পরিবেশ ও আমরা

লেখক
প্রবীর সরকার

পরিবেশ ভাবনা আজ  বিশ্বজুড়ে৷ পৃথিবী শুধু মানুষের জন্য  নয়৷ আকাশ ,মাটি, সাগর নদী বন জঙ্গল, জলজ ও স্থলজ উদ্ভিদ , পশু-পক্ষী, কীট পতঙ্গ, সবার আছে এ বিশ্বে সমান অধিকার৷ কাউকে  বাদ দিয়ে চলার উপায় নেই৷  কাউকে  ধবংস করে চলার  চেষ্টা মানেই  প্রাকৃতিক  অবস্থার  ভারসাম্য  হারানো৷ যেহেতু  মানুষ সৃষ্টির সবচেয়ে উন্নত জীব তাই প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার  দায়িত্ব রয়েছে তার বেশী৷

মানুষ আজ তাই নির্বোধের  মত নির্বিচারে  গাছ কাটার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছে৷ যত্রতত্র রাসায়নিক বর্জ্যপদার্থ ফেলা, ধোঁয়া-ধূলো ও ক্ষতিকর  গ্যাসের  প্রভাব বা শব্দদূষণের  বিরুদ্ধে মানুষ আজ সচেতন হচ্ছে৷ অর্থাৎ এক কথায়  বলা যেতে পারে যে বিশ্বের মানুষ তার পরিবেশকে  দূষণমুক্ত ও সুন্দর করে তুলতে  চায়, যাতে  আগামী প্রজন্মের  মানুষ সুন্দর ও সুস্থ বিশ্বকে পায়৷

কিন্তু যে পরিবেশটা না হলে  কোন পরিবেশ নিয়েই আন্দোলন  সার্থক ও সুন্দর  হয় না তা হলো মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের  পরিবেশ৷ বর্তমানের  পরিবেশ  আন্দোলনের বয়স ত্রিশ বছরের বেশী নয় কিন্তু  মানুষের সুসম্পর্কের  আন্দোলন বহু বছরের৷ সদাশিব থেকে বুদ্ধ, চৈতন্য, নানক, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ পর্যন্ত সকলেই চেয়েছিলেন মানুষের  সাথে মানুষের সম্পর্ক প্রেম ও প্রীতির  উপর প্রতিষ্ঠিত হোক৷ হজরত মহম্মদ, যিশুখৃষ্টও প্রচার করে গেছেন  প্রেম ও প্রীতির কথা৷

যিশুখৃষ্ট উপদেশ দিলেন--- ‘‘তোমার  প্রতিবেশীকে ঈশ্বর ভাবো’’৷ ভারতের উপনিষদ শেখালো ‘‘যত্র জীবঃ তত্র শিবঃ৷

কিন্তু বিস্ময়ের  বিষয় যে  পৃথিবীর মানুষ আজ সেই আন্দোলন থেকে বহু ক্রোশ দূরে৷ মানুষ যদি তাঁর পাশের মানুষকে প্রকৃত অর্থে ভালবাসতে  না পারে  তবে  আজকের  পরিবেশ  আন্দোলন মেকী ছাড়া  আর  কিছুই  হতে পারে না৷

গাছ কাটার  বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে উঠবে অথচ উৎসবের  সকাল থেকে শুরু  হবে হাজার হাজার  নিরীহ  প্রাণীর  হত্যা  ---শুধুমাত্র রসনা তৃপ্তি জন্য ‘‘যুদ্ধ নয় শান্তি চাই’’ অথচ রাজনৈতিক জমি দখলের লড়াইতে অপর দলের মুণ্ডু চাই ধর্মের মৌলবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোল আর রাজনৈতিক  মৌলবাদের বিরুদ্ধে সরব হওয়া যাবে না--- এ ভাবনা কখনই  মানুষের  সাথে  মানুষের সম্পর্কের উন্নতি করতে পারে না৷

আজকের সমাজে হিংসার উন্মত্ততা, স্বার্থ সিদ্ধির যে কোন উপায়কে  গ্রহণ করে বড় হবার তীব্র বাসনা--- আজকের সমাজের  পরিবেশকে  করে তুলেছে বিষাক্ত৷ চারিদিকে গোপন হিংসা আর  প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে  বিচারের বাণী নীরবে  নিভৃতে আজও কাঁদে৷

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়---

‘‘শুণি তাই আজি

মানুষ-জন্তুর হুংকার দিকে দিকে উঠে বাজি৷

তবু যেন হেসে যাই যেমন হেসেছি  বারে বারে

পণ্ডিতের মুঢ়তায়, ধনীর দৈন্যের অত্যাচারে

সজ্জিতের রূপের বিদ্রূপে৷’’

 মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক তখনই  প্রীতি আর ভালবাসার হয়ে উঠবে  যখন শিশুকাল থেকে সে জেনে আসবে  পশু-পক্ষী তার খাদ্য নয়, প্রতিবেশীর প্রতি ঈর্র্ষবোধ বা হিংসাবোধ তার মনকে বিভ্রান্ত করে তুলবে না৷ কোনো রকম ভয় তার মনে কোন ‘‘কমপ্লেক্স’’ তৈরী করবে না৷ সর্বত্রই সে সকল অবস্থাকে অনুকুল ভাবে গ্রহণ করবে৷

মহাপুরুষরা বিশ্বের মানুষের  জন্য মাথা খুঁড়ে গেছেন  যাতে মানুষ পশু না হয়ে যায়৷ মানুষ যাতে দেবত্বে আসীন হতে পারে এই ছিল তাঁদের  কামনা--- তাঁদের বাণী৷

তাঁদের বাণী আজ আমরা বইতে পড়ছি, বহু সভাসমিতিতে বত্তৃণতাও দিচ্ছি তবু নিজেকে ঈর্র্ষ-মুক্ত করতে পারিনি, পারিনি হিংসাকে দূরে  সরিয়ে দিয়ে অহিংসুক  হতে অথবা সকলপ্রকার  জড়তা-ভয়কে জয়  করতে৷

আজ তাই দরকার মানুষের মধ্যে  প্রেম ও প্রীতির সম্পর্কের  পরিবেশ গড়ার আন্দোলন আর এই আন্দোলন হলো  বিশ্বের সকল মানুষকে  অধ্যাত্মবাদে উদ্বুদ্ধ করা৷ একমাত্র  অধ্যাত্মবাদই মানুষকে  দেবত্বে পৌঁছে দিতে পারবে৷

জন্মগত বৃত্তির (Propensities) তাড়নায় মানুষ হিংসা, ঈর্র্ষ,ক্রোধ, ভয়ের বশীভূত হয়ে পড়ে ৷ অধ্যাত্মবাদের বৈজ্ঞানিক অনুশীলনের মধ্য দিয়ে সে নিজের বৃত্তিকে  সুস্থ ও সংযত  রাখতে সক্ষম হবে৷

কারণ মানুষের  বৃত্তিগুলোর (Propensities) প্রকাশের  প্রকৃতি  নির্ভর করে  তার শরীরের গ্ল্যাণ্ডস ও সাবগ্ল্যাণ্ডসের  রস (Hormone) নিঃসরণের  উপর৷ রস নিঃসরণের  স্বাভাবিক  অবস্থার পরিবর্তন ঘটলে মানুষের  নার্ভসেলেরও পরিবর্ত্তন ঘটে  যায়৷ ফলে মানুষের  সাথে মানুষের সম্পর্কের  ক্ষেত্রে অস্বাভাবিকতা দেখা যায়৷

তাই মানুষের  বৃত্তিগুলো যথা--- ঈর্র্ষ, ঘৃণা, ভয়, লজ্জা, আশা, চিন্তা মমতা, দম্ভ ইত্যাদিকে  সঠিকভাবে পরিচালিত করতে হলে ব্যষ্টিকে অবশ্যই তার গ্লাণ্ডগুলোকে যথা--- গোনাড (Gonads), প্রোষ্টেট Prostrate) থাইরয়েড Thyroid) পিনিয়াল Pineal), ইত্যাদি গ্লাণ্ডস্গুলো থেকে  নিঃসরিত রস (Hormone), যাতে  কম বা বেশী না হয় তার জন্য অবশ্যই  ব্যবস্থা নিতে  হবে৷ এই ব্যবস্থাই  হলো যোগসাধনা, যোগাসন, প্রাণায়াম ইত্যাদি  যা অধ্যাত্মবাদের অঙ্গ৷

যোগসাধনা হলো--- চঞ্চল মনকে মহাভাবে একাগ্র করা৷ যোগাসন হলো--- শরীর মন গ্লাণ্ডস নার্ভ ইত্যাদির  ব্যায়াম আর প্রাণায়াম হলো--- শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ৷

আধ্যাত্মবাদ মানুষকে বিশ্বজনীন করে তোলে,  কোনপ্রকার সংকীর্ণতা, সাম্প্রদায়িকতা  বা মৌলবাদের ভাবনা তাকে ভাবিত না করে৷ অধ্যাত্মবাদই  আজকের ভোগবাদের অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতার  হাত থেকে মানুষের মনুষ্যত্বকে  বাঁচাতে পারে৷ মানুষের  মধ্যে প্রেম-প্রীতির সম্পর্ক গড়ে তোলার পরিবেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম৷ আধ্যাত্মিকতার শিক্ষা দেয় ---

‘‘মানুষ যেন মানুষের তরে সব কিছু করে যায়৷

একথাও যেন মনে রাখে পশুপাখী তার পর নয়

তরুও বাঁচিতে চায়৷৷

অন্ধকারে পথ হারাইয়া কেন  বা  মরিবে কাঁদিয়া৷

আমাদের আশার যত ভালবাসা

 কাছে টেনে নেবে তায় ৷৷

অনশনে অশিক্ষাকে দগ্দভারে বহ্ণিজ্বালাতে

সবারে নিয়ে আশ্রয় দিয়ে রচিব এ অলকায়৷৷’’

(প্রভাত সঙ্গীত)