শাস্ত্রে বলা হয়েছে, ‘প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্ণেন সেবয়া’–মানুষ প্রণিপাত, পরিপ্রশ্ণ ও সেবা–এই তিনের সহায়তায় অর্থাৎ এই তিনের সমন্বয়ে পরমপুরুষের কাছে পৌঁছতে পারে৷ সাধক জীবনে সেবা তাই অনিবার্য৷ সেবার ভাবনা না থাকলে, দরজা বন্ধ করে বিশ ঘণ্ঢা সাধনা করলেও কোনো উন্নতি হবে না কারণ পরমপুরুষের আসন তোমার হৃদয়েও আছে, আবার বাইরেও আছে৷ তুমি ভিতরের আসনকে উজ্জ্বল করতে চাইবে, সেখানে দীপ জ্বালাবে আর বাইরের আসনকে অন্ধকারে রেখে দেবে, এতে কাজ হবে না৷ দীপ ভিতরেও জ্বালাতে হবে, বাইরেও জ্বালাতে হবে৷
দেখ, প্রাচীনকালে মানুষ ধর্ম মানে বুঝতেন মজহবী ধর্ম৷ সংসার ধর্ম মানে যা বুঝতেন তাতে দুনিয়া ক্ষিদেয় মারা পড়লে বা নরকে গেলেও কেউ কিছু ভাবত না, নিজের আত্মিক উন্নতিটাই বড় কথা ছিল৷ আমি তাই স্পষ্টভাবেই বলছি, প্রকৃত অর্থে ধর্ম আগে ছিল না৷ আজ ধর্মের জয় হচ্ছে৷ মানুষ সমাজৰদ্ধ জীব৷ তাই সমাজকে উপেক্ষা করে, সমাজকে অবহেলা করে যে ধর্ম শেখানো হয়েছে, তা ধর্ম নয়–ধর্মের জঞ্জাল৷ তাই সেবা না করলে উন্নতি হবে না৷ যে সেবা করে, সে ভাগ্যবান আর সেই আত্মজ্ঞান লাভ করতে পারে৷
এখন দেখা যাক্ ‘মহৎ’ কে? শব্দটা হ’ল ‘মহৎ’–প্রথমবার একবচনে ‘মহান’৷ ‘মহান’ বা ‘মহৎ’ কে? এ ব্যাপারে বলা হয়েছে, ‘পরোপকারাৎ মহৎ’–অর্থাৎ যে পরোপকার করে, তাকেই মহৎ বলা হয়৷ যে অনেক লেখাপড়া শিখেছে, অনেক ধন–সঞ্চয় করেছে, তার পূর্বপুরুষদের হয়তো বা অনেক সম্মান আছে, সামাজিক প্রতিষ্ঠা আছে– সবই আছে, তবু তারা ‘মহৎ’ নয়৷ কারণ ‘পরোপকারাৎ মহৎ’৷
যে পরোপকার করে সে মহৎ৷ পরোপকার করার জন্যে অনেক টাকা–পয়সার দরকার নেই৷ তোমার কাছে বর্তমানে যে সম্পদ আছে তাতেই তুমি পরোপকার কর৷ শরীর যদি সবল থাকে তাহলে শরীর দিয়ে কর, অর্থ থাকলে অর্থ দিয়ে কর, বুদ্ধি থাকলে বুদ্ধি দিয়ে কর–আর কিছু না থাকলে সদ্ভাবনা দিয়ে কর৷ পরোপকারের দ্বারাই মানুষ মহৎ হয়, আর যেখানে পরোপকারের ভাবনা নেই সেখানে সে ক্ষুদ্র বা ছোট হয়ে যায়৷
আমাদের এখানে একটা অভিশাপ এসে গেছে৷ অভিশাপটা কী? মানুষ মানুষকে, ভাই ভাইকে জাতিবাদের দ্বারা বিছিন্ন করে দিয়েছে, ভুলে গেছে সে তার ভাই৷ দু’ভাইয়ের দু’টো জাত হতে পারে না, এটা সাধারণ বুদ্ধির কথা৷ আর এই সাধারণ বুদ্ধি দিয়েই মানুষ বুঝে থাকে যে, এক বাপের যদি দুই ছেলে রাম ও শ্যাম হয়, এদের আলাদা আলাদা জাত হতে পারে না৷ কখনওই হতে পারে না৷ যদি বলি রাম আর শ্যামের আলাদা আলাদা জাত, তাহলে বাপকেও মানা হয় না৷ আর যে বাপকে মানে না সে তো জারজ৷ যে বাপকে মানে, পরমপিতাকে মানে, যে ধার্মিক সে জাত–পাত মানতে পারে না, তার কাছে জাত–পাত নেই৷
পরোপকারের মাধ্যমেই মানুষ মহৎ হয়৷ এই ‘পরোপকারাৎ মহৎ’ও তিন প্রকারের৷ ‘মহৎ’–এরও তিন রকমের ভেদ, তিনটি স্তর– উত্তম, মধ্যম ও অধম৷ এটা তোমরা ভালো করে বুঝে নাও৷ আবার অধম শ্রেণীরও ‘মহৎ’ কে? মানুষ এ রকম ভাবে যে ‘আমিও মানুষ, সেও মানুষ তার প্রতি আমার এক সামাজিক দায়িত্ব আছে, সামাজিক কর্ত্তব্য আছে–তাই আমি অন্যের সেবা করি’৷ এ রকম ‘সমাজ’ তো অন্য জীবের মধ্যেও আছে–একে অন্যের খুব সাহায্য করে৷ মৌমাছিদেরও খুব সুন্দর সমাজ৷ আবার অনেক পাখী আছে যাদের মধ্যেও এ ধরনের সমাজ ব্যবস্থা আছে৷ কোনো কোনো পশুর মধ্যেও এই সমাজ ব্যবস্থা দেখা যায়৷ তাই ‘মহৎ’ তো তাদের মধ্যেও আছে, তারাও ‘মহৎ’৷ তুমি আর তাদের থেকে বড় কী করে হয়ে গেলে? তাই যারা সামাজিক কর্ত্তব্যের খাতিরে অন্যের সহায়তা করে, সে অধম শ্রেণীর ‘মহৎ’৷ আর দ্বিতীয় শ্রেণীর কারা? কেবল সামাজিক ভাব বা প্রেরণাই নয়, যাদের মধ্যে আধ্যাত্মিকতাও আছে, সে হ’ল মধ্যম শ্রেণীর৷ তারা ভাবে, আমরা সবাই তো পরমপুরুষের সন্তান– সবাই সমান– সবাই ভাই–ভাই, তাই সকলের সেবা, সহায়তা ও সহযোগ করা দরকার৷ আর তা করলে পরমপিতা সন্তুষ্ট হবেন, খুশি হবেন৷
সেবা কি জান তো, সেবা মানে পরিপূরকতা৷ এটা কেমন? এটা অন্যের ভাগ্য৷ মনে কর, তোমার কাছে টাকা–পয়সা আছে, আর কারও কাছে হয়তো একেবারেই নেই৷ অন্যের কাছে যে অর্থের অভাব আছে, তুমি হয়তো তোমার অর্থ দিয়ে তা পূরণ করে দিলে –এটা পরিপূরকতা– এটা সেবা৷ আর এতে তুমি ‘মহৎ’ হয়ে গেলে৷ মনে কর, কেউ শারীরিক দিক দিয়ে দুর্বল, তুমি নিজের শক্তি দিয়ে তাকে রক্ষার ব্যবস্থা করে দিলে অর্থাৎ তুমি পরিপূরকের কাজ করলে৷ তুমি ‘মহৎ’ হয়ে গেলে৷ কারও কাছে হয়তো খাবার নেই, অন্ন নেই, তুমি তাকে খাবার দিলে৷ তুমি পরিপূরকের কাজ করলে৷ তাই ‘মহৎ’ হয়ে গেলে৷ ‘মহৎ’ হওয়ার সুযোগ সব মানুষের আছে৷ কোনো মানুষের সম্পর্কে এলে ভেবে দেখবে তার কিসের অভাব, আর সেটা তোমার কাছে থাকলে তক্ষুণি দিয়ে দাও৷ এর মানে এই নয় যে কেবল টাকা পয়সা থাকলেই সেবা হবে৷ মনে কর, একজন কোটিপতি, তার কাছে অর্থের অভাব নেই, কিন্তু হয়তো বুদ্ধির অভাব আছে৷ তুমি তাকে বুদ্ধি দাও৷ যদি শক্তির অভাব থাকে, তুমি তাকে শক্তি দাও৷ তাই সেবা মানে হ’ল পরিপূরকতা৷ তাহলে মধ্যম শ্রেণীর ‘মহৎ’ কে? যে ভাবে সবাই পরমপিতার সন্তান, পরমপিতার ছেলেমেয়ে, তাই তাদের সাহায্য করা আমাদের কর্ত্তব্য, এতে পরমপিতা সন্তুষ্ট হবেন খুশি হবেন৷ ভাইয়ের সাহায্য করলে পিতা অবশ্যই সন্তুষ্ট হন, এটা তো ঠিক কথাই৷
আর উত্তম শ্রেণীর ‘মহৎ’ কে? যদি কেউ সাধনা করতে করতে নিজেকে পরমপুরুষের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়, নিজেকে আলাদা রাখতে পারে না, সেই অবস্থায় সে যদি সেবা করে তাহলে সে ভাববে, যাকে সেবা করছি সে তো আমারই৷ আর আমি যে এই সেবা করছি এ তো ভাইয়ের সেবা নয়, নিজেরই সেবা কারণ সেও তো আমারই৷ নিজে খেলে যে আনন্দ, তাকে খাওয়ালেও সেই আনন্দ৷ সেইজন্যে নিজে খাব আর অন্যকে খাওয়াবো না, এ ধরনের চিন্তা মনে থাকবেই না৷ এই হ’ল উত্তম শ্রেণীর ‘মহৎ’–অর্থাৎ এ ধরনের ভাবনা যে আমি অন্যের সেবা করছি না, নিজেরই সেবা করছি৷ উত্তম শ্রেণীর ‘মহৎ’৷ এই ধরনের ভাবধারা একেবারে শেষের দিকে আসে যখন পরমপুরুষের সঙ্গে অনেক বেশী ভালবাসা হয়ে যায়৷ সেই সময় সে পৃথিবীটাকে আর আলাদা করে ভাবতে পারে না৷ সেই সময় সে পৃথিবীটার সত্যি সহায়ক হয়৷ এটা চরম তথা পরম কাজ, এটাই হ’ল উত্তম শ্রেণীর ‘মহৎ’–এর কাজ৷ তোমাকে শেষ পর্যন্ত উত্তম শ্রেণীর ‘মহৎ’ হতে হবে৷ তোমরা তা হবেই, তা হওয়ার জন্যেই তোমরা পৃথিবীতে এসেছো৷