প্রভাত সঙ্গীতের স্রষ্টার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি

লেখক
খগেন্দ্রনাথ দাস

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

প্রভাত সঙ্গীতের নানা বৈচিত্র্য ছাড়াও অন্য একটি বিস্ময়কর দিক স্রষ্টার প্রতিভা প্রকাশের বয়স৷ ১৯৮২ সনের ১৪ই সেপ্ঢেম্বর সন্ধ্যার সেই মুহূর্তটির আগে পর্যন্ত একথা তেমনভাবে কেই জানতেনই না যে  তিনি একজন গীতিকার ও সুরকার৷ এটা বিস্ময়ের ও অপার রহস্যের বিষয় যে জীবনের প্রথম ছটি দশক সঙ্গীতের এই অনন্য প্রতিভা, সঙ্গীতের এক দুর্র্বর স্রোতস্বিনী ধারাকে কেন ও কীভাবে গোপন রেখেছিলেন?

এ প্রসঙ্গে প্রভাতসঙ্গীতের বিশিষ্ট গবেষক বর্তমানে অসমের  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক অমলেন্দু চক্রবর্তীর ‘‘ভারতীয় সংসৃকতির আলোকে প্রভাতসঙ্গীত’’ গ্রন্থ থেকে একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরার লোভ সম্বরণ করতে পারছিনা৷ শ্রী চক্রবর্তী লিখেছেন--- অবশেষে জীবনের গোধূলি আলোকে সেই বাক্ এসে নিজে থেকে ধরা দিলেন এই প্রতিভার কাছে৷ তারই ফলশ্রুতি ‘কল্পনাটি গেল ফাটি হাজার গীতে’ প্রশ্ণ জাগে কেন এই বৌদ্ধিক চেতনা অবশেষে বোধির জগতে এসে সঙ্গীতের শত তরঙ্গে অবগাহিত হলো? কী প্রয়োজন ছিল সঙ্গীত সৃষ্টির? এর উত্তরে শ্রী চক্রবর্তী লিখেছেন, ---দিন গণনার কোন অতীত ইতিহাসে আর্য ঋষিরাও সেই অমর্ত্যকে, সেই ধরাছোঁয়ার অতীতকে কেবল গানে গানে স্পর্শ করতে চেয়েছিলেন বলেছিলেন আমাদের এই স্তবগান শুনে তুমি খুশি হও, গ্রহণ করো আমাদের এই স্তোত্র-অঞ্জলি, ইয়ং স্তোমং জষস্ব নঃ৷’’

সঙ্গীত সৃষ্টির এই উচ্ছলতাকে একমাত্র বেদের ঋষির কল্পনার সঙ্গেই তুলনা করা যায়, যেখানে ঋষি বলছেন, ‘‘অভ্রাদ্ বৃষ্টিরিবাজানি৷’’ (ঋক্বেদ,৭/৯৪/১) হ্যাঁ এভাবে শ্রাবণের  ধারার মতোই পাঁচ সহস্রাধিক সঙ্গীতের নির্ঝরিণী দুর্নিবার ও সাবলীল গতিতে নেমে এসেছিল প্রভাতরঞ্জনের কন্ঠ বেয়ে৷ এ যেন সঙ্গীত স্রষ্টা নন বাকদেবী  নিজেই প্রভাতরঞ্জনের কন্ঠকে আশ্রয় করে কৃতার্থ হতে চেয়েছেন৷ অত্যাশ্চর্য বিষয় এই যে, সঙ্গীত সৃষ্টির জন্য অন্যান্য স্রষ্টাদের মতো তাঁকে প্রকৃতির আনুকূল্যের অপেক্ষা করতে হয়নি৷ রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন, ‘‘শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে সুরটি আমার মুখের পরে বুকের পরে৷’’এভাবেই সঙ্গীত ঝরেছে তাঁর কন্ঠ  হতে৷ এরই বাস্তব প্রতিফলন আমরা প্রত্যক্ষ করেছি প্রভাতসঙ্গীতের সৃজন মুহূর্তগুলিতে৷

রবীন্দ্রনাথ অন্যত্র বলেছেন, ‘‘আমি তোমাকে ভালোবাসি এই কথাটা সুর ছাড়া অন্য কোনোভাবে এত মধুর করে প্রকাশ করা যায় না৷’ সঙ্গীত এমন একটি মাধ্যম যার মধ্য দিয়ে সঙ্গীত স্রষ্টা তাঁর কথাকে অত্যন্ত সহজতম উপায়ে শ্রোতার হৃদয়ে গেঁথে দিতে পারেন৷ হয়তো এ জন্যই ধর্ম, দর্শন, অর্থনীতি, সমাজনীতি, বিজ্ঞান,শিক্ষা, নব্যমানবতাবাদ থেকে শুরু করে ষড়ঋতু, জন্মদিন থেকে বর্ণময় সামাজিক অনুষ্ঠান তাঁর জীবনজোড়া সমস্ত ঐকান্তিক ইচ্ছাগুলিকে তিনি সঙ্গীতের মাধ্যমে প্রকাশ করে যাওয়াকেই শ্রেয় বলে বিবেচনা করেছেন৷

তাছাড়া প্রভাতসঙ্গীতের স্রষ্টার মনোজগতে প্রবাহিত প্রাণবন্ত  ধারাটিকে প্রকাশ করার জন্য সঙ্গীত ছাড়া অন্য মাধ্যম আর কী ই বা হতে পারতো? তাই তো সঙ্গীতকেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন, ‘‘শেষ পারাণির কড়ি’’ হিসেবে৷ তিনি তাঁর সমগ্র দর্শনচিন্তায় যেসব বিষয় সন্নিবিষ্ট করেছেন সে সবগুলিকেই প্রকাশ করেছেন সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে৷ উদাহরণ নিবন্ধের  কলেবরকে দীর্র্ঘয়ত করবে জেনেও দুয়েকটির উল্লেখ থেকে নিজেকে সংযত করা গেলো না৷

ঋক্বেদের বাষট্টিতম সূক্তের দশম ঋকে ঋষি বিশ্বামিত্র প্রার্থনা জানাচ্ছেন---

‘‘তৎ সবিতুর্বরেণ্যং ভর্র্গে দেবস্য ধীমহি৷ ধিয়ো যো ন প্রচোদয়াৎ৷৷’’ (যিনি আমাদের ধীশক্তি প্রেরণ করেন, আমরা সে সবিতাদেবের সেই বরণীয় তেজ ধ্যান করি৷) আর্য ঋষির এই প্রার্থনা মন্ত্রের ধবনিই প্রতিধবনিত হয়েছে প্রভাতসঙ্গীতের প্রথম গীতিতে---

‘‘বন্ধু হে নিয়ে চলো আলোর ঐ ঝর্ণা ধারার পানে৷’’

৪৫২৯ সংখ্যক গানটির শেষ অন্তরা যেখানে তিনি বলছেন--- ‘‘যবে কিছু ছিল নাকো একলা তুমিই ছিলে, হে পুরুষোত্তম কী করে ’ ধরা রচিলে/ কিসের আশে এক থেকে অনেক হলে, এ প্রশ্ণের উত্তর নাই৷’’ সঙ্গীত স্রষ্টা সুরের মাধ্যমে যেভাবে এক কঠিন চিরন্তন আধ্যাত্মিক, দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক প্রশ্ণের সমাধান দিয়েছেন তা সত্যিই অতুলনীয়৷ জড় বিজ্ঞানে এর সঠিক উত্তর বিজ্ঞানীরা আজও খুঁজে চলেছেন৷ শুধু তাই নয় আশার কথা যে তাঁরাও নেতি নেতি এই  দিকেই এগিয়ে চলেছেন৷

৪৫৩৭ সংখ্যক সঙ্গীতটির দিকে লক্ষ করুন৷ বিশ্বস্রষ্টা কোথায় আছেন দর্শন ও জড়বিজ্ঞান উভয়ের কাছেই এ এক জটিল প্রশ্ণ৷ প্রভাত সঙ্গীতের স্রষ্টা অত্যন্ত সহজ শব্দে এই প্রশ্ণের সর্বজনগ্রাহ্য উত্তর দিয়েছেন৷ যা পদার্থবিজ্ঞানীরাও অস্বীকার  করতে পারছেন না৷ ‘‘তুমি নেই কোনখানে গো বলে মোরে বলা মোরে/যেদিকে তাকাহ তোমাকেই পাই সরিতা-সায়রে গিরিশিরে/আছো অনলে অনিলে দূর নভোনীলে, ভূধরে নীহারে বিটপীর মূলে/ মারব সাগরে শষ্প শ্যামলে বিভীষিকাময় তিমিরে/ যে মৌলিক সত্তা থেকে প্রপঞ্চময় জগতের  উৎপত্তি সেই সত্তা সৃষ্ট সমস্ত বস্তুর মধ্যে থাকবেন এর চেয়ে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আর কি হতে পারে? এভাবেই প্রভাতরঞ্জন সরকার  তাঁর সমগ্র দর্শন চিন্তাকে সাধারণ মানুষের জন্য সহজবোধ্য সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে রেখে গেছেন৷

হে সহস্রশীর্ষ প্রচেতা পুরুষ, মহান সঙ্গীত স্রষ্টা, তোমার জন্ম শতবর্ষে অসংখ্য গুণীজনের নিবেদিত শ্রদ্ধার সঙ্গে আমরাও নিবেদন করছি আমাদের ক্ষুদ্র শ্রদ্ধাঞ্জলি৷

সঙ্গীত সৃষ্টির প্রতিভা প্রভাতরঞ্জন সরকার-এর জীবনের সবটুকু  নয় বরং একটা ক্ষুদ্র অংশ মাত্র ৷ ‘দৃঢ়প্রতিজ্ঞা, বিশ্বহিতৈষণা, সত্যচারিতা, বলিষ্ঠতা, অসীম আত্মপ্রত্যয় ইত্যাদি চারিত্রিক বৈষিষ্ট্যে বিশিষ্ট প্রভাতরঞ্জন সরকার-এর জীবনালেখ্য৷’ পোষাক-পরিচ্ছদে নিখাদ বাঙালি ভদ্রলোক কিন্তু চিন্তা জগতে উপর্যুক্ত মৌলিকতার বিচারে তিনি বিশ্বমানব৷ আর এইসব মৌলিকতার মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে তাঁকে, যা খুঁজে চলেছেন বিশ্বের বহু প্রাজ্ঞজন৷