বলা হয়, গণতান্ত্রিক সরকার জনগণের জন্যে, জনগণের দ্বারা, জনগণের শাসন৷ শূদ্র যুগের পর গোষ্ঠীপতিদের হাতে ক্ষমতা স্থানান্তরিত হয়৷ কালক্রমে গোষ্ঠীপতিরা সামন্ত রাজা হয়ে পড়ে৷ রাজতন্ত্রের অত্যাচারের বিরুদ্ধ মনোভাব থেকে গণতান্ত্রিক মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে৷ গণতন্ত্রের ইতিহাস অতি প্রাচীন৷ কথিত হয় যে প্রাচীন ভারতবর্ষে লিচ্ছবী রাজবংশের সময়ে গণতন্ত্রের সূত্রপাত হয়৷ অত্যন্ত প্রাচীন সংঘটন লে এতে কিছু বিকৃতি আসা মোটেই অস্বাভাবিক নয়৷
এখন বিচার করা যাক ‘‘গণতন্ত্র জনগণের দ্বারা ঘটিত সরকার৷’’ কিন্তু জনসাধারণ কি কোনটা সত্য ও কোনটা মিথ্যা, কী করতে হবে ও কী না করতে হবে তা বিচার করার মত শিক্ষা বা চেতনাসম্পন্ন? নির্দিষ্ট বয়সে পদার্পণ করলেই কি বোধধশক্তি ও বিচারশক্তি জন্মে? বয়স কি জ্ঞান ও শিক্ষার মাপকাঠি? দুঃখের কথা এই যে তা-ই সত্য হয়েছে৷ যাঁরা লিচ্ছবী রাজবংশের গণতান্ত্রিক ধাঁচ সম্বন্ধে বড় বড় কথা লেন তাঁরা যদি সেই যুগের ইতিহাস অধ্যয়ন করেন তাহলে তাঁরা জানতে পারবেন যে সে-যুগে সকলেরই বোটদানের অধিকার ছিল না৷ কেবল লিচ্ছবী নেতারা বোটদানের অধিকার প্রয়োগ ও উপভোগ করতে পারতেন, জনসাধারণ নয়৷
যেখানে কোন প্রকার শোষণ নেই সেখানেই গণতন্ত্র ফলপ্রসূ হতে পারে৷ প্রতিটি মানুষের জীবনেই কতকগুলি নূ্যনতম প্রয়োজনীয়তা(minimum requirements) আছে ও সেগুলি পূরণ করার গ্যারাণ্টি থাকা দরকার৷ দেশ, কাল ও পাত্রের প্রভেদ অনুযায়ী এই নিম্নতম প্রয়োজনীয়তার হেরফের হবে৷ কশ্মীরের মানুষের বেশী পরিমাণে পশমী কাপড় দরকার হয়৷ সে জন্যে বিহারের মানুষ অপেক্ষা বেশী পরিমাণে গরম কাপড় কশ্মীরের মানুষকে দিতে হবে৷ যুগ ও কালের পরিবর্তনের সঙ্গে নূ্যনতম প্রয়োজনীয়তা বদলে যায়৷ প্রাচীন কালে লোকে ধুতি, জামা ও একজোড়া খড়মে সন্তুষ্ট থাকত৷ এমনকি তারা জুতার প্রয়োজনীয়ও অনুভব করত না, কিন্তু বর্তমানে স্যুট অশ্য প্রয়োজন হয়ে পড়েছে৷ আগেকার দিনে লোকে বহুদূরের রাস্তাও পায়ে হেঁটে অতিক্রম করত কিন্তু বর্তমানে সাইকেল ও মোটর যান জীবন ধরণের পক্ষে দরকার হয়ে পড়েছে৷ প্রত্যেক মানুষের জীবনের এই সমস্ত নূ্যনতম প্রয়োজন মেটানোর নিশ্চিত ব্যবস্থা করে দিতে হবে৷ এইminimum requirements-এর কোন সীমা বা সংখ্যা নেই৷ প্রতিটি প্রগতিশীল সমাজ ব্যবস্থায় স্মরণ রাখতে হবে যে, নিম্নতম আবশ্যকতা দিন দিন বেড়ই চলবে৷ অদূর ভবিষ্যতে এমন একদিন আসছে যেদিন প্রতিটি ব্যষ্টিকে একটি করে রকেট দিতে হবে৷ তখন কারো পিতৃভূমি পৃথিবীতে ও শ্বশুরবাড়ী শুক্রগ্রহে অতি সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে৷ যে সমাজ-ব্যবস্থা দেশ, কাল ও পাত্রের সঙ্গে সমান্তরালতা সামঞ্জস্য রক্ষা করে তৈরী হবে তাকে লা হবে প্রগতিশীল সমাজতন্ত্র(Progressive Socialism)৷
আমাদের প্রাউট এই প্রগতিশীল সমাজতন্ত্রই৷ সমাজকে প্রতিটি জিনিসের সুব্যবস্থা করতে হবে যাতে করে সকল মানুষের জীবনধারণের মান দিন দিন বর্ধিত হয়৷ যদি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতে প্রগতিশীল সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করা যায় তবেই গণতন্ত্র সার্থক হবে, নচেৎ ‘‘জনগণের দ্বারা, ‘‘জনগণের জন্যে, জনগণের শাসন’’-এর মানে দাঁড়াবে ‘‘বোকার দ্বারা, বোকার জন্যে, বোকার শাসন৷’’
জনশিক্ষা গণতন্ত্রের সার্থকতা ও সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্যে অন্যতম বিষয় ও মূল প্রয়োজন৷ কোন কোন স্থলে শিক্ষিত মানুষও বোটদানের অধিকারকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করে৷ জনগণ গ্রাম-পঞ্চায়েতের ভ্রান্ত নেতৃত্বের নির্দেশ ও প্ররোচনায় বোট দিয়ে থাকে৷ পশুর পালের মত পোলিং বুথের কাছে এগিয়ে যাওয়া ও ব্যালট বক্সে বোট দেওয়া নিরর্থক৷ গণতন্ত্রের নামে এটা কি প্রহসন নয়? সুতরাং শিক্ষার বিস্তার ও যথার্থ জ্ঞান একান্ত প্রয়োজন৷ শিক্ষা মানে শুধুমাত্র আক্ষরিক জ্ঞান বোঝায় না৷ আমার মতে যথার্থ ও যথেষ্ট জ্ঞান ও বোধশক্তিই সত্যিকারের শিক্ষা৷ অন্য কথায় চৈতন্যের সম্বন্ধে পূর্ণ জ্ঞানই শিক্ষার আসল অর্থ৷ অ, আ, ক, খ-এর ধারণাকে শিক্ষা লে না৷ আক্ষরিক জ্ঞান নিশ্চয়ই কিছু উদ্দেশ্য সাধন করে৷ আক্ষরিক জ্ঞান যে একেবারেই নিরর্থক বা প্রাণহীন তা আমি বলছি না৷ দক্ষিণ আমেরিকায় এমন কয়েকটি দেশ আছে যেখানে কেবল স্বাক্ষর ব্যষ্টিরাই বোটদানের অধিকার ভোগ করে৷ এই সমস্ত দেশে রাজনৈতিক দলগুলি লিটারেসি ক্যাম্পেন তুলে থাকে৷ যে পার্টি যে সমস্ত লোককে অক্ষরজ্ঞান-সম্পন্ন করেছে তারা সেই পার্টিকেই বোট দেয়৷ সরকারও এই সমস্ত দায়িত্ব থেকে ও এই সমস্ত বিষয়ের ওপর আর্থিক ব্যয় থেকে মুক্ত থাকে৷ কিন্তু এই ব্যবস্থা স উদ্দেশ্য সাধন করতে পারে না৷ প্রথমতঃ আক্ষরিক জ্ঞান পেলেই যে কর্তব্য-অকর্তব্যের পূর্ণ জ্ঞান জাগবে তা ঠিক নয়৷ দ্বিতীয়তঃ যদিLiteracy campaign-এর দায়িত্ব রাজনৈতিক দলের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয় তা হলে সেক্ষেত্রে সেই সমস্ত রাজনৈতিক দল আপন আপন দলীয় মত প্রচার করবে ও তাকেই সকলের প্রিয় করতে চাইবে৷ এর ফলে বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে লোকে দেউলিয়া হয়ে পড়বে ও যুক্তির ওপর অভিশাপ হানা হবে৷ কিন্তু শিক্ষা একান্ত আবশ্যক, শিক্ষা ব্যতিরেকে গণতন্ত্র কোন দিনই সার্থক হতে পারে না৷ (ক্রমশঃ)