আদিবাসীদের নিজস্ব কয়েকটি দাবী দাওয়ার ভিত্তিতে আবারও আন্দোলন শুরু হয়েছে৷ ভারত জাকাত মাঝি পারগাণা মহলের ডাকে এই আন্দোলনে মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রামের জেলা শাসকদের অফিস অবরোধ, শিক্ষা দপ্তরের অফিস অবরোধ, মঞ্চ বেধে জনসভা ইত্যাদি সংঘটিত হয়েছে৷ অবশ্য সুখের কথা প্রশাসনিক প্রতিশ্রুতির পর অবরোধ তুলে নেয়া হয়৷ সাঁওতালি শিক্ষা পর্ষদ ঘটন, চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকে ঝাড়গ্রামে নবঘটিত সাধু রামচাঁদ মুর্মূ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাঁওতালি মাধ্যমে স্নাতকস্তরে পাঠক্রম চালু করা ইত্যাদি তাদের দাবী ছিল৷ এই দাবীর প্রতি যৌক্তিকতা থাকলেও আর একটি দাবীকে ঘিরে সংঘর্ষের ইঙ্গিত পাওয়া যায়৷ দাবীটি হোল তথাকথিত অ-আদিবাসী কুড়মীদের আদিবাসী তালিকাভুক্ত করা চলবে না৷ ইতোমধ্যে কুড়মীরা ভাষার স্বীকৃতি, সারণ ধর্মমতকে স্বীকৃতি এবং কুড়মী মাহাতদের আদিবাসী তালিকাভুক্ত (সিডিউল্ড ট্রাইব) করতে হবে৷ এই দাবীতে তারা রাজ্যের বিভিন্নস্থানে অন্তত দুই দফায় অবরোধমূলক কর্মসূচী পালন করেছে৷ আগামী দিনে তারা পুনরায় অবরোধ ও জমায়েতের কর্মসূচী নিয়েছে৷ মূল ব্যাপারটা দাঁড়াল এই যে কুড়মী মাহাতরা আদিবাসী তালিকাভুক্ত হতে চায় আর সাঁওতালিরা কুড়মী মাহাতদের এই আদিবাসী তালিকাভুক্ত করার ব্যাপারে আপত্তি করছে এবং তাদের আন্দোলনের এটাও একটা কর্মসূচী৷ অর্থাৎ আদিবাসী বনাম তথাকথিত অ-আদিবাসী কুড়মী মাহাতদের একটা রনং দেহি ভাব৷ দুর্র্ভগ্য এই যে এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে একটা বিভেদ তৈরী করে একটা অশান্তির পরিবেশ সৃষ্টি হতে যাচ্ছে৷ এর পিছনে যাদেরই মদত থাকুক না কেন এটা পরিস্কার যে এই মদতদাতা সামগ্রিকভাবে সমাজের মঙ্গল চায় না৷ এবং একটা অশান্তি জিইয়ে রাখতে চায়৷
প্রসঙ্গক্রমে আদিবাসী এবং অ-আদিবাসী এই দুটি বিষয়ের উপর একটু আলোচনা করা যেতে পারে৷ আদিবাসী মানে প্রাচীনতম অধিবাসী৷ সাঁওতালরা নিজেদের আদিবাসী বলে দাবী করছে৷ সাঁওতালরা বৃহত্তর বঙ্গ এলাকায় এসেছিলেন বাংলা ১১৭৬ সালে অর্থাৎ ইংরেজী ১৭৬৯ সালে মধ্যপ্রদেশের দুর্ভিক্ষক্লিষ্ট পূর্বাংশ থেকে সেই ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময়৷ (বাংলা ও বাঙালী--- শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার) সাঁওতাল বিদ্রোহ হয়েছিল ৮৬ বছর পরে অর্থাৎ ১৮৫৫ সালে৷ সিধু-কানুর নেতৃত্বে এই ঐতিহাসিক বিদ্রোহ ব্রিটিশের ঘুম ছুটিয়েছিল৷ স্বাভাবিকভাবেই সিধু কানু আমাদের জাতীয় বীর এবং সকলেরই নমস্য৷
সাঁওতালি ভাষা স্বীকৃত হলে তার লিপি নিয়ে নিজেদের মধ্যেই একটা গোলমাল ছিল৷ বেশ কিছুদিন আগে রাচীতে সারা ভারতের সাঁওতালগণ একটি মহাসভার আয়োজন করেছিল৷ সেখানে সাঁওতালের ভাষা কোন লিপিতে লেখা হবে তাই নিয়ে আলোচনা হয়৷ সেই মহাসভায় চারটি লিপির কোনটি সাঁওতালি ভাষার ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য হবে সেই আলোচনা হয়েছিল৷ পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রাক্তন কেন্দ্রীয়মন্ত্রী সুবোধ হাঁসদার নেতৃত্বে প্রতিনিধিরা দাবী করে বাংলা লিপি গ্রহণ করা হোক৷ তখন পশ্চিমবঙ্গে সাঁওতালি ভাষা বাংলা লিপির মাধ্যমে প্রকাশিত হোত৷ বিহার ও ঝাড়খণ্ড (তখন ঝাড়খণ্ড হয়নি) থেকে প্রতিনিধিরা দেবনাগরী লিপি গ্রহণ করার দাবী জানান৷ পশ্চিমবঙ্গের আর একজন প্রাক্তন কেন্দ্রীয়মন্ত্রী অমিয় কিস্কুর সহযোগী প্রতিনিধিরা রোমানলিপি গ্রহণ করার দাবী করেন৷ পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মুর সহযোগীরা অলচিকি গ্রহন করার দাবী জানান৷ আর একটি লিপির কথা শোনা যায় যা সাধু রামচাঁদ (যার নামে সদ্য ঝাড়গ্রামে একটি বিশ্ব বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে৷) যেটা আবিস্কার করেছিলেন৷ কিন্তু এটা বহুল প্রচারিত হয়নি৷ তাহলে দাঁড়াল এই বাংলা লিপি, রোমান লিপি, দেবনাগরী লিপি, অলচিকি এই চারটি লিপির কোনটির মাধ্যমে সাওতালি ভাষা প্রকাশ করা হবে৷ এ নিয়ে অনেক আলোচনা ও বাদানুবাদ হয়৷ কিন্তু ঠিক মীমাংসা হয় না৷ তারপর সিদ্ধান্ত হয় আগামী দিনে আরও বৃহত্তর এক সভা করে সেখানে এক চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে৷ কিন্তু মজার ব্যাপার হোল এই যে এই ফাঁকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবসু পুরুলিয়াতে দুদিনের এক সম্মেলন আহ্বান করলেন৷ সেখানে পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মুকে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাকে নিয়ে এসে এক সম্বর্ধনা দিলেন৷ তারপর তিনি ঘোষনা করলেন সাওতালি ভাষা অলচিকির মাধ্যমে প্রকাশিত হবে৷ যাদের ভাষা এবং যাদের লিপি তারাই নিজেদের লিপি স্থির করতে পারলেন না৷ কিন্তু জ্যোতিবাবু ঘোষণা করলেন অলচিকিই চলবে৷ এ অধিকার তাকে কে দিলেন? যাই হোক তিনি পশ্চিমবঙ্গে সাওতালি ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে অলচিকি গ্রহণ করার আদেশ দিলেন৷ আর একধাপ এগিয়ে তিনি সরকারী কর্মচারীদের অলচিকি শিখতে বললেন এবং যারা অলচিকি শিখবে তাদের এককালীন একটা থোক টাকা অনারারিয়াম হিসেবে দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করলেন৷ যাইহোক অলচিকিকে যদি সকলে মেনে নেন তাতে কারোর আপত্তি থাকতে পারে না৷
কিন্তু সাঁওতালরা মধ্যপ্রদেশের আদিবাসী হলেও রাঢ়ের তথা বাঙলার আদিবাসী নন৷ গোড়ার দিকে এরা লোধা ও বেদে মাহাত, মাল পাহাড়ী, কুর্মী মাহাতদের জমি তীর ধনুক দেখিয়ে দখল করেছিলেন সত্য কিন্তু পরে তারা শান্তিপ্রিয় নাগরিক হিসেবে বাঙলার মাটির সঙ্গে মিশে যান ও আজও অচ্ছেদ্যভাবে মিশে রয়েছেন৷ (বাংলা ও বাঙালী ঃ শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার) আর কুর্মী মাহাতরা বাংলার ছয়টি জাত বাঙালী সদ্গোপ, মাহিষ্য, মাহাত,নমশূদ্র, রাজবংশী, চাকমা, এর অন্যতম জাত বাঙালী৷ বাংলায় অষ্ট্রেলয়েড, দ্রাবিড়য়েড, মঙ্গোলয়েড ও অবশ্যই আর্য সব মিলে মিশে একটা ইন্টিগ্রেটেড বেঙ্গলী কালচার গড়ে তুলেছে৷ অর্থাৎ বৃহত্তর বঙ্গ-ভূখণ্ডে যারা বাঙলার স্বার্থের সঙ্গে নিজেদের মিলিয়ে দিয়েছেন তারা সকলেই বাঙালী৷ তাই এখন আওয়াজ ওঠা উচিত বাঙলার উন্নতি চাই, বাঙালীর উন্নতি চাই৷ ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাঙালীকে এখন বাঙলার আঙ্গিনা থেকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছাতে হবে৷ এজন্য মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তাদের দিয়েছেন নোতুন আদর্শ ‘প্রাউট’৷ এই আদর্শের পথ ধরেই সবাইকে চলতে হবে৷ অবৈজ্ঞানিক চলতি সংরক্ষণ রীতি মানুষে মানুষে ভেদ সৃষ্টি করছে৷ বাঙালীদের মধ্যেও ভেদাভেদ সৃষ্টি হচ্ছে৷ তাই আজ প্রয়োজন বিজ্ঞানসম্মতভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষকে এগিয়ে সমানতালে এগিয়ে নিয়ে আসার জন্য প্রাউট নির্দেশিত পথ গ্রহণ৷ তাহলেই গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে ঘৃণা, বিবাদ, বিসম্বাদের অবসান ঘটবে৷
- Log in to post comments