শুরুতে পৃথিবী গ্রহে বিরাজ করত চরম নীরবতা–কোনো জীবিত সত্তাতো ছিলই না, এমনকি গাছপালাও জন্মায়নি৷ লক্ষ কোটি বছর ধরে এই অবস্থা চলেছিল৷ তারপর পৃথিবী অনেক ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে চলে উপযুক্ত ভাবে তৈরী হ’ল৷ এরপরে এক স্তরে পৃথিবীর বুকে নেবে এল বৃষ্টিধারা, শুরু হ’ল ঝড়ঝঞ্ঝা৷ এইভাবে ক্রম–পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে জীবনের উদ্ভব হ’ল৷ বৃষ্টির ফলেই কার্বণ পরমাণুতে প্রাণশক্তি সঞ্চারিত হ’ল৷ কার্বণ পরমাণু–সমন্বিত প্রোটোপ্লাজমিক সংঘর্ষ–সমিতি জন্ম দিল এই প্রাণ শক্তির৷
পৃথিবী গ্রহের বিবর্তন প্রক্রিয়ায় জল হ’ল এক অত্যাবশ্যকীয় তত্ত্ব৷ আজ এই জল ছাড়া মানুষ, জীবজন্তু, গাছপালার জীবনধারণ আর সমগ্র পৃথিবী গ্রহের অস্তিত্বের কথা চিন্তাই করা যায় না৷ যদি মাত্র এক বৎসর পৃথিবীর কোথাও বৃষ্টিপাত না হয়, তাহলেই পৃথিবীর বুক থেকে জীবনের অস্তিত্ব ধ্বংস হয়ে যেতে পারে৷ এর কারণ হ’ল ছোট এক–কোষী জীব থেকে সর্ব বৃহৎ জানোয়ার –– সমস্ত জীবিত সত্তারই জলের প্রয়োজন৷ যদি জল না থাকে তাহলে আগে ছোট ছোট জীবের মৃত্যু হবে, তারপরে গ্রহের সামগ্রিক পরিবেশগত ভারসাম্যটাই নষ্ট হয়ে যাবে৷ তারপর মরবে মানুষেরা৷ শেষে পৃথিবী এক পরিত্যক্ত উষর ভূমিতে পরিণত হবে৷
বিশ্ব জুড়ে জল–সংকট
নিকট ভবিষ্যতে পৃথিবীর অনেক অংশেই তীব্র জল–সংকট দেখা দেবে৷ গঙ্গা, যমুনা, টেমস ইত্যাদির মত অনেক বড় বড় নদীর জল খুব দূষিত হয়ে পড়েছে৷ এদের জল পানযোগ্য তো নয়ই, যদি এই জলে হাত–পাও ধোয়া হয়, তাহলেও রোগ সংক্রমণের সম্ভাবনা থেকে যায়৷ এর একমাত্র সমাধান হ’ল বৃষ্টির জলের ওপর নির্ভর করা৷ আমাদের বৃষ্টির জলধারা সঞ্চয় করে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে বিজ্ঞানের উন্নতি ঘটিয়ে হিলিয়াম গ্যাস বা অন্যান্য প্রক্রিয়ায় কৃত্রিম বৃষ্টি সৃষ্টি করতে হবে জলভরা মেঘ যা সমুদ্রে বৃষ্টিপাত ঘটায় তা স্থলভূমির দিকে টেনে আনতে হবে৷ অধিক থেকে অধিকতর সংখ্যায় কেবল গভীর নলকূপ খনন করে চলা কোন সমাধানই নয়৷ বরং বৃষ্টিপাত যেখানে হচ্ছে, ঠিক সেই জায়গায় জলকে সংগ্রহ করে রাখবার চেষ্টা করতে হবে৷ এই জন্যে অবিলম্বে ওইসব জায়গায় অনেক পুকুর, খাল, ছোট ক্ষাঁধ, জলাধার, হ্রদ তৈরী করে বৃষ্টির জলকে পানীয় জল হিসেবে ব্যবহারের জন্যে সঞ্চয় করে রাখতে হবে৷ অদূর ভবিষ্যতে মানবতা যে জল–সংকটের সম্মুখীন হবে তা থেকে বাঁচবার এই হচ্ছে একমাত্র উপায়৷ জাগতিক ক্ষেত্রে দুই ধরনের বিপর্যয়ের সম্ভাবনা থাকে –এক হচ্ছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, দ্বিতীয় হচ্ছে মনুষ্য সৃষ্ট বিপর্যয়৷ আজকে যদিও মনুষ্য সৃষ্ট বিপর্যয়ের সংখ্যাই যেন বেড়ে যাচ্ছে, কিন্তু তার মধ্যেই মানুষ টাইফুন, বন্যা, খরা, ভূমিকম্প ইত্যাদির মত প্রাকৃতিক বিপর্যয়েরও সম্মুখীন হচ্ছে৷ মানুষ এইভাবে নানারকম দুর্বিপাকের কবলে পড়লেও, প্রলয় বলে কিছু কোন কালেই হবে না৷ প্রলয়ের ভ্রান্ত ধারণাটাই দাঁড়িয়ে আছে ভাবজড়তা আর কুসংস্কারের ওপর৷
মনুষ্য সৃষ্ট দুর্বিপাক দুই ধরনের –– প্রথমটা হ’ল কোনো জায়গায় মানুষের সমাজকে দ্বিধাবিভক্ত, ত্রিধাবিভক্ত করে ফেলা৷ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হ’ল ইজরায়েল–প্যালেষ্টাইন্ সংঘর্ষ আর উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের মধ্যে যুদ্ধ৷ অখণ্ড ভারতকে ভেঙ্গে ভারত, পাকিস্তান আর পরবর্তীকালে ক্ষাংলাদেশের সৃষ্টি ত্রিধাবিভক্ত করার উদাহরণ৷ পরিবেশের ধ্বংসসাধন করে আর কয়লা, তেল ও জলের মত মাটির নীচেকার সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার করে মানুষ নিজে এক বড় বিপর্যয়কে ডেকে আনছে৷ জঙ্গল উচ্ছেদের মধ্যে দিয়ে মানুষ পরিবেশের চরম ধ্বংসসাধন করছে৷ এর ফলে বঙ্গোপসাগর থেকে আগত বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনাযুক্ত মেঘ সমগ্র ভারতবর্ষের ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে আরব সাগরের ওপর বৃষ্টিপাত ঘটাচ্ছে৷ এর অর্থ হ’ল, যে মেঘ আগে মগধে বৃষ্টিপাত ঘটাত তা এখন আরব সাগরের ওপর বর্ষিত হচ্ছে৷ এর ফলশ্রুতিতে আরব সাগরের জলস্তর উঁচু হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বঙ্গোপসাগরের জলে লবণাক্ত ভাব বেড়ে যাচ্ছে৷ এর ফলে আবার ভারতের উপকূল অঞ্চলের জলস্তর উঁচু হচ্ছে, তার সঙ্গে ভারত উপমহাদেশের স্থলভূমি সঙ্কুচিত হয়ে আসছে আর ভূমিক্ষয় বেড়ে চলেছে৷ পৃথিবীর প্রায় দুই–তৃতীয়াংশ ভূভাগ হ’ল জলের তলায় আর এক–তৃতীয়াংশ হ’ল স্থলভাগ৷ কিন্তু নির্বিচারে বন ধ্বংসের ফলে জলভাগ বেড়ে যাচ্ছে অথচ ভূভাগ কমে আসছে৷
পরিবেশ ধ্বংসের আর একটি উদাহরণ হ’ল ভূ–নিম্নস্থ সম্পদের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার৷ মাটির নীচেকার এই সব সম্পদ খনন করে বাইরে নিয়ে আসার ফলে বিশাল ও গভীর খাদের সৃষ্টি হচ্ছে যা ঠিক ভাবে ভরাট করে দেওয়া উচিত৷ অনেক দেশে মাটির নীচে থেকে কয়লা উত্তোলনের পরে বালি দিয়ে সেই স্থান ভরাট করে দেওয়া হয়৷ তা যদি না করা হয় তাহলেই সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলি অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বেশী ভূমিকম্প–প্রবণ এলাকায় পরিণত হবে৷ শুধু তাই নয় –না ভরাট করা খাদ পৃথিবীর ভূমি–সংরচনাকেই দুর্বল করে দেবে যার ফলে সমগ্র অঞ্চলটাই একদিন ধসে যাবে৷
আরব দেশগুলি মাটির নীচে থেকে তেল উত্তোলন করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে চলেছে৷ বেশ কিছু বছর আগে সেই দেশের নেতারা বুঝলেন যে তেলের উৎপাদন এইভাবে চিরকাল চলবে না৷ তাই তেলের সরবরাহ শেষ হয়ে গেলে তাদের দেশের ভবিষ্যৎ কি হবে, এই নিয়ে তাঁরা ভাবনা চিন্তা শুরু করলেন৷ তাদের দেশে জলস্তর নীচে নেবে যাচ্ছে আর মরুভূমির পরিধি বেড়ে যাচ্ছে, এই দেখে তারা উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠলেন৷ এই সমস্যা সমাধান করার জন্যেই তাঁরা মাটি আর মিষ্টি জল আমদানী করার সিদ্ধান্ত নিলেন৷ তারপর থেকে যেসব গাছপালা তাঁরা লাগিয়েছিলেন আজ তা আট–দশ বছরের হয়েছে৷ আর এর মধ্যেই সেই সব দেশের মানুষের প্রথম বন্যা দেখার মত অভিজ্ঞতা হয়েছে৷ স্থানীয় মানুষের অনেকে এর আগে বন্যা কখনো দেখেননি৷ আর ছোট ছোট শিশুরা এত বৃষ্টি দেখে আশঙ্কায় চিৎকার করে উঠেছিল৷
পৃথিবীর অধিকাংশ স্থানে ভূ–গর্ভস্থ জলের অত্যধিক ব্যবহারের ফলে মরুভূমি তৈরী হওয়ার মত পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে৷ ভূ–গর্ভস্থ জল নীচে নেমে যাওয়ার অর্থই হ’ল ভূ–পৃষ্ঠের কাছাকাছি মাটি শুকিয়ে যাওয়া, যার ফলে গাছপালাও শুকিয়ে মরে যায়৷ রাজস্থানের অনেক অংশে ঠিক এই রকমটাই হয়েছে৷ একমাত্র ব্যাপক বনসর্জন এই মরুভূমি হওয়ার করুণ পরিণতি থেকে বাঁচাতে পারে৷
মানুষ অতীতে জলের আকাল আর খরার কবলে পড়ে অনেক ভুগেছে আর ভবিষ্যতে যদি ওই ব্যাপারে উপযুক্ত ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে তারা আরও ভুগবে৷ যদি বন ধ্বংস ও ভূগর্ভস্থ জলকে নিয়ে যথেচ্ছাচার চলতে থাকে তাহলে পৃথিবীর অনেক দেশ ১৯৯৩ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে ভয়ংকর জল সংকটের মধ্যে পড়বে৷ এই মর্মান্তিক পরিণতি থেকে বাঁচবার একমাত্র উপায় হ’ল অবিলম্বে জলসম্পদ সংরক্ষণের জন্যে একটি বিকেন্দ্রিত পরিকল্পনা রূপায়িত করা৷ (ক্রমশঃ)