পাপ বা পুণ্য–দেশ, কাল, পাত্রভেদে মানসিক বিকৃতিরই নাম বিশেষ৷ যে ধরনের বিকৃতিকে এক দেশে বা এককালে একজন পাত্র বলছে পাপ, অন্যদেশে বা অন্যকালে বা অন্য একজন পাত্র বলছে পুণ্য৷ তাই ব্যষ্টি–বিশেষের, কাল–বিশেষের পাপ–পুণ্যের ধারণাকে চরম বলে’ মনে করার পেছনে কোন যুক্তি নেই৷
আমি তো বুঝি, যা মানসিক ব্যাপকতার সহায়ক, যার সাহায্যে তুমি জগৎকে অধিক থেকে অধিকতর ভাবে আপন করে’ কাছে টেনে নিতে পারবে সেইটাই পুণ্য, আর যা তোমাকে আত্মসর্বস্ব স্বার্থপর করে’ তুলবে তাই পাপ৷ পুণ্যকর্মে রত ব্যষ্টির মানস–দেহ যে ভূমিতে বিচরণ করে সেইটাই স্বর্গ, আর পাপাচারীর মন যে লোকে ছুটে’ বেড়াচ্ছে সেইটাই নরক৷ কোন শাস্ত্রে কোথায় কে কী বলেছে তাই নিয়ে বিচার করবার প্রয়োজন আমি দেখি না, আর তাই আমি বলি, যে কারণগুলি ভৌগোলিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল কেবল সেগুলি বাদে অন্যান্য সমস্ত কারণ–সঞ্জাত সামাজিক জটিলতার নিরসন বিশ্ব–মানবের জন্যে একই আইন–কানুনে, একই দণ্ড–সংহিতার দ্বারা হওয়া উচিত৷ মানুষে–মানুষে, দেশে–দেশে, সম্প্রদায়ে–সম্প্রদায়্ বিভিন্ন ধরণের আইন প্রচলিত থাকুক–এটা কোনক্রমেই বাঞ্ছনীয় নয়৷ সবাই সুখে হাসে, দুঃখে কাঁদে, শোকে বুক চাপড়ায়, সবাইকার জন্যে অন্ন–বস্ত্র–বাসগৃহে প্রয়োজন, তবে কেন আমরা আমাদের মনগড়া হাজার রকমের ছাপ মেরে মানুষকে মানুষের থেকে পৃথক করে’ রাখবো৷১১
এই পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বভ্রাতৃত্বের যাঁরা বার্তাবহ তাঁদের লক্ষ্য রাখতে হবে বিভিন্ন দেশে সক্রিয় ন্যায়–নীতি ও আইনের মধ্যে যে পার্থক্য ও বৈষম্য আছে তাকে যেন কমিয়ে আনা যায়৷ অর্থাৎ পাপ–পুণ্যের ধারণাকে আঞ্চলিক দেশাচারের বৈষম্য থেকে উদ্ধার করে’ তার একটি বিশ্বজনীন ধারণা প্রবর্তন করতে হবে৷ সুতরাং আইনকে দেশ–কাল–পাত্রের উপযোগী করে’ সংশোধন করে’ নেওয়ার অবিরাম প্রয়াস থেকে কখনও সরে’ আসা উচিত নয়৷ বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে এটা বিশেষ প্রয়োজন৷৭
পাপ–পুণ্যের ধারণা বিভিন্ন মানুষের খামখেয়ালীর ওপর ভিত্তি না করে’ তৈরী হওয়া দরকার৷ মানুষকে যেতে হবে এমন এক স্তরে, যেখানে গিয়ে তাকে আর এগিয়ে যাবার প্রশ্ণ থাকে না৷ যে কর্ম ব্যষ্টি তথা সমষ্টির এই স্বাভাবিক গতির বিরোধিতা করে তাই পাপ৷ আর যে কর্ম মানুষ তথা সমাজকে এই যাত্রাপথে সহযোগিতা করে সেই কর্মকে বলব পুণ্যকর্ম৷৯
ইংরেজীতে যাকে ‘ব্দনু’ বলা হয় তার পর্যায়বাচক প্রতিশব্দ হচ্ছে দুটি–পাপ ও প্রত্যবায়৷ যা করা উচিত তা যদি না করা হয় তা হলো প্রত্যবায়৷ অর যা করা উচিত নয় কিন্তু করা হ’ল, তা পাপ৷ পাপ ও প্রত্যবায়ের সামবায়িক নামকে ‘পাতক’ বলে৷ আমি এখানে ‘পাপ’ শব্দটাই ব্যবহার করছি, কারণ পাপ শব্দটাই জনপ্রিয়৷
মানুষ সামাজিক জীব৷ সেজন্যে তাদের অবশ্যই কয়েকটি সমাজ–সংহিতা মেনে চলতে হবে৷ আবার সেই সঙ্গে তাদের আধ্যাত্মিক নিয়ম–কানুনও অবশ্যই মেনে চলতে হবে৷ ভ্রান্তিবশতঃ বা অন্য কোন কারণে যদি কেউ এই সমস্ত বিধি–নিষেধের বিরুদ্ধাচরণ করে সেক্ষেত্রে আমরা তাকে কোথাও বলি পাপ ব্দনুগ্গ, কোথাও বা অপরাধ ন্তুব্জন্প্পন্দ্বগ্গ৷ যদি আধ্যাত্মিক বিধি–নিষেধ কেউ লঙঘন করে তখন তাকে বলা হবে পাপ, আর যদি কেউ আইন–সংহিতাকে লঙঘন করে তাকে বলে অপরাধ৷
যদি পাপ ও অপরাধকে একসঙ্গে ধরা হয় তাহলে বলতে হবে, এদের পেছনকার কারণ মুখ্যতঃ তিনটি–
* ভৌতিক ও মানসিক আভোগের অপ্রতুলতা৷
* অতিসঞ্চিত ভৌত ও মানসিক আভোগের অব্যবহার৷
* মানসিক ও ভৌতিক ক্ষেত্রে গতিহীনতা৷
ভৌতিক ও মানসিক আভোগের অপ্রতুলতা
ভৌতিক ক্ষেত্রে যদি মানুষের প্রয়োজনীয় সামগ্রির অভাব ঘটে, তাহলে মানুষ জীবনে মহত্তর কোন কিছু অনুশীলন করতে পারে না, ও তার ফলশ্রুতিতে মানুষ সুস্থ বিচার বুদ্ধি হারিয়ে ফেলে৷ যার ফলে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই পশুভাবের দিকে এগিয়ে চলে৷ অনুরূপভাবে যদি মানুষের বৌদ্ধিক আভোগের অভাব ঘটে, মানুষের বৌদ্ধিক মান যদি উন্নত না হয়, মানুষ তখন ভুল করে’ বিধিকে নিষেধ হিসেবে, ও নিষেধকে বিধি হিসেবে গ্রহণ করে৷ পাপের তিনটি কারণের মধ্যে এটি হ’ল প্রথম ও প্রধান৷ আর এ কথাটা বিশ্বের কয়েকটি সম্পদশালী দেশকে বাদ দিয়ে অন্য প্রায় সব দেশের ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য৷ এমনকি সব সম্পদশালী দেশগুলিতেও পাপের এই কারণটি বর্ত্তমান–কিন্তু তা রয়েছে কিছুটা প্রচ্ছন্নভাবে৷ যাদের ভৌতিক আভোগের অভাব রয়েছে, তাদের জন্যে নূ্যনতম প্রয়োজন পূর্ত্তির নিশ্চিততা দিতে হবে–নইলে তারা পাপের পথ ধরবেই৷ সকলের নূ্যনতম চাহিদা পূর্ত্তির ব্যবস্থা করার জন্যে এক শক্তিশালী শাসনযন্ত্র ও বৌদ্ধিক উপায়–দুটোকেই প্রয়োগ করতে হবে৷
নিয়ন্ত্রকের প্রয়োজন জড়জগতে খুব বেশী রকমেরই রয়েছে, কারণ জড়জগতেই পশুবৃত্তি ক্ষ্যাপা কুকুরের মত অন্যের মুখের গ্রাস কেড়ে নেয়৷ জড়জগতেই ভাবজড়তা স্তুপ্সন্ধপ্প্ত্রগ্গ প্রেষিত হয়ে মানুষ দেহধারী জীব বিধবার একমাত্র সন্তানকে আছড়ে মারে৷ জড়জগতেই অর্থগৃধ্ণূ পিশাচেরা সরল, ঋজু একতাহীন মানুষদের তিলে তিলে শুকিয়ে মারে৷ জড়জগতেই সবল দুর্বলের জিহ্বা উৎপাটিত করে’ তার মুখের ভাষা কেড়ে নেয়, তার প্রাণের আকুতিকে ভাষায় রূপ দেবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে৷ তাই এই জড়জগতের জন্যে কঠোর শাস্ত্রের প্রয়োজন৷৩৪
অতিসঞ্চিত ভৌতিক ও মানসিক আভোগের অব্যবহার
সঞ্চয় যেখানে অত্যধিক সেখানে যথার্থ উপযোগের সুযোগ কমই থাকে৷ যেখানেই অত্যধিক ধনসঞ্চয় ঘটবে সেখানেই সঞ্চিত সম্পদের অপব্যবহারও থেকে যাবে৷ অধিকন্তু যেখানেই অতি সঞ্চয়, সেখানে মানুষ স্থূল বৃত্তির দ্বারা তাড়িত হয়ে সম্পদের অপব্যবহার করে’ বসে৷ যেখানে ভৌতক ও মানসিক আভোগের অতিসঞ্চয় ঘটেছে, মানুষ সেখানে পাপের পথে এগিয়েছে৷ মানসিক আভোগের ক্ষেত্রেও যেখানে অতিসঞ্চয় হয়েছে, সেখানেও একই জিনিস ঘটেছে৷ যদি কেউ অত্যধিক মেধার অধিকারী হয়, কিন্তু সেই মেধা বা বুদ্ধি যদি ঠিক পথে পরিচালিত না হয় তাহলে মানুষ সেখানে মার্জিত শয়তানে হ্মপ্সপ্তন্ব্দড়ন্দ্বস্ ব্দ্ত্রব্ধ্ত্রুগ্গ পরিণত হয়, ও বহু মানুষের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়৷ সমাধানের প্রসঙ্গে একথাটা বলা যায় যে, মানুষকে বৌদ্ধিক আবেদন তথা বৌদ্ধিক প্রচারের সাহায্য নিতেই হবে৷ আর এই তত্ত্বের বাস্তবায়নের জন্যে প্রয়োজন অনুযায়ী দৈহিক শক্তিকেও কাজে লাগাতে হবে৷ একদিকে অতিসঞ্চয়ের ফলে জিনিসপত্র পচে যায়, আর অন্যদিকে অভাবের তাড়নায় মানুষ পাপী হয়ে যায়–আমরা এই অবস্থাটাকে দীর্ঘদিন ধরে’ চলতে দিতে পারি না৷
মানসিক ও ভৌতিক ক্ষেত্রে গতিহীনতা
যখন কোন চলমানতা ভৌতিক ও মানসিক স্তরে থাকে না, তখনই তা পাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়৷ যারা রক্ষণশীল মনোভাব নিয়ে চলে তারা বাস্তবিকই জড়বাদী, ও মানসিক দিক থেকে স্থবির৷ তাদের মধ্যে গতি সঞ্চার করতে হবে৷ শুধু তাই নয়, তাদের চলার গতিতে দ্রুতিও আনতে হবে৷ পাপের এই কারণটির সমাধান করতে গেলে কেবল বৌদ্ধিক আবেদন–নিবেদনে কাজ হবে না৷ যারা ভাবজড়তাকে মনে স্থান দিয়েছে, এমনকি যারা গতানুগতিকতাকেও মেনে চলে–তারা মানুষও নয়, আবার পশুও নয়৷ তারা যুক্তি–তর্কের ধার ধারে না৷ তাই তাদের আঘাত করতেই হবে৷ সময়োচিত আঘাত হেনে সেই পঙ্গু বা স্থবির মানুষগুলোকে জাগিয়ে দিতে হবে –অন্যথায় তারা সমাজের বোঝাই থেকে যাবে, ও ভৌত–মানসিক ক্ষেত্রে একটা গতিহীনতা জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসবে৷ এই আঘাত হানার মধ্য দিয়েই মানব–প্রগতির পথটি সরল রৈখিক, সুনির্মিত ও সুপ্রশস্ত হয়ে যাবে৷২৫
অপরাধীর দোষগুণ, তথা স্বেচ্ছায় বা পরেচ্ছায় অনুষ্ঠিত কর্মগুলি যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করে’ দেখতে গেলে অপরাধীগণকে আমরা মোটামুটিভাবে নিম্নলিখিত কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করতে পারি৷
স্বভাবগত অপরাধ ঃ জন্মগত কারণে কিছু সংখ্যক পুরুষ ও নারী একপ্রকার বিকৃত মানসিকতার অধিকারী হয়ে থাকে৷ এদের এই মানসিক বিকৃতির কারণ এদের দৈহিক গ্রন্থিসমূহের বিকৃতির মধ্যেই নিহিত থাকে৷ এই শ্রেণীর জন্ম অপরাধীরা সমাজের সব চাইতে বড় বোঝা, সব চাইতে বড় দায়৷ এই অপরাধীরা মানুষের শরীর নিয়ে পৃথিবীতে আসে বটে, কিন্তু মনের দিক দিয়ে এরা মনুষ্যেতর জীব৷ এদের শরীর সংরচনাও সাধারণ মানুষের চাইতে আলাদা৷ মনোবৈজ্ঞানিক বা শারীর–বৈজ্ঞানিকরা এদের ত্রুটি বা বিকৃতি কোথায় তা বোঝেন, কীভাবে সে বিকৃতি দূর হতে পারে তাও বোঝেন, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ওই বিকৃতিগুলোকে সরানোই কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ এই শ্রেণীর জন্ম–পরাধীকে তথা সমস্ত শ্রেণীর অপরাধীকেই অন্যান্য মানুষদের থেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে রাখার প্রয়োজন হয়৷ তার চিকিৎসা কারাগারে, অথবা আরও প্রকৃষ্ট ভাষায় বলতে গেলে সংশোধনাগারেই* হওয়া উচিত৷ কারাগার তার শাস্তির জায়গা নয়–রোগমুক্তির হাসপাতাল৷ জন্ম–পরাধীরা যে মানসিক রোগে ভুগে চলেছে তার চিকিৎসা একমাত্র মনস্তত্ত্ববিদের দ্বারা হওয়া সম্ভব নয়৷ এজন্যে সমাজতত্ত্ববিদ ও চিকিৎসকেরও সহযোগিতা প্রয়োজন৷ মনস্তত্ত্ববিদ্ মনের ব্যাধিটুকু দেখিয়ে দেবেন, বুঝিয়ে দেবেন কী কী কারণে এই ব্যাধির উদ্ভূতি হয়ে থাকে৷ তিনি মানসিক চিকিৎসায় রোগমুক্তি যতদূর পর্যন্ত হতে পারে, নিজে ততটুকু করেও দেবেন, তারপর কাজ রয়েছে চিকিৎসকের৷ দেহযন্ত্রের যে বিকলতার জন্যে এই রকমের ব্যাধির উদ্ভব হয়–চিকিৎসক ঔষধের সাহায্যে বা শল্যকরণের সাহায্যে সে ত্রুটিগুলি দূর করে’ দেবেন৷ তারপর কাজ করবে সমাজতত্ত্ববিদেরা৷ সমাজতত্ত্ববিদ ওই রোগমুক্ত অপরাধীকে সমাজে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে’ দেবেন৷ মানুষ যতদিন এদের জন্যে এই জাতীয় মানবিক ব্যবস্থা না নিচ্ছে ততদিন পর্যন্ত শুধু শুধু এদের আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে প্রহসন করার কোন অর্থ হয় না৷ ভালভাবে মনে রাখা দরকার এরা রোগী–আর এদের রোগ জবরদস্ত রকমের৷ অবশ্য অধ্যাত্ম সাধনায় এই রোগ অল্পদিনের মধ্যে, ও যৌগিক প্রক্রিয়ায় তদপেক্ষা কিছুটা বেশীদিনের মধ্যে সেরে যেতে পারে৷ কিন্তু সেজন্যেও দরকার উপযুক্ত পরিবেশ৷ তাই জেলখানার পরিবেশ আরও পবিত্র, আরও মানবোচিত করে’ তোলা দরকার৷ (ক্রমশঃ)