সৃষ্টির প্রারম্ভের আগের কথা৷ সে সময় দেশ–কাল–পাত্রের মত সাপেক্ষ সত্তা ছিল না৷ একমাত্র ছিল অখণ্ড অসীম, বৃহৎ, সর্বব্যাপী সত্তা, আর সেই সত্তার সাক্ষিত্বরূপে ছিলেন পরমপুরুষ৷ সেই অখণ্ড সৃষ্টির রচয়িতা পরমপুরুষ নিজেকেই অনেক রূপে নানাপ্রকারে অভিব্যক্ত করলেন৷
‘‘ত্বং স্ত্রী ত্বং পুমানসি, ত্বং কুমার উত বা কুমারী৷
ত্বং জীর্নোদণ্ডেন বঞ্চয়সি ত্বং জাতো ভবসি বিশ্বতোমুখঃ৷’’
‘‘নীলঃ পতংগো হরিতো লোহিতাক্ষ
স্তত্তিদ্গর্ভ ঋতবঃ সমুদ্রাঃ৷
অনদিমত্বং বিভুত্বেণ বর্ত্তসে
যতোজাতানি ভুবনানি বিশ্ব৷৷’’
‘হে পরমপুরষ এই ব্যক্ত জগৎ তোমারই এক অভিব্যক্তি৷ এই বিশ্বের প্রতিটি সত্তা তোমারই স্বরূপ৷ এই অণু অভিব্যক্তি তোমারই ভূমামনের অংশ৷ যদি সব তোমারই রূপ তবে কারোর ওপর ক্রোধ, কারোর প্রতি ঘৃণা, কাউকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার অধিকার আমাদের নেই৷ তুমি কাউকে হেয় ভাবতে পার না৷ অমুক ব্যষ্টি, অমুক নাম, অমুক দেশ, এগুলি অন্যের থেকে উঁচু বা নিচু, একথা বলা কি উচিত হতে পারে?’
কোনো কোনো গোষ্ঠীতে মহিলাদের স্থান নিম্নস্তরে ধরা হয়৷ তাদের মতে, পরমপুরুষই মহিলাকে পুরুষ অপেক্ষা নিম্নস্তরের করে সৃষ্টি করেছেন৷ এটা সম্পূর্ণ ভুল, অসত্য৷ পুরুষের অহংকার, মহিলাদের ওপর শাসন করার তাদের আকাঙক্ষা, এর থেকেই এই অনুচিত ধারণার সৃষ্টি হয়েছে৷ স্ত্রীজাতি কি সেই পরমপুরুষের অভিব্যক্তি নয়? সেই পরমপুরুষই কি মহিলারূপে অভিব্যক্ত হননি? স্ত্রী কি পরমপিতার কন্যা নয়? পুরুষ হোক বা স্ত্রী হোক্ অথবা ছোট বালক হোক্, সবকিছু তো তিনিই, তাঁরই রূপ৷ আর তিনি হলেন এই সব অসংখ্য ছোট–ছোট সীমিত সত্তার সমষ্টিরূপ৷ এই সমষ্টিরূপকেই আমরা বলি–বিশ্বরূপ৷ এই বিশ্বরূপ কতই না সুন্দর, কারণ তা অসংখ্য ছোট–ছোট সুন্দর–সুন্দর অণুসত্তা নিয়ে গঠিত৷ প্রত্যেক অণুসত্তা সেই সুন্দর পরমতত্ত্বের প্রতীক৷
হে পরমপিতা, তোমার প্রত্যেক অভিব্যক্তি সর্বতোমুখী, সর্বব্যাপী, সর্বজ্ঞ সর্বশক্তিমান, সর্বসাক্ষী৷ তোমার ভক্তরা এইসব অভিব্যক্তির মধ্যে তোমারই রূপ দেখে৷ সর্বত্র তুমিই তাদের নজরে আস৷ হরিৎ, নীল, নানা রঙে সজ্জিত এই সৃষ্টির প্রতিটি জীবের মধ্যে তুমিই আছ আবার ভয়ানক প্রলয়, মেঘের বজ্র গর্জন তোমারই সত্তার আভাস মাত্র৷ তুমি অসীম, অনন্ত আর এই সীমাহীনতার আধারও তুমি নিজেই৷
পরমপুরুষ এই সৃষ্টি কেন নির্মাণ করলেন? আনন্দপ্রাপ্তির জন্যে–কেবল আনন্দপ্রাপ্তির জন্যে অর্থাৎ এই সৃষ্টির উৎপত্তির মূল কারণ–কেবল মাত্র আনন্দ লাভ৷ প্রত্যেক ব্যষ্টির হৃদয়ে এই আনন্দপ্রাপ্তির অভিলাষ আছে, আর এই আনন্দপ্রাপ্তির খোঁজ করা প্রত্যেক ব্যষ্টির পরম কর্তব্য৷
দীর্ঘ দিন ধরে ভক্ত আর জ্ঞানীর মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব চলে আসছে৷ এই লড়াই প্রাচীনকাল থেকেই চলছে আর ভবিষ্যতেও চলতে থাকবে৷ এই লড়াইয়ের বিষয় কী? জ্ঞানী বলেন, জ্ঞানের দ্বারাই পরমপুরুষকে পাওয়া যায়৷ জ্ঞানই শ্রেষ্ঠ৷ নিজের বুদ্ধি দিয়ে আমি তাঁকে পরিমাপ করব৷ এই জ্ঞানী মানুষদের নিজের বুদ্ধির খুব অহংকার, গৌরব৷ কিন্তু সে ভুলে যায় যে এই বুদ্ধি, এই বিচারশক্তি, চিন্তন ক্ষমতা সব কিছু একটা ছোট্ট মস্তিষ্কে, ক্রেনিয়ামে সমাবৃত রয়েছে৷ এই ছোট্ট ক্রেনিয়ামের সাহায্যে জ্ঞানি ব্যষ্টি ওই অনন্ত পরমপুরুষকে জানতে চায়৷ এই রকমের চিন্তার কারণেই তথাকথিত জ্ঞানি ব্যষ্টি খুব অহংকারী হয়৷ কিন্তু এই অহংকার সে থেকে কী পায়? কী ফলপ্রাপ্তি হয় এই অহংকারের? নিজের পাণ্ডিত্য দেখাবার জন্যে নিরর্থক বক্বক্, কর্মশূন্যতা আর আলস্য৷
কিন্তু ভক্ত কী বলে? ভক্ত বলে আমি কী নিয়ে অহংকার করবো–নিজের বুদ্ধির? এই বুদ্ধি, এই মস্তিষ্ক্, এই মজ্জা–সব কিছুতো সেই পরমপুরুষেরই তৈরী৷ তাহলে এই সব সীমিত উপকরণের সাহায্যে আমি কী কখনও এই উপকরণগুলোর সৃষ্টিকর্তাকে জানতে পারি? আর তাঁকে জেনে করারই বা কী আছে? সব থেকে বেশি আনন্দ পাওয়া যায়–নিজেকে তাঁর চরণে সমর্পণ করায়, নিজের অহংকে তাঁকে সমর্পিত করার মধ্যে৷ এই প্রকার লড়াই হ’ল ভক্ত আর জ্ঞানীর৷