারে গণনা৷ (কেরালায় ভারতীয় সৌরবিধি অনুযায়ী দিন গণনা করা হয়৷ উত্তর প্রদেশে তা করা হয় চান্দ্রবিধি অনুযায়ী৷ মহারাষ্ট্রে চলে ভারতীয় সৌরবিধি৷ ৰাংলা আর কশ্মীরে চলে ভারতীয় সৌরবিধি৷) ভারতীয় সৌরবিধি অনুযায়ী এক সূর্যোদয় থেকে অন্য সূর্যোদয় পর্যন্ত সময়কালকে বলা হয় অহোরাত্র৷ সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বলা হয় দিনমান, আর সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত সময়কে বলা হয় রাত্রিমান৷ দিনমান আর রাত্রিমান যুক্ত করে হ’ল অহোরাত্র৷
এখন পুণ্য কী? ব্যাসদেব বলেছেন,–
‘‘অষ্টাদশপুরাণেষু ব্যাসস্য বচনদ্বয়ম্৷
পরোপকারঃ পুণ্যায় পাপায় পরপীড়নম্৷৷’’
‘‘যখন তোমার কর্ম বা চিন্তার দ্বারা, তোমার জাগতিক কর্ম ও মানসিক কর্মের মাধ্যমে তুমি সমাজের সামূহিক প্রগতিতে সহায়তা করছ, তাহলে তুমি পুণ্যকর্ম করছ৷ আর যখন তুমি তোমার মানসিক বা জাগতিক কর্মের মাধ্যমে সেই সামূহিক প্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করছ, তাহলে তুমি পাপকর্ম করছ৷’’ তোমরা ৰুঝলে তো? সামূহিক স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলে সেটা পাপ৷ আর সামূহিক প্রগতির দ্রুতিকে বাড়িয়ে দিলে সেটা পুণ্য৷
তাহলে পাপ হচ্ছে একটি সাধারণ (general) শব্দ৷ কিন্তু ‘পাপ’ শব্দটির একটি বিশেষ অর্থ আছে৷ সেটা হচ্ছে পাপ দু’প্রকারের৷ সামাজিক ব্যবস্থায় কিছু নির্দিষ্ট ‘বিধি’ আর নির্দিষ্ট ‘নিষেধ’ থাকে৷ ‘‘তোমার এটা করা উচিত, তোমার ওটা করা উচিত’’– এগুলি পালনীয় বিধি, আর নিষেধ হ’ল– ‘‘চুরি কোরো না, এটা কোরো না, ওটা কোরো না’’৷ উদাহরণস্বরূপ–যদি তোমার রোগগ্রস্ত মানুষের সেবা করা কর্তব্য সত্ত্বেও তুমি তা করছ না, তাহলে তুমি পালনীয় বিধির বিরুদ্ধে চলে গেলে৷ বিধির বিরুদ্ধে যাওয়াকে বলে প্রত্যবায়৷ যদি তুমি কোনো দুর্দাশাগ্রস্ত মানুষের সেবা না করলে, সেটা হয়ে গেল প্রত্যবায়৷
প্রত্যবায় হচ্ছে এক বিশেষ ধরনের পাপ৷ কিন্তু পাপ আর প্রত্যবায় আসলে দু’টি দুই প্রকারের পাপ৷ বিশেষ ধরনের পাপ হ’ল যা নিষেধ তা না মেনে চলা৷ আমার মনে হয় তোমরা এখানে ‘পাতক’ শব্দের অর্থ জান৷ পাতক তিন প্রকারের – একটি হচ্ছে পাতক অর্থাৎ সাধারণ পাতক, দ্বিতীয়টি হচ্ছে অতিপাতক, আর তৃতীয়টি হচ্ছে মহাপাতক৷
সাধারণ দোষ করলে সেটা পাতক৷ যদি কেউ যা দোষ করল তার প্রায়শ্চিত্ত করে নেয় তাহলে সেটা পাতক৷ ধর একটি মানুষ পাঁচ টাকা চুরি করল৷ এটা পাতক কেননা এর পরে তার ইচ্ছা হলে সে সেই পাঁচ টাকা এই বলে ফিরিয়ে দিতে পারে, ‘‘দয়া করে আমাকে ক্ষমা করে দিন৷ আপনার টাকা আপনি নিয়ে নিন’’৷ তাহলে এটা হ’ল প্রায়শ্চিত্ত৷ এটাই পাতক, সাধারণ পাতক৷
কিন্তু ধর তুমি এক নির্দোষ মানুষের হাত কেটে দিলে সেক্ষেত্রে প্রায়শ্চিত্তের কোনো সুযোগ থাকছে কি? ‘‘আপনি আপনার হাত নিয়ে নিন’’–তুমি এমনটি বলতে পার না৷ তুমি যা করেছ তার প্রায়শ্চিত্ত করতে পারছ না অর্থাৎ প্রায়শ্চিত্ত–বিহীন অপরাধ৷ এটাই অতিপাতক৷ এখন পাতক হচ্ছে প্রায়শ্চিত্তযোগ্য, আর যে মুহূর্তে প্রায়শ্চিত্ত কার্যান্বিত হ’ল, তুমি একজন মুক্ত মানুষ হয়ে গেলে৷ কিন্তু শাস্ত্র অনুযায়ী অতিপাতকের ক্ষেত্রে সমাজ সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করতেই হবে৷ এটাই তার প্রায়শ্চিত্ত৷ তার সমাজের সাধারণ মানুষ হিসেবে থাকবার অধিকার নেই৷ অতিপাতকীর জন্যে এই হচ্ছে নির্দিষ্ট প্রায়শ্চিত্ত৷
তৃতীয় হচ্ছে মহাপাতক৷ এই মহাপাতক অতিপাতকের মতই কিন্তু তফাৎ হচ্ছে যে এর পাপের প্রভাব পুনঃপুনঃ সংঘটিত হয়৷ ধর একজন ভ্রষ্ট ব্যবসায়ী গোলমরিচের মধ্যে পেঁপের ৰীজ মিশিয়ে দিল–এইভাবে সে ভেজাল মেশানোর এক নোতুন উপায়ের আবিষ্কার করল৷ এখন অন্যান্য ব্যবসায়ীরা তার কাছ থেকে এই জিনিসটা শিখে নেবে, আর এই প্রক্রিয়া বার বার চলতে থাকবে৷ তাই সেই ব্যবসায়ীটি যে এই কৌশল আবিষ্কার করল সে মহাপাতকী৷ কেননা এর প্রভাব চিরকাল ধরে চলতে থাকবে৷
শাস্ত্র বলছে এই ধরনের মহাপাতকের প্রায়শ্চিত্ত হচ্ছে– প্রথম কথা তার সমাজে থাকবার কোনো অধিকার নেই৷ তাকে বাইরে থেকে তার সবকিছু সমাজের জন্যে ত্যাগ করতে হবে৷ কিন্তু এটাও যথেষ্ট নয় কেননা অতিপাতকীরও তো একই প্রায়শ্চিত্ত৷ তাহলে তার কী করা উচিত? তাকে নোতুন এমন কিছুর আবিষ্কার করতে হবে যার শুভ প্রভাব পুনঃপুনঃ চলতে থাকবে৷
তাই পাতক, অতিপাতক, মহাপাতক– এই তিনই পাপের অধিক্ষেত্রের মধ্যে আসছে আর পাপ ও প্রত্যবায় দুই ধরনের পাপ৷(২০ নবেম্বর ১৯৬৫, এরণাকুলাম), (আনন্দবচনামৃতম্–২৯ খণ্ড)