শিল্পোন্নয়ন ঃ
প্রাউট শিল্প–ব্যবস্থাকে তিন ভাগে ভাগ করেছে ঃ মূল শিল্প, যা অব্যবহিত বা আঞ্চলিক সরকার (immediate or local government) দ্বারা পরিচালিত হবে মাঝারী শিল্প যা সমবায়ের দ্বারা পরিচালিত হবে ও ক্ষুদ্র শিল্প–যা থাকবে ব্যষ্টির মালিকানাধীন৷ এখানে কোন্ শিল্প সরকারের হাতে থাকবে বা কোনটা ব্যষ্টি মালিকানাধীনে থাকবে এ নিয়ে বিভ্রান্তির অবকাশ থাকবে না বা একই শিল্প পাশাপাশি সরকারী ও ব্যষ্টি মালিকানাধীনেও থাকবে না৷ বিশ্বের অনেক অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে কৃষির ওপর যে অত্যধিক চাপ পড়ছে তা হ্রাস করার ওপর প্রাউট বিশেষ গুরুত্ব দেয়৷ কোন অবস্থাতেই শতকরা ৪০ ভাগের বেশী মানুষকে কৃষিতে নিয়োগ করা উচিত নয়৷ ছোট ছোট শহর বা গ্রামাঞ্চলে প্রচুর সংখ্যায় কৃষি–ভিত্তিক বা কৃষি–সহায়ক শিল্প গড়ে তোলা উচিত৷ শুধু তাই নয় কৃষিকে শিল্পের মর্যাদা দিতে হবে যাতে কৃষি–শ্রমিকরাও বুঝতে পারে তাদের শ্রমের প্রকৃত মূল্য কত?
প্রাউটের মজুরী–নীতি অনুসারে শ্রমের বিনিময়ে প্রাপ্য মজুরী যে কেবল অর্থের মাধ্যমেই নিতে হবে তার কোন মানে নেই, অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বা সেবার মাধ্যমেও মজুরী নেওয়া যেতে পারে৷ অর্থ হিসেবে প্রাপ্য মজুরীর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে উক্ত উপকরণগুলিও ক্রমশঃ বৃদ্ধি করা উচিত৷
প্রাউট কৃষি ও শিল্পে সর্বাধিক আধুনিকীকরণকে সমর্থন করে৷ এই লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্যে যথোপযুক্ত বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে৷ দেখতে হবে আধুনিকীকরণ বা যান্ত্রিকীকরণ যেন বেকার সমস্যার বৃদ্ধি না ঘটায়৷ সর্বদা লক্ষ্য রাখতে হবে যেন জনসাধারণের শতকরা একশ ভাগের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়–যা ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অসম্ভব৷ প্রাউটের সামূহিক অর্থনীতি–ব্যবস্থায় আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে যেমন উৎপাদন বৃদ্ধি করা হবে তেমনি কাজের সময় কমিয়ে সকলের কর্মসংস্থান করা সম্ভব হবে৷
বিকেন্দ্রীকরণ ঃ
ওপরে যে অর্থনৈতিক সংরচনার কথা বলা হ’ল তা বাস্তবায়িত করার জন্যে প্রাউট এক নূতন অনন্য বিকেন্দ্রিত অর্থনীতির পরিকল্পনা দিয়েছে৷ প্রাউট সারা বিশ্বে বিভিন্ন সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলবার সুপারিশ করেছে৷ এই জাতীয় সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠবে একই অর্থনৈতিক সমস্যা, একই ধরণের সম্পদ ও সম্ভাবনা, জাতিগত সাদৃশ্য, সাধারণ ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য, একই সাধারণ (common) সামাজিক সাংস্কৃতিক বন্ধন, যেমন, ভাষা, সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য প্রভৃতির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সেন্টিমেন্ট্যাল লিগ্যাসি (সাংবেদনিক উত্তরাধিকার)–এ সবের ওপর ভিত্তি করে৷ প্রত্যেক সামাজিক–অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার বাস্তবায়নের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে৷ প্রত্যেক সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিকেন্দ্রিত পরিকল্পনাও থাকবে–প্রাউটের ভাষায় যাকে বলা হয় ব্লকভিত্তিক পরিকল্পনা৷ প্রাউটের অর্থনীতি ব্যবস্থায় ব্লক–স্তরীয় পরিকল্পনা পরিষদই হবে সর্বনিম্ন পরিকল্পনা–সংস্থা৷
প্রাউটের সংরচনায় একটি রাজনৈতিক অঞ্চল যেমন প্রদেশ বা রাষ্ট্রে থাকবে সাধারণতঃ একাধিক সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চল৷ দৃষ্টান্ত স্বরূপ ভারতবর্ষের বিহার রাজ্যে ৫টি সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠতে পারে৷ যথা–অঙ্গিকা, মগ্হী, মৈথিলী, ভোজপুরী ও নাগপুরী৷ উপরিউক্ত নীতিতে সম্পূর্ণ ভারতবর্ষকে প্রায় ৪৫টি সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিভক্ত করা যায়৷ এই অঞ্চলগুলিকে তাদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও কর্মপন্থা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে পুরোপুরি অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জন করার পূর্ণ স্বাধীনতার গ্যারান্টী থাকা উচিত৷
যদি এই সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলি তাদের সর্বাত্মক সামাজিক–সাংস্কৃতিক– অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের জন্যে পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচী গ্রহণ করে তাহলে সারা ভারতবর্ষে এক ব্যাপক সামাজিক–অর্থনৈতিক জাগরণ দেখা দেবে৷ সমস্ত জনসাধারণ–কি ধনী, কি দরিদ্র, কি যুবক, কি বৃদ্ধ, কি শিক্ষিত, কি অশিক্ষিত–সবাই শোষণ–বিরোধী সেন্টিমেন্টের দ্বারা উৎসাহিত হয়ে সামাজিক–অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্যে এক শক্তিশালী আন্দোলন শুরু করবে৷ যারা এক সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলে বাস করে তারা যদি ব্যষ্টিগত সামাজিক–অর্থনৈতিক স্বার্থকে সমষ্টিগত সামাজিক–অর্থনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়, তবে যে কোন অঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্পদের বহিঃস্রোত বন্ধ হয়ে যাবে ও সঙ্গে সঙ্গে শোষণেরও মূলোৎপাটন সম্ভব হবে৷
প্রাউটের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় স্থানীয় জনসাধারণের পূর্ণ কর্মসংস্থানের অধিকারের নিশ্চিততা থাকবে৷ কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে স্থানীয় জনসাধারণ বহিরাগতদের থেকে অগ্রাধিকার পাবে৷ যেখানে যথাযথ ভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে না সেখানেই দেখা দেয় উদ্বৃত্ত শ্রম৷ বস্তুতঃ প্রত্যেকটি অনুন্নত অর্থনৈতিক অঞ্চলে থাকে উদ্বৃত্ত শ্রম৷ যদি এক অর্থনৈতিক অঞ্চলের উদ্বৃত্ত শ্রমিকরা কর্মের সন্ধানে অন্য অঞ্চলে চলে যেতে থাকে, ওই উদ্বৃত্ত শ্রম–এলাকা চিরদিনই অনুন্নত থেকে যাবে৷ যেখানে উদ্বৃত্ত শ্রম আছে সেখানে অবিলম্বে উদ্বৃত্ত শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে৷ স্থানীয় জনসাধারণের কর্মসংস্থান করার সময় স্থানীয় সেন্টিমেন্টের কথাও বিবেচনা করতে হবে৷ কোন সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চলের সম্ভাবনার ওপরে ভিত্তি করে কৃষি–ভিত্তিক ও কৃষি–সহায়ক শিল্প গড়ে তুলতে হবে৷ এ ছাড়া এই অঞ্চলের সামূহিক প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে অন্যান্য শিল্পও গড়ে তোলা উচিত৷ এই নীতি নূতন কর্মসংস্থানের বিরাট সুযোগ এনে দেবে৷ কর্মসংস্থানের এই পদ্ধতির মাধ্যমে স্থানীয় জনসাধারণের জীবন ধারণের মনোন্নয়ন সম্ভব হবে৷ (ক্রমশঃ)