সমাজের অগ্রগতি ত্রয়ীর সমন্বয়---থীসিস, এ্যাণ্টিথীসিস ও সিনথীসিস৷ যখন কোন বিশেষ তত্ত্ব সমাজের কল্যাণ---সাধনে অসমর্থ হয়, তখন ওই প্রচলিত তত্ত্বের বিরুদ্ধে এ্যাণ্টিথীসিস তৈরী হয় ও এই দুই বিরুদ্ধ শক্তির পারস্পরিক সংঘর্ষ ও সংসক্তির(cohesion) ফলে আসে এক লব্ধি(resultant)৷ এই লব্ধি বা ফলকে বলা হয় সংশ্লেষণ(synthesis)৷ সমাজকল্যাণ সংশ্লেষণের অবস্থাতেই সম্ভব---এটা কি সত্য?
কল্যাণকে বাস্তবে রুপান্তরিত করার দায়িত্ব ও কর্তব্য যাদের ওপর আরোপিত হয়েছে, তারা যদি সংখ্যালঘু কিংবা সাধারণ মানুষের প্রতি অবহেলা দেখায়, তাহলে এক যুগের যেটা সিনথীসিস, পরবর্তী অধ্যায়ে তা থীসিসে রূপান্তরিত হয়ে যায়৷ সামাজিক সুবিচারের প্রশ্ণ ওঠার কারণ হ’ল---এই বিশ্ব গতিশীল, এ যেন এক চলন্ত দৃশ্যপট৷ এই প্রায়োগিক(emperical) জগতের সব কিছুই আপেক্ষিকতায় সন্নিবিষ্ট৷ দেশ কাল ও পাত্রের কক্ষপথে সব কিছুই ঘুরে চলেছে৷
সংশ্লেষণাত্মক অবস্থায় কোন বিশেষ এক সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক তত্ত্ব বিশেষ যুগের বিশেষ দেশের ও বিশেষ ব্যষ্টির কাছে কল্যাণকর ও অনুকূল হতে পারে, কিন্তু দেশ-কাল-পাত্রের পরিবর্তন ঘটলে সেই তত্ত্বই যে আশিস বর্ষণ করবে তা বলা যায় না৷ সেই পরিস্থিতিতে সামাজিক অবিচারের শিকার হয়ে যে সমস্ত নির্যাতিত ও অবদমিত মানুষ হতাশাক্লিষ্ট ও ক্ষুব্ধ অন্তরে দিন কাটাচ্ছে তারাই সেই যুগের সিনথীসিস এর বিরুদ্ধে এ্যাণ্টিথীসিস খাঁড়া করবে৷ এ্যাণ্টিথীসিসের উদ্ভবের জন্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও দৈহিক শক্তিই একমাত্র প্রাক-প্রয়োজনীয়তা নয়৷ যদি নির্যাতিতের দল ৌেদ্ধিকতা-সম্পন্ন হয়, তাহলে সংখ্যায় তারা যত অল্পই হোক না কেন, তারা এ্যাণ্টিথীসিস খাড়া করতে পারে৷ এ্যাণ্টিথীসিস তৈরী হয়ে গেলেই পূর্বের মতবাদ আর সিনথীসিস থাকবে না৷ সেটা পরবর্তী ধাপে থীসিস-এ পরিণত হবে৷ দ্বিতীয় অধায়ে সেই থীসিস-এর বিরুদ্ধে এ্যাণ্টিথীসিস তৈরী হবে৷ এই অধ্যায়ে যতক্ষণ না সিনথীসিস আসছে ততক্ষণ সংঘর্ষ প্রবহমান থাকবে৷ তাত্ত্বিক বিচারে সংশ্লেষণ চরম নয় ও সর্বশেষ সংঘর্ষও সকিছু নয়, কেন না এটাও তো আপেক্ষিকতায় সংঘটিত হয়ে চলেছে৷
‘প্রাউট’ (Pro—Progressive, U—Utilisation, T—Theory)-এর মতে সমাজ চক্রাকারে পরিবর্তন ঘটে চলেছে৷ কোন এক যুগে মেহনতী জনতাই সর্বেসর্বা ছিল৷ তখন মানুষের সমাজও ছিল না, সভ্যতাও ছিল না৷ এমন কি পরিবারের ধারণাও একরকম ছিল না বললেই হয়৷ একে শূদ্রযুগ লা যেতে পারে আর এই শূদ্রযুগের পর এসেছিল ক্ষাত্রযুগ অর্থাৎ যোদ্ধাদের যুগ যখন যোদ্ধারা বা ‘হারকিউলিয়ান’-রা বিপ্র-শ্রেণীকে(intellectuals) খোলাখুলি অপমান করে অবহেলা করে ও তাদের সেণ্টিমেণ্টে আঘাত হানে, তখন বিপ্রের দল ক্ষাত্রযুগের থীসিস-এর ওপর প্রতিশোধ ও শাস্তি কামনায় এ্যাণ্টিথীসিস খাড়া করে৷ সংঘর্ষ ও সংসক্তির ফলে সমাজ চক্রে দিগ্বলয়ে দেখা দেয় বিপ্রযুগের ঊষাকাল৷ কিন্তু শোষণ ও কষ্টের কাহিনী শেষ হয় না৷ যখন বিপ্রের দল র্জোয়াশ্রেণীর ওপর অত্যাচার করে, আঘাত হানে তখন অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ র্জোয়া শ্রেণী বিপ্রযুগের বিরুদ্ধে ক্রুসেড্ আরম্ভ করে৷ এই ভাবে বিপ্রযুগের থীসিস-এর বিরুদ্ধে আবার এ্যাণ্টিথীসিস খাড়া হয়ে যায়৷ যখন সেদিনের বিক্ষুব্ধ দল শোষণ, মুনাফাবাজী ও কালোবাজারী শুরু করে ও অপরের রক্ত ও প্রাণের বিনিময়ে বাঁচতে চায়, তখন শোষিত, নিষ্পিষ্ট ও বিদ্রোহী মানুষ বুর্জোয়া শ্রেণীর ধবংসের দাবিতে রক্তাক্ত বিপ্লব শুরু করে৷ মানব-ইতিহাসে সমাজচক্রের এই প্রবাহ চিরন্তন৷ ‘প্রাউটের’ মতে সমাজচক্রের এই পরিক্রমা কোনদিনই রুদ্ধ হবে না বা থেমে যাবে না৷ সদ্বিপ্ররা দল প্রচলিত বর্বরতা, অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মনোবৃত্তিকে উৎসাহিত করে তুলবে ও এই সংগ্রামের গতিকে বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করবে৷ তারপর সিন্থীসিস-এর অবস্থায় তারা নিজেদের হাতে সমাজের নেতৃত্ব গ্রহণ করবে৷ দেশ-কাল-পাত্রের সঙ্গে সঙ্গতি(adjustment) রাখতে সদ্বিপ্র-প্রবর্তিত এই সংশ্লেষণাত্মক যুগ চিরস্থায়ী হতে পারে৷ সমাজ এই সমস্ত সদ্বিপ্রের দ্বারা শাসিত ও পরিচালিত হবে৷ সমাজের সংশ্লেষণাত্মক কাঠামো বর্তমান থাকবে, যদিও বিভিন্ন যুগ আসবে, যাবে৷
শূদ্রযুগ আসবে, কিন্তু শূদ্রের দ্বারা কোন শোষণ হবে না৷ ক্ষাত্রযুগ আসবে, কিন্তু ক্ষত্রিয়ের শোষণ চলবে না, কেননা সমাজের মধ্যে সংশ্লেষণাত্মক অবস্থা(synthetic order) বর্তমান থাকছে৷
দেশ, কাল ও পাত্রের সঙ্গে এই ধরণের সামঞ্জস্য বজায় রাখা কেবলমাত্র সদ্বিপ্রের দ্বারাই সম্ভব৷ যারা জড়বাদী দর্শন প্রচার করে কিন্তু নীতিপরায়ণ ও আধ্যাত্মিক চেতনা-সম্পন্ন নয়, তারা এই সামঞ্জস্য বিধান করতে পারেনা কেননা, সমস্ত পরিবর্তন আপেক্ষিকতার মধ্যে সংঘটিত হয়৷ যাঁদের মধ্যে ভূমার লক্ষ্য ও ভূমাভাব চরম ও পরমরূপে বিদ্যমান ও যাঁরা সত্যসত্যই বিশ্বভ্রাতৃত্বে বিশ্বাসী তাঁরাই এই সামঞ্জস্য রক্ষা করতে পারেন, কেননা, প্রতিনিয়ত আধ্যাত্মিক ভাবাদর্শের প্রভাবে তাঁরা মহৎ ও উদার মনোভাবাপন্ন হয়েছেন৷ আদর্শের উদারতা তথা মানসিক বিকাশের জন্যে তাঁরা স্বভাবতঃ সকলকেই স্নেহ ও ভালবাসার দৃষ্টিতে দেখে থাকেন৷ কোন বিশেষ যুগের ওপর বা ব্যষ্টির ওপর তাঁরা কখনই অবিচার করতে পারেন না৷ তাই সদ্বিপ্র-সমাজ উৎপীড়িত ও অবদমিত মানবতার একযোগে প্রার্থনা ও দার্ি৷ সুতরাং দ্বন্দ্বাত্মক ভৌতিকতাবাদ মূলতঃ ত্রুটিপূর্ণ৷ কিন্তু সদ্বিপ্ররা সমস্ত দেশে স সময়ে কোন বিশেষ তত্ত্বের এ্যাণ্টিথীসিস তৈরী হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে৷ যতদিন পর্যন্ত না এ্যাণ্টিথীসিস তৈরী হয়, ততদিন সদ্বিপ্রের দল পরবর্তী অধ্যায়ে এ্যাণ্টিথীসিস তৈরী করবার জন্যে পৃথিবীব্যাপী এর মনস্তাত্ত্বিক পটভূমিকা তৈরী করবে৷ যে মুহূর্তে সংশোধনের পুণ্য ঊষা নেবে আসবে, সেই মুহূর্তেই সদ্বিপ্ররা সমাজের নেতৃত্ব নিজের হাতে গ্রহণ করবে৷ তাই দেখি দ্বন্দ্বাত্মক ভৌতিকতাবাদের দ্বারা সমাজকল্যাণ সম্ভব নয়৷ কোন বিশেষ যুগে মানব সমাজের মঙ্গলের জন্যে এটা উপযোগী হ’তে পারে ও ঠিক, পরবর্তী যুগেই তা শোষণ ও ধবংসের নৃশংস অস্ত্রও হয়ে উঠতে পারে৷ ‘প্রাউট’ হচ্ছে এর একমাত্র সমাধান কেননা, দেশ, কাল ও পাত্রের মধ্যে পরিবর্তন সে স্বীকার করে ও অনুভব করে৷ সকল সময়ে আপেক্ষিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে যাবে৷ ‘প্রাউটে’র ফলিত দিক আঙ্কিক অনুপাতের মধ্যে কোনদিনই গর্ণ্ডীদ্ধ থাকবে না৷ ‘প্রাউট’-এর নীতি ও কর্মসূচীর ব্যবহার বিশেষ যুগে, বিশেষ দেশে ও বিশেষ পাত্রের ওপর যেভাবে প্রয়োগ করা হবে, দেশ, কাল পাত্রের পরিবর্তনের ফলে পরিবর্তিত অবস্থায় তা একরূপ থাকবে না৷ ‘প্রাউট’ এই মূল নীতিগুলি অবলম্বন করেছে৷
দ্বন্দ্বাত্মক ভৌতিকতাবাদ মনুষ্যসমাজের কল্যাণ করতে পারে না৷ কেবলমাত্র কোন বিশেষ যুগে বিশেষ কালে, বিশেষ পাত্রের পক্ষে এর কিছু উপকারিতা থাকতে পারে৷ (ক্রমশঃ)