প্রাউট প্রসঙ্গে প্রবচন (৪)

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

সংস্কৃতি

সংসৃক্তি সম্পর্কে মানুষের ধারণা খুবই অস্পষ্ট৷ জীবনের বিভিন্ন ধরনের অভিপ্রকাশের সামূহিক নামই সংসৃক্তি৷ মানুষ খায়, আতিথ্য উপভোগ করে, কোন ব্যাপারে উল্লসিত হয়, আবার অন্য কোন ব্যাপারে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে –– এইভাবে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন ভাবে নিজেকে অভিব্যক্ত করে৷ এই সমস্ত অভিব্যক্তির সমাহারই সংসৃক্তি৷ অন্যের কাছে মঙ্গলজনক নয় এমন ধরনের অভিব্যক্তিকে বলে কৃষ্টি৷ উদাহরণস্বরূপ এক ইংরেজ পরিবার আতিথেয়তা করতে গিয়ে একজন ভারতীয়কে হয়ত গোমাংস পরিবেশন করলো –– যা ভারতীয় অতিথি পছন্দ করতে নাও পারে৷ সংসৃক্তি কিন্তু এমন নয়৷ সংসৃক্তি শব্দটা ভাল অর্থে ব্যবহূত হয়, ও এটা সকলের ক্ষেত্রেই মঙ্গলময়৷

প্রাউটের মতে সমগ্র মানব সমাজের সংসৃক্তিই এক৷ অবশ্য এই সাংসৃক্তিক অভিব্যক্তির ক্ষেত্রে কিছু কিছু স্থানীয় বৈচিত্র্য থাকে, কিন্তু সংসৃক্তি বিশ্বজনীন৷ সকলেই খায় –– তবে কেউ খায় হাত দিয়ে, কেউ কাঠি দিয়ে আবার কেউবা চামচ দিয়ে৷ ভারতীয় নৃত্য মুদ্রা ভিত্তিক, আর ইয়ূরোপীয় নৃত্য ছান্দসিক –– কিন্তু তাই বলে’ দুটিকে আলাদা সংসৃক্তি বলা ঠিক হবে না৷

বিভিন্ন জনগোষ্ঠী যত বেশী পরস্পর মেলামেশা করবে ততই স্থানীয় বৈচিত্র্য কমে যাবে৷ কারণ মেলামেশার ফলে একই ধরনের আচার–আচরণ সৃষ্টি হয়ে যাবে৷ নেপালে এই ভাবেই হিন্দু ও ক্ষৌদ্ধ আচার–আচরণের মধ্যে একটা সংমিশ্রণ হয়েছে৷ বাঙলায় আর্য ও দ্রাবিবীয় আচার–আচরণের সংমিশ্রণ হয়েছে৷ এই স্থানীয় বৈচিত্র্যকে আচার–আচরণ বলা যেতে পারে৷ অর্থাৎ বিশেষ বিশেষ জনগোষ্ঠীর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী অভিব্যক্তিকে আচার–আচরণ বলা যায়, কিন্তু অভিব্যক্তি মাত্রই সংসৃক্তি৷ অতএব ভাষা ও সংসৃক্তি অনুযায়ী সীমানা নির্দ্ধারণ করাটা ভ্রান্তিবিলাস মাত্র৷ ভারতীয় সংসৃক্তি ও বিশ্ব সংসৃক্তি একই৷ আচার–আচরণ অনুযায়ীও সীমানা নির্দ্ধারণ সম্ভব নয়, কারণ একই অঞ্চলে বিভিন্ন ধরণের আচার–আচরণের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়৷

পরিবার পরিকল্পনা ও জন্ম নিয়ন্ত্রণ

কায়েমী স্বার্থের ধ্বজাধারীরা জন্মহার বৃদ্ধিকে সমর্থন করে না, কারণ জন্মহার বৃদ্ধি হলে জাগতিক সম্পদ সেই বর্দ্ধিত জনগণের সঙ্গে ভাগ করে নিতে গিয়ে তাদের সঞ্চিত সম্পদে টান পড়বে৷ পুঁজিবাদীরা চায় যে ক্ষুদ্ধিজীবীরা নিশ্চিহ্ণ হয়ে যাক, তাতে তাদের শোষণের পথ নিষ্ক্ণ্ঢক হবে৷ সাধারণতঃ মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকেই ক্ষুদ্ধিজীবী সৃষ্টি হয়৷ এই মধ্যবিত্তদের সংখ্যা কমিয়ে ফেলার উদ্দেশ্যেই পুঁজিবাদীরা পরিবার পরিকল্পনা ও জন্ম নিয়ন্ত্রণকে উৎসাহিত করে৷ তাই পুঁজিবাদীরাই এই পরিবার পরিকল্পনা ও জন্ম নিয়ন্ত্রণের উদ্ভাবক৷

যুগ যুগ ধরে’ মেনে আসা কুসংস্কারের বশবর্ত্তী হয়ে সাধারণ মানুষ জন্ম নিয়ন্ত্রণের পথে যায় না৷ একমাত্র মধ্যবিত্ত ক্ষুদ্ধিজীবীরাই এই পথে পা বাড়ায় ও পুঁজিবাদীদের পাতা ফাঁদের শিকার হয়৷ প্রাউট ব্যবস্থা এর খুবই বিরুদ্ধাচরণ করবে৷ বিশ্বের মানুষের ভরণ পোষণের জন্যে প্রচুর সম্পদ রয়েছে৷ বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে তাল রেখে এগোলে এমনও সময় আসবে যখন মানুষ ট্যাবলেট খেয়েই জীবন ধারণ করতে পারবে৷ কৃত্রিম উপায়ে স্বাভাবিকতা রুদ্ধ না করে’ প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে কীভাবে সামঞ্জস্য রক্ষা করা যায় তার উদ্ভাবনের মধ্যেই মানুষের প্রকৃত মহত্ত্ব৷

কৃত্রিম জন্ম নিয়ন্ত্রণের অর্থ পুরুষ বা নারীর প্রজনন ক্ষমতা কৃত্রিম ভাবে রুদ্ধ করে’ দেওয়া৷ এতে মানব শরীর ও মনে কতকগুলি বিপজ্জনক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়৷ কৃত্রিম এই বন্ধ্যাত্বকরণের ফলে গ্ল্যাণ্ডের, ও গ্ল্যাণ্ড থেকে নিঃসৃত হর্মোনের কিছু পরিবর্তন হয়, ও শেষ পর্যন্ত তা মনের বিকাশকে ব্যাহত করে৷ এই পরিবর্ত্তনের ফলে একজন মানুষ খোজায় পরিণত হয়ে যায়৷ প্রাউটের মতে যারা খুবই প্রতিবন্ধী অথবা জন্ম অপরাধী তাদেরই প্রজনন ক্ষমতা কৃত্রিম ভাবে রুদ্ধ করে’ দেওয়া যেতে পারে৷

রসায়নাগার–জাতক

এমন একদিন অবশ্যই আসবে যখন মানুষ রসায়নাগারে (ল্যাবরেটরীতে) টেষ্ট টিউব বেবী সৃষ্টি করবে৷ এই ভাবে মানুষ সৃষ্টি যখন ব্যাপকভাবে সাফল্যলাভ করবে তখন প্রকৃতি যেভাবে আদিম মানুষ অষ্ট্রালোপিথেসিন থেকে শুরু করে’ মানব শরীরের বিভিন্ন বিবর্ত্তন ঘটিয়েছে ঠিক তেমনি ভাবেই প্রজনন ক্ষমতাও লুপ্ত করে’ দেবে৷ যখন মানুষের প্রজনন ক্ষমতা থাকবে না, ও যখন মানব শিশু রসায়নাগারেই জন্মগ্রহণ করবে –– মানব সভ্যতার আগামী সেই যুগের আলোচনা খুবই কৌতূহলোদ্দীপক হবে৷

সৃষ্টিশীলতা মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা৷ এই প্রবণতায় প্রোৎসাহিত হয়ে মানুষ নোতুন কিছু সৃষ্টি করে, নোতুন আবিষ্কার করে, গবেষণায় মনোনিবেশ করে৷ সৃষ্টির এই প্রেরণাতেই মানুষ তার আত্মজ–আত্মজা সৃষ্টিতে প্রয়াসী হয়৷ সৃষ্টির এই অভীপ্সায় যখন মানুষ নিজের অন্তরেই অন্তরতমকে তথা পরমচৈতন্যকে অনুভবের জন্যে প্রয়াসী হয় তাকেই বলে প্রেম৷ আধ্যাত্মিক সাধনাই সেই অনুভূতিকে অভীষ্টে রূপান্তরিত করে৷ অন্যথায় সৃষ্টির এই প্রবণতাকে ‘কাম’ ব্দন্দ্বপ্রব্ভ্ত্রপ্ত ন্প্পহ্মব্ভপ্তব্দন্দ্ব আখ্যা দেওয়াই শ্রেয়৷ সৃষ্টির আকুলতার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশের অপচয় হয় এই কামে৷ যখন রসায়নাগারেই মানব শিশুর উদ্ভূতি হবে, ও যখন প্রকৃতি মানুষের প্রজনন ক্ষমতা হরণ করে নেবে, তখন মানুষের উদ্বৃত্ত সৃষ্টি –– প্রবণতা শুভ পথে সঞ্চালিত হয়ে যাবে, ও তার ফলস্বরূপ উন্নততর উদ্ভাবন ও আবিষ্কারের পথ ধরে’ মানুষ তার জীবনের মহত্তম লক্ষ্যে উদ্ভাসিত হবে৷ মানুষের এই সৃষ্টি–প্রবণতার এমনতর উপযোগিতার ধারণা এর আগে কখনই করা হয়নি৷ মানুষের এই সৃষ্টি–সামর্থ্যের সুবিশাল সর্বব্যাপকতার উদ্ভাবন এতকাল কেউই করেন নি৷ এখানেই প্রউটের নোতুনত্ব৷ দর্শনের জগতে প্রাউট তাই নববিধান৷

গবেষণাগারে দু’ধরনের মানুষ তৈরী হবে –– যান্ত্রিক ও জৈবিক৷ যান্ত্রিক মানব শিশুগুলি বৈদ্যুতিক শক্তি চালিত পুতুল সদৃশ হবে৷ শরীর অভ্যন্তরস্থ বিভিন্ন উপকেন্দ্র থেকে শরীরের বিভিন্ন অংশ পরিচালিত হবে৷ এদের কোন স্নায়ুকোষ বা স্নায়ু তন্তু থাকবে না৷ স্নায়ু না থাকায় তারা সাধনাও করতে পারবে না, সুখ–দুঃখের অনুভূতিও থাকবে না৷ তাদের প্রজনন ক্ষমতাও থাকবে না৷ তারা তাদের প্রভুর নির্দেশানুসারে বাধ্য ভৃত্যের মত নিঃশব্দে মানব সেবা করে যাবে৷

যান্ত্রিক মানবের তুলনায় জৈব–মানব হবে অনেক ত্রুটিমুক্ত৷ শুক্রাণু ও ডিম্বাণু –– উভয়েই রাসায়নিক যৌগ হওয়ায় রসায়নাগারেই এদের প্রস্তুত করা সম্ভব হবে৷ শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর নিষিক্তিকরণের ফলে যে ভ্রুণের সৃষ্টি হয় তাও বিশেষ প্রক্রিয়ায় করা সম্ভব হবে৷ এই প্রক্রিয়ার ফলে যে শিশু জন্মাবে তাকেই বলা হবে রসায়নাগার–জাতক৷ এই পদ্ধতিতে নিখঁুতভাবে সমগ্র অবয়ব, এমনকি মস্তিষ্কও সৃষ্টি করা সম্ভব হবে, কিন্তু মানবমন সৃষ্টি করা মানুষের সাধ্যাতীত৷ মানবেতিহাসের স্বাভাবিক বিবর্তন ধারায় যেমন হয়ে এসেছে, ঠিক তেমনি রসায়নাগার জাত ভ্রুণের সঙ্গে প্রকৃতি এক বিদেহী মনকে সংযুক্ত করে’ দেবে৷ রসায়নাগার জাতকরা কেন সংস্কার মুক্ত হবে না, বা পূর্বজন্মের কর্মফল ভোগ করবে তার ব্যাখ্যা এখানেই নিহিত৷ চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে স্বাভাবিক মানুষ অপেক্ষা রসায়নাগার জাতকরা দীর্ঘজীবী হবে৷ ভবিষ্যতে এমনকি এও সম্ভব হবে যে রসায়নাগার জাতকরা তাদের অঙ্গ–প্রত্যঙ্গ খুলে রেখে শুধু মস্তিষ্ক্ নিয়ে যে কোনো জায়গায় চলে যেতে পারবে৷ রসায়নাগার জাতকের বিভিন্ন অঙ্গ পরিবর্ত্তন করাও সম্ভব হবে, কিন্তু মষ্তিষ্ক্ ত্ব্ব্জ্ত্রনুগ্গ পরিবর্তন করা যাবে না৷ কারণ মষ্তিষ্কই সংস্কারের আধার, তাই মস্তিষ্ক্ পরিবর্তনের অর্থই হ’ল ব্যষ্টিত্বের পরিবর্ত্তন৷ মস্তিষ্ক্ স্নায়ুকোষের সমাহার, আর সার্বিকভাবে সেটাই তার ব্যষ্টিত্ব৷ স্নায়ুকোষের মধ্যে পরিবর্ত্তন না এনে অর্থাৎ ব্যষ্টিত্বের পরিবর্তন না করে’ মষ্তিষ্কের পরিবর্ত্তন করা সম্ভব নয়৷

রসায়ানাগার জাতক–ব্যবস্থার অগ্রগতির ফলে প্রকৃতি মানুষের প্রজনন ক্ষমতা হরণ করে’ নেবে, ও তখন আর মানুষ প্রাকৃতিক ভাবে মানুষ সৃষ্টি করতে পারবে না৷ তখন তারা কেবল রসায়নাগার জাতকই সৃষ্টি করবে৷ রসায়নাগার জাতকদের সুখ–দুঃখের অনুভূতি থাকলেও তাদের যারা লালন পালন করবে তাদের প্রতি খুব বেশী টান থাকবে না৷ বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে যেহেতু তারা একটা ট্যাবলেট খেয়েই বেশ কয়েকটি দিন কাটিয়ে দিতে পারবে, সেহেতু তাদের খুব বেশী কায়িক পরিশ্রম করতে হবে না৷ যেহেতু তারা রসায়নাগারে রাসায়নিক যৌগ থেকে সৃষ্ট হবে তাই তাদের মধ্যে পারিবারিক বন্ধনও থাকবে না৷ ক্রমশঃ তাদের মধ্যে জাগতিক সুখভোগের প্রতি অনীহা সৃষ্টি হবে৷ কল্পনা করা অমূলক হবে না যে, এমন একদিন আসবে যখন রসায়নাগার জাতকরা মনে করবে যে প্রকৃতি তার সমস্ত মাধুর্য হারিয়ে ফেলেছে, তারা বেঁচে থাকার উৎসাহ পাবে না, ও খাদ্যেও রুচি থাকবে না৷ এ সম্পর্কে বেশী চিন্তা না করাই শ্রেয়৷ তবে সেই সঙ্গে এও ঠিক যে এই রসায়নাগার জাতকগণ তাঁদের অপূর্ণতা সম্বন্ধে সচেতন থাকবেন, ও মহান সাধক হবেন৷ যেহেতু তাঁদের হাতে অফুরন্ত সময় থাকবে সেহেতু তাঁরা বেশী বেশী করে’ সাধনায় রত থাকবেন৷