পৃথিবীর জলসম্পদের সংরক্ষণ

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

পূর্ব প্রকাশিতের পর

খরার কারণ সমূহ

খরা কেন হয়? এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলি কী কী? এর তিনটি প্রধান কারণ হ’ল নিম্নরূপ ঃ–

প্রথম, ব্যাপকভাবে গাছপালা ও বন ধ্বংস করা৷ দ্বিতীয়, সমুদ্র ও মহাসাগরের ওপর নিম্নচাপ তৈরী হওয়ার প্রাকৃতিক নিয়ম৷ আর তৃতীয় কারণ হ’ল সূর্য সহ অন্যান্য জ্যোতিষ্ক্, যেমন–ধূমকেতু–নেবুলা বা গ্যালাক্সির কৌণিক গতির হঠাৎ পরিবর্তন৷

বন উচ্ছেদ খরার জন্ম দেয় কেননা এর ফলে গাছপালা মাটিকে সরস রাখতে পারে না৷ সাধারণ অবস্থায় গাছের ছোট ছোট আঁশযুক্ত শেকড় মাটি থেকে প্রচুর জল শুষে নেয় ও তা ধরে রাখে যা ধীরে ধীরে মাটিতে ছাড়তে থাকে৷ উদাহরণস্বরূপ, গ্রীষ্মকালে বাংলার ধানক্ষেতে দেখা যাবে যে ক্ষেতের ধারে নিচু অংশে অল্প অল্প জল জমা হচ্ছে৷ জল এল কোথা থেকে? জমিতে দাঁড়ানো ফসলের গোড়া থেকেই তা বেরিয়ে আসে৷ কিন্তু যখন ধান ও সহকারি ফসল কাটা হয়ে যায় তখন দেখা যায় সেই জলও শুকিয়ে যাচ্ছে৷ মানুষই বনোচ্ছেদের কারণ, তাই মানুষকেই নিজের প্রয়াসের দ্বারা এই সমস্যা সমাধান করতে হবে৷

খরার দ্বিতীয় ও তৃতীয় কারণ বর্তমানে মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে৷ ভবিষ্যতে আবহ  বিজ্ঞান ও সামুদ্রিক বিজ্ঞানের •meteorological and marine sciences)   উন্নতি হলে মানুষ আংশিক ভাবে দ্বিতীয় কারণকে প্রভাবিত করতে পারবে বা তা থেকে নিস্তার পেতে পারবে৷ তৃতীয় কারণ একমাত্র নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন পরম চৈতন্যসত্তা৷ অবশ্য মানুষ যদি পজিটিভ মাইক্রোবাইটার পথ নেয় আর পরম চৈতন্যসত্তার কৃপা পায়, তাহলে মানুষও তৃতীয় কারণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে৷

গ্রহ–তারা–জ্যোতিষ্ক্দ কৌণিক গতির হঠাৎ পরিবর্তনের ফলে কীভাবে খরা হতে পারে? কিছু ধূমকেতু আছে যার গতিপথ আগে থেকে স্থিরীকৃত হয়ে থাকে৷ আর জ্যোতির্বিদরা তাদের পৃথিবীর কক্ষপথে আগমন ও তজ্জনিত সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে জানতে পারেন৷ কিন্তু কিছু কিছু ধূমকেতু আছে যারা আগাম কোনো সতর্ক বার্তা ছাড়াই হঠাৎ এসে উপস্থিত হয়৷ যখন এই রকম কোনো শক্তিশালী জ্যোতিষ্কের হঠাৎ আগমন হয় বা তাদের কক্ষপথে যদি হঠাৎ কোনো পরিবর্তন ঘটে তাহলে তাদের মহাকর্ষীয় টানে ঋতুচক্র বা সৃষ্টিধারার স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপে বাধা সৃষ্টি হতে পারে৷ যেমন কোনো শক্তিশালী ধূমকেতু বা উল্কার প্রবল মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে মেঘ তৈরী হওয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে৷ সংস্কৃতে এই অবস্থাকে বলা হয় বক্রীদশা৷

বিশাল সংখ্যায় পজিটিব বা নেগেটিব মাইক্রোবাইটামের একত্র সমাবেশের ফলে উল্কা, ধূমকেতু বা উপগ্রহের মধ্যে এক ধরনের বিচ্যুতি আসতে পারে৷ বিশাল মহাশূন্যে সবকিছুর গতি–প্রকৃতি নির্ভর করে পজিটিব ও নেগেটিব মাইক্রোবাইটার গতি প্রকৃতির ওপর৷

জ্যোতিষ্কের কৌণিক গতি মানুষের মনকেও প্রভাবিত করে৷ ধর, শান্ত পূর্ণিমা রাতে তুমি বাইরে কোথাও আছ, মৃদুমন্দ ঠাণ্ডা বাতাস তোমার শরীরকে জুড়িয়ে দিচ্ছে৷ স্বাভাবিক ভাবে এই পরিবেশে এক সুন্দর ভাললাগার অনুভূতি তোমার মনে বিরাজ করবে৷ ধর, এই অনুভূতি তোমার মধ্যে অনেকক্ষণ ধরে আছে –– কিন্তু তার মধ্যে এক সময় হয়ত তুমি দেখলে যে তোমার স্নায়ুকোষগুলো কেমন যেন নির্জীব হয়ে আসছে৷ আর এই অভিজ্ঞতা যদি একটি নির্দিষ্ট সীমার বাইরে চলে যায়, তোমার চিন্তাশক্তি বিকল হয়ে যেতে পারে, যার ফলে কোনো মানসিক রোগও দেখা দিতে পারে৷ [বাইরের অন্য কিছুর প্রভাবে, যেমন কৌণিক গতির পরিবর্তন] মানুষের শারীর –– মানসিক সংরচনার মধ্যে পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার ফলে এটা হয়৷

ধর, আট বছর বয়সে তোমার জীবনে কোনো ঘটনা ঘটেছিল৷ আমরা জানি এই বিশ্বে একটি জিনিস অন্য একটি জিনিসের সঙ্গে হুবহু এক নয়, যদিও পারস্পরিক সাদৃশ্য থাকতে পারে৷ এখন আট বছর পরে যদি অনুরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তাহলে ১৬ বছর বয়সে একই রকমের ঘটনা হয়ত তোমার জীবনে ঘটে যেতে পারে৷ তোমাদের দেখতে হবে, যে বিশেষ পরিস্থিতিতে একজনকে অতীতে কোনো কষ্টকর ও দুঃখজনক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, তাকে যেন কখনই সেই পরিস্থিতিতে পড়তে না হয়৷ কেননা সেই ক্ষেত্রে তা মানুষটির আধ্যাত্মিক প্রগতিকে ব্যাহত করবে৷ এই ব্যাপারটা জাগতিক ও মানসিক ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য৷

মানুষের গতি হচ্ছে পরিবেশগত ভারসাম্য অর্জনের দিকে– চরম সংশ্লেষণাত্মক  স্থিতির দিকে৷ অন্তর্জগতে সমতা বজায় রাখতেই হবে৷ কেন না এর ফলে আধ্যাত্মিক প্রগতি সম্ভব হবে৷ পরিবেশগত শৃঙ্খলা বজায় রাখা শুধু এই গ্রহের জন্যে নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্যে৷ আর তা ভেতরে বাইরে দু’দিকেই বজায় রেখে চলতে হবে৷ কোনো জ্যোতিষ্কের কৌণিক স্থানচ্যুতি যেমন মানুষের মনকে প্রভাবিত করবে, তেমনি বহির্জাগতিক দিক থেকে বিশ্বকে তো প্রভাবিত করবেই তাই অন্তর্জগত–বহির্জগ্ সমতা অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে৷ মানুষের জীবনের সর্বক্ষেত্রেই এই সূক্ষ্ম সমতা বোধ বজায় রেখে চলতে হবে –– এটাই হ’ল সত্যিকারের পরিবেশগত ভারসাম্য৷

নলকূপের মাধ্যমে সেচ ব্যবস্থার ত্রুটি

আমি আগেই বলেছি অধিক সংখ্যায় নলকূপ তৈরী করে দিলেই জল–সংকটের সুরাহা হবে না৷ এই ব্যবস্থায় ত্রুটি কী? নলকূপের মাধ্যমে সেচ জলস্তরকে নীচে নামিয়ে দেবে, আর এর অনবরত ব্যবহারের ফলে ভূ–গর্ভস্থ জলের স্রোত শুকিয়ে যাবে৷ প্রথমে হয়ত এর কুফল ঠিকভাবে বোঝা যাবে না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে এক উর্বর এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হয়ে গেল৷ আসলে যদি ভূ–গর্ভস্থ জলের স্তর কুড়ি–পঁচিশ ফুটের ওপরে থাকে, তাহলে ভূ–পৃষ্ঠের গাছ–পালার ক্ষতি হবে না, কিন্তু তা যদি পঞ্চাশ ফুটের নীচে নেমে যায় তাহলে ভূ–পৃষ্ঠের মাটি এক বন্ধ্যা, পতিত জমিতে পরিণত হতে বাধ্য৷

গভীর নলকূপের মাধ্যমে সেচের কুফলগুলি নিম্নরূপ ঃ

১৷ পার্শ্ববর্তী অগভীর নলকূপের জল শুকিয়ে যায়, যার ফলে পানীয় জল পাওয়া সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়৷

২৷ গাছ, ফলের বাগান, বড় বড় উদ্ভিদ যথেষ্ট পরিমাণে জল মাটির নীচে পায় না৷ ফলস্বরূপ তারা শুকিয়ে মরে যায়৷ নলকূপের মাধ্যমে যদি ব্যাপক ভাবে কৃষিকাজ করা হয় তাহলে গ্রামাঞ্চলের সবুজ পটভূমি ৩০ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যেই শুকিয়ে মরুভূমিতে পর্যবসিত হবে৷

৩৷ কিছু গভীর নলকূপের ক্ষেত্রে শত্রু পদার্থ –– যেমন ভারী খনিজ বা খনিজ লবণের মত মাটির পক্ষে ক্ষতিকর পদার্থ –– জলের সঙ্গে মিশে তার লবণাক্ত ভাগকে বাড়িয়ে দিয়ে সমস্যা তৈরী করে৷ ফলে শেষ পর্যন্ত জমি অনুর্বর ও চাষের কাজে অনুপযুক্ত হয়ে দাঁড়ায়৷ যখন নলকূপের উৎস শুকিয়ে যায়, তখন ওই নলকূপের জল যা চাষের জন্যে ট্যাঙ্কে জমিয়ে রাখা হয়েছিল তাও শুকিয়ে যায়৷

নলকূপের মাধ্যমে সেচ শুধু সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে, কেননা তা শেষ পর্যন্ত চারিপাশের পরিবেশের বিপুল ক্ষতি করে দেয়৷ সেচের জন্যে বিভিন্ন বিকল্প ব্যবস্থা হ’ল –– নদী সেচ, পুকুর–বাঁধ–সায়রে মাধ্যমে সেচ, তোলা সেচ, খাল/নালার মাধ্যমে সেচ৷ সেচের জল হ’ল ঘুরন্ত লাটিমের মাথার মত গুরুত্বপূর্ণ আবশ্যকতা৷ এ ছাড়া কৃষিকাজ অসম্ভব৷

(ক্রমশঃ)