প্রভাত সঙ্গীত কী ও কেন?

লেখক
পত্রিকা প্রিতিনিধি

 

সংস্কৃতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হ’ল সঙ্গীত৷ নিম্নমানের সঙ্গীত যেমন মানুষের অন্তর্নিহিত পশুভাবকে জাগিয়ে তোলে তেমনি উচ্চমানের সঙ্গীত মানুষের ভিতরে সুপ্ত দেবভাবকে জাগিয়ে তোলে৷ বর্তমান সমাজের সর্বাত্মক অবক্ষয় থেকে সঙ্গীত জগৎও রেহাই পায়নি৷ এই অবক্ষয়কে রোধ করে সংস্কৃতির আঙ্গিনায় নূতন প্রভাতের আবির্ভাব হ’ল শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী তথা শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের রচিত ‘প্রভাত-সঙ্গীত’৷ মোট ৫০১৮টি প্রভাত-সঙ্গীত রচনা ও সুর তাঁরই সৃষ্টি৷

গানের স্তম্ভ হচ্ছে চারটি --- ভাব, ভাষা, সুর ও ছন্দ৷ এর মধ্যে ভাষার আবেদন সীমিত হলেও ভাব, ছন্দ ও সুরের আবেদন সর্বজনীন৷ প্রভাত-সঙ্গীত আটটি ভাষায় রচনা করেছেন, যথা- বাংলা, হিন্দী, ইংরেজি, সংস্কৃত, অঙ্গিকা, উর্দু, মৈথিলী, মগহী ভাষায় রচনা করেন৷

প্রভাত-সঙ্গীতের অধিকাংশ গানগুলির মধ্যে মিষ্টিকবাদের ধবনি অনুরণিত হয়েছে৷ মিষ্টিকবাদ কী? অসীমের সঙ্গে সসীমের সম্বন্ধ নির্ণয়ের যে সীমাহীন প্রয়াস তা-ই মিষ্টিকবাদ৷ আর এই কারণেই প্রভাত-সঙ্গীতের গানগুলি এতই মাধুর্য মণ্ডিত হয়েছে যে সেগুলি ভারতের সীমানা পেরিয়ে বিশ্ব সংস্কৃতির বিশাল অঙ্গনে স্থান করে নিতে পেরেছে৷ তবে প্রভাত-সঙ্গীতের ভিত মিষ্টিকবাদ হলেও মানব জীবনের অপরাপর দিকের ভাবনাও এতে স্থান পেয়েছে৷ তাই দর্শন-চিন্তা ও অধ্যাত্ম-চিন্তা থেকে শুরু করে সমাজ চেতনা, আশাবাদ, নব্যমানবতাবাদ, নিসর্গ, প্রকৃতি, স্বপ্ণ, সামাজিক অনুষ্ঠান, ভক্তিগীতি, ভাব সঙ্গীত, ঋতু পর্যায়ের, গণসঙ্গীত, দেশপ্রেম, ঝুমুর, বাউল, কীর্তন ও ভাঙা কীর্তন, গজল ও ভাঙা গজল, কাওয়ালি, শিবগীতি, কৃষ্ণবিষয়ক, রূপকথা ও জীবনীমূলক গানও এতে স্থান পেয়েছে৷ প্রভাত-সঙ্গীতের মধ্যে ভাষার যে বলিষ্ঠতা ও ব্যাপকতা, ভাবের যে গভীরতা, ছন্দের যে বৈচিত্র্য ও সুরের যে হৃদয়স্পর্শিতা প্রকাশ পেয়েছে তা গানের জগতে অদ্বিতীয়৷ আজ ভোগবাদ বা জড়বাদ সর্বস্ব অসংস্কৃতির (অপসংস্কৃতিব্যাকরণ অশুদ্ধ) মত্ত দানব তার নাগপাশ বিস্তার করে সমগ্র মানব সংস্কৃতির পরিবেশকে অসুস্থ ও অস্বাস্থ্যকর করে তুলেছে৷ এর ফলে মানুষের মেরুদণ্ড ভেঙে যাচ্ছে, মানুষ হীনবল হয়ে পড়ছে৷ অসংস্কৃতির এই বিষাক্ত পরিবেশের বিরুদ্ধে সমাজ সচেতন সকল মানুষকেই সরব ও গর্জে উঠতে হবে৷ শুধু নিন্দা করে এর গতিরোধ করা যাবে না৷ উচ্চ ভাবধারার স্পর্শে মানুষের মনের কালিমাকে দূর করতে হবে৷ জ্যোতির্ময় পুরুষের আলোয় মনের অন্ধকারকে সরিয়ে তা আলোয় ভরে দিতে হবে৷ দর্শনের জগতে আনন্দমার্গ দর্শন, অধ্যাত্মসাধনার জগতে আনন্দমার্গের সাধনাপদ্ধতি, সামাজিক-অর্থনৈতিক জগতে ’প্রাউট’ দর্শন, সামাজিক-বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে ’নব্যমানবতাবাদ’ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী যেমন অসাধারণ সৃষ্টি, সঙ্গীতের জগতে তেমনি ’প্রভাত-সঙ্গীত’ তাঁরই আরেক অতুলনীয় অবদান৷ প্রভাত সঙ্গীতের যে সর্বস্পর্শী আবেদন তা কারোর পক্ষে উপেক্ষা করা সহজ হবে না৷ জীবনে-মরণে, ব্যথা-বেদনায়, হাসি-কান্নায়, সুখে-দুঃখে-হতাশায় এই গান তাকে অফুরন্ত প্রেরণা জোগাতেই থাকবে৷

১৯৮২সালের ১৪ই সেপ্ঢেম্বর ঝাড়খণ্ডের দেওঘরে প্রভাত-সঙ্গীতের রচনা শুরু করেন আর ১৯৯০সালে ২০শে অক্টোবর (মহাপ্রযয়াণের পূর্ব দিন) রাত্রি সাড়ে এগারটায় প্রভাত-সঙ্গীতের শেষ ৫০১৮সংখ্যক গানটি রচনা করেন৷ গানটি ছিল প্রস্তাবিত আনন্দমার্গ গুরুকুল(বিশ্ববিদ্যালয়) সম্পর্কিত৷