পাপ, পুণ্য ও অপরাধ

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

সংশোধনমূলক ব্যবস্থা

সংশোধনমূলক ব্যবস্থাতে অপরাধী–তা’ সে যে রকমের হীন অপরাধেই লিপ্ত হেক্ না কেন, কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ করার মত কোন কিছু খুঁজে পাবে না৷ বিচারের ত্রুটি থেকে গেলেও সেক্ষেত্রে তার কোন ক্ষতি হবে না, যদি সে অপরাধী হয় সেক্ষেত্রেও সংশোধনমূলক ব্যবস্থায় সে যেমন উপকৃত হবে, সে যদি অপরাধী না হয় তাহলেও সংশোধনমূলক ব্যবস্থায় তার উপকার ছাড়া অপকার হবে না৷ এতে সমাজ উপকৃত হবে, ও অসৎ বৃত্তিসম্পন্ন ব্যষ্টিকে সৎ পথে নিয়ে যাবার সমাজসম্মত সুযোগ পাবে৷

পাপী, তাপী, চোর, চরিত্রহীন, অপরাধী–যে কেউ হোক না কেন, এগুলো তার বাইরের পরিচয়৷ ভেতরে সে পবিত্র হওয়ার সম্ভাবনায় ভরপুর৷ পাপের শাস্তি কখনও মানুষের প্রাণ হত্যায় নয়, বা তাকে চিরতরে উন্নতি করবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করায় নয়–কারণ তা করতে গিয়ে শাস্তি প্রদানকারী নিজেই পাপী প্রতিপন্ন হয়৷ তাই শাস্তি সর্বদা হবে সংশোধনের জন্যে৷

নীতিগতভাবে প্রাণদণ্ডের ব্যবস্থা ঠিক সমর্থন করা না গেলেও অবস্থা বিশেষে মানুষ এই প্রথার সমর্থক হয়ে পড়ে৷ প্রথাটির মধ্যে যখন সংশোধন–মূলক ব্যবস্থা নেই, অন্যের মনে ভীতিম্মন্যতা সৃষ্টি করা ছাড়া এর যখন কোন সদুপযোগ নেই তখন কেবলমাত্র ক্রোধের বশবর্ত্তী হয়ে মস্তকের বদলে কেবল মস্তকের নীতি নিয়ে চলা সমাজোচিত ব্যবস্থা বলে’ মনে হয় না৷ যে সত্যকারের অপরাধী, যার পক্ষে জনসাধারণের সামাজিক, মানসিক ঐতিহ্যগত কোন প্রকারের সমর্থনই নেই সেই মানুষের (সে যত বড় অপরাধই হোক না কেন–সে মানুষ) সুস্থ মানুষে পরিণত হবার, সমাজের সম্পদে পরিণত হবার কোন সুযোগই থাকবে না? অপরাধের জঘন্যতার জন্যেই যার প্রতি আমাদের তিলমাত্র মমতা নেই–এও তো হতে পারে, সে কৃতকর্মের জন্য অত্যন্ত অনুতপ্ত এও তো হতে পারে, সমাজের সত্যিকারের সেবা করে’ বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে সে উদ্গ্রীব৷ তা ছাড়া অপরাধ যদি মানসিক ব্যধিই হয় তবে অপরাধীর রোগের চিকিৎসা না করে’ তাকে হত্যা করার ব্যবস্থা চরম দায়িত্ব–হীনতার পরিচায়ক নয় কি? যে যুক্তিতে অধিকাংশ সভ্য দেশে ক্ষণিকের উত্তেজনায় অনুষ্ঠিত অপরাধের জন্য অপেক্ষাকৃত লঘুদণ্ডের ব্যবস্থা আছে, ঠিক সেই ধরণের যুক্তিতেই অন্যান্য অপরাধীরাও অপেক্ষাকৃত সদ্ব্যবহার পাওয়ার আশা করতে পারে৷ মাথার যন্ত্রণার জন্যে মাথা কেটে ফেলবার ব্যবস্থা সমর্থন করা যায় কি? বলা যেতে পারে এই সকল অপরাধীকে যদি প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত না করা হয় তা’হলে তাদের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের ব্যবস্থা রাখতে হয়, কারণ তাদের মানসিক ব্যাধি সারাবার উপযুক্ত ব্যবস্থা পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই নেই৷ কিন্তু এ ধরণের ব্যবস্থা নিতে গেলে কারাগারগুলিতে যে স্থানাভাব ঘটবে রাষ্ট্রের পক্ষে এতগুলি লোকের অন্নবস্ত্রের ব্যবস্থা করা কি সম্ভবপর? আমি তো বলবো সেই লোকগুলি কেনই বা রাষ্ট্রের পয়সায় খাবে, রাষ্ট্র নিশ্চয়ই তাদের কাছ থেকে যথোপযুক্ত কাজ আদায় করে’ নেবে ও কারাভোগান্তে তারা যাতে সমাজে গিয়ে পরিশ্রমের বিনিময়ে অর্থোপার্জনের সুযোগ পায় প্রতিটি রাষ্ট্রেরই উচিত আন্তরিকতার সঙ্গে তার ব্যবস্থা করা৷ তাই কারাগারগুলি হবে ঠিক সংশোধনী বিদ্যালয়ের মত৷ আর কারাধ্যক্ষ হবেন সমাজ–দরদী, মনস্তত্ত্ববিদ শিক্ষক৷

শাস্তি কেবল অপরাধীকে দেওয়া হবে, তার পরিবারবর্গের অন্য কোন লোককে নয়৷ ত্রুটি সংশোধিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার শাস্তি প্রত্যাহার করা হবে৷ কেউ পাপ করেছে বলে তার সারাজীবন নষ্ট হতে যেন না দেওয়া হয়৷ কোন অবস্থাতেই কাউকে সমাজচূ্যত করা চলবে না৷ দণ্ডসংহিতার ভিত্তি হবে মানবিক মূল্য৷

একজন অপরাধী যখন অত্যন্ত নিকৃষ্ট ধরণের অপরাধে জেলে গেল তখন তার ওপর নির্ভরশীল পরিবারবর্গের কি হবে? বাঁচতে তাদের হবেই, তাই তাদের ছেলেরা হয়তো পকেটমারীর দলে ঢুকবে, মেয়েরা পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করবে, অর্থাৎ কিনা একটা অপরাধীকে শাস্তি দিতে গিয়ে দশটি অপরাধী সৃষ্টি করা হয়৷ সুতরাং অপরাধীকে কারাগারে আটকে রাখার সময় তার পরিবারবর্গের আর্থিক অবস্থার কথা নিশ্চয়ই বিবেচনা করে’ দেখতে হবে ও ওই পরিবারভুক্ত লোকেরা যাতে পরিশ্রমের বিনিময়ে সৎভাবে অর্থোপার্জনের সুবিধা পায় সে ব্যবস্থা রাষ্ট্রকেই করে’ দিতে হবে৷

সামাজিক অথবা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সবার বিরুদ্ধে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেবার অধিকার সবারই আছে৷ এটা মানুষ মাত্রেরই একটা জন্মগত অধিকারের কথা৷ যাকেই কোন না কোন কারণে মানুষের সংস্পর্শে আসতে হয়, তারই ত্রুটি শোধরাবার অধিকার সমাজের অন্যান্য মানুষের যে আছে–এ কথা কোন তার্কিকই অস্বীকার করতে পারবেন না৷ সমাজের সুস্থতা রক্ষার স্বার্থে এ অধিকারের স্বীকৃতি অপরিহার্য৷ সমাজের শুচিতা রক্ষার জন্যে মানুষ মানুষের সম্বন্ধে সংশোধনী ব্যবস্থা নেবার অধিকারী–শাস্তি ব্যবস্থার নয়৷ যে বিধানে মানুষের অস্তিত্বের প্রতিটি স্পন্দন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, মানুষকে শাস্তি দেবার অধিকার কেবলমাত্র সেই বিধানেরই আছে–অন্য কারুর নেই৷ তবু মানুষ যদি তার বিচারকে জোর গলায় ত্রুটিমুক্ত ঘোষণা করতে পারত, বা তার শাস্তি–ব্যবস্থাকে অধিকারানুগ বলে’ প্রমাণ করতে পারত, তাহলেও কথা ছিল কিন্তু তাও তো মানুষ পারে না৷ তাই সমাজরক্ষার খাতিরে মানুষের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা যদি নিতে হয় তবে সে ব্যবস্থাটা হবে সংশোধনমূলক–শাস্তিমূলক নয়৷ বিচারপদ্ধতি ত্রুটিপূর্ণ হলেও সংশোধনমূলক ব্যবস্থায় কারও কোন ক্ষতির সম্ভাবনা নেই৷

‘বিচার’ শব্দটার ভাবগত অর্থ হ’ল–সত্য নির্ধারণের জন্যে বিশেষ প্রকার মনঃসঞ্চালন৷ যদিও মানুষের আপেক্ষিকতাকে নিয়েই কারবার, তবুও এই আপেক্ষিক জগতে যা সত্য বলে’ প্রতীত হয়, সমাজদেহে তাকেই বলব ‘বিচার’৷ বিচারের সব চাইতে বড় লাভ এই যে, এর সম্যক প্রয়োগের ফলে সমাজদেহে শুভ–শুভ, শিব–শিবের মধ্যে একটা অশেষ যুধ্যমান ভাব স্থায়ীভাবে থেকে যায়–যার ফলে মানব–মনীষা শিবত্বের পথ বেছে নিতে অধিকতর সুযোগ পেয়ে যায়৷

বিচার নিজে কোন একটা স্বয়ং–সম্পূর্ণ জিনিস নয়৷ বিচারের সিদ্ধান্তকে কার্যে রূপ দেওয়া হলে তবেই একটা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ হয়, অর্থাৎ গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যষ্টি বা সমষ্টির সম্বন্ধে শাস্তিমূলক–আরও ঠিক ভাবে বলতে গেলে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলে, তবেই সমাজ জীবনে বিচারের সার্থকতাটুকু অনুভূত হয়৷

তাহলে দেখতে পাচ্ছি, বিচারের অনুপূরক হিসেবে যেটা দরকার সেটা হচ্ছে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা৷ এতে চণ্ডনীতি, দণ্ডনীতি, জনসাধারণের ওপর সরকারের দোর্দণ্ড প্রতাপ বা দাপট দেখাবার কোনও অবকাশ নেই৷ শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে সংশোধনমূলক ব্যবস্থার মূলগত পার্থক্যটাও এখানেই৷ শাসন ব্যবস্থায় সামাজিক বা রাষ্ট্রিক কাঠামোটাকে মজবুত রাখবার জন্যে যে বিশেষ একটা কঠোরতার প্রয়োজন, বিচারের ক্ষেত্রে সে কঠোরতার প্রয়োজন তো নেই–ই, বরং এর পেছনে রয়েছে একটা কল্যাণমূলক কোমল মানবিক চিন্তাধারার মধুর স্পর্শ৷ শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে তাই বিচার–ব্যবস্থা অনেক ক্ষেত্রে একমত হয়ে চলতে পারে না৷ শাসনের কঠোরতাকে অনেক সময় বিচারক তার মানবিক যুক্তি দিয়ে নস্যাৎ করে’ দিতে পারেন, ও দেবেনও–রাষ্ট্রব্যবস্থার কাছে সেক্ষেত্রে শাসন কর্ত্তৃপক্ষের রায়ের চাইতে বিচারকের রায়ই শ্রেষ্ঠ বলে’ গৃহীত হবে৷ যদি তা না হয়, বা যেখানে তা না হয়, সেক্ষেত্রে বুঝতে হবে যে, রাষ্ট্রিক ক্ষেত্রে ব্যষ্টি বা দল বিশেষের স্বেচ্ছাচার চলছে৷

ঔষধের চাইতে প্রতিরোধক ব্যবস্থার গুরুত্ব অনেক বেশী একথাটা জীবনের সর্বক্ষেত্রেই সমভাবে খাটে৷ তথাকথিত সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে যখন দেখছি অপরাধের গতি প্রকৃতিও বহুপ্রকারের বৈচিত্র্য গ্রহণ করে’ চলেছে, তখন তার বিরুদ্ধে ঔষধের ব্যবস্থার চাইতে প্রতিরোধ ব্যবস্থার চিন্তা করা যে অধিক প্রয়োজন একথা অনস্বীকার্য কী ধরণের সংশোধনী ব্যবস্থা নিলে অপরাধীর মনের ব্যাধি দূর হবে সে চিন্তার চাইতে তাই কী ধরণের ব্যবস্থা নিলে মানুষের মধ্যে অপরাধ–প্রবণতা দেখা দেবে না–সেই চিন্তাই আজ সভ্য মানুষকে বেশী করে’ করতে হবে৷