শুরুতে পৃথিবী গ্রহে বিরাজ করত চরম নীরবতা–কোনো জীবিত সত্তাতো ছিলই না, এমনকি গাছপালাও জন্মায়নি৷ লক্ষ কোটি বছর ধরে এই অবস্থা চলেছিল৷ তারপর পৃথিবী অনেক ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে চলে উপযুক্ত ভাবে তৈরী হ’ল৷ এরপরে এক স্তরে পৃথিবীর বুকে নেবে এল বৃষ্টিধারা, শুরু হ’ল ঝড়ঝঞ্ঝা৷ এইভাবে ক্রম–পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে জীবনের উদ্ভব হ’ল৷ বৃষ্টির ফলেই কার্বণ পরমাণুতে প্রাণশক্তি সঞ্চারিত হ’ল৷ কার্বণ পরমাণু–সমন্বিত প্রোটোপ্লাজমিক সংঘর্ষ–সমিতি জন্ম দিল এই প্রাণ শক্তির৷
পৃথিবী গ্রহের বিবর্তন প্রক্রিয়ায় জল হ’ল এক অত্যাবশ্যকীয় তত্ত্ব৷ আজ এই জল ছাড়া মানুষ, জীবজন্তু, গাছপালার জীবনধারণ আর সমগ্র পৃথিবী গ্রহের অস্তিত্বের কথা চিন্তাই করা যায় না৷ যদি মাত্র এক বৎসর পৃথিবীর কোথাও বৃষ্টিপাত না হয়, তাহলেই পৃথিবীর বুক থেকে জীবনের অস্তিত্ব ধ্বংস হয়ে যেতে পারে৷ এর কারণ হ’ল ছোট এক–কোষী জীব থেকে সর্ব বৃহৎ জানোয়ার –– সমস্ত জীবিত সত্তারই জলের প্রয়োজন৷ যদি জল না থাকে তাহলে আগে ছোট ছোট জীবের মৃত্যু হবে, তারপরে গ্রহের সামগ্রিক পরিবেশগত ভারসাম্যটাই নষ্ট হয়ে যাবে৷ তারপর মরবে মানুষেরা৷ শেষে পৃথিবী এক পরিত্যক্ত উষর ভূমিতে পরিণত হবে৷
বিশ্ব জুড়ে জল–সংকট
নিকট ভবিষ্যতে পৃথিবীর অনেক অংশেই তীব্র জল–সংকট দেখা দেবে৷ গঙ্গা, যমুনা, টেমস ইত্যাদির মত অনেক বড় বড় নদীর জল খুব দূষিত হয়ে পড়েছে৷ এদের জল পানযোগ্য তো নয়ই, যদি এই জলে হাত–পাও ধোয়া হয়, তাহলেও রোগ সংক্রমণের সম্ভাবনা থেকে যায়৷ এর একমাত্র সমাধান হ’ল বৃষ্টির জলের ওপর নির্ভর করা৷ আমাদের বৃষ্টির জলধারা সঞ্চয় করে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে বিজ্ঞানের উন্নতি ঘটিয়ে হিলিয়াম গ্যাস বা অন্যান্য প্রক্রিয়ায় কৃত্রিম বৃষ্টি সৃষ্টি করতে হবে জলভরা মেঘ যা সমুদ্রে বৃষ্টিপাত ঘটায় তা স্থলভূমির দিকে টেনে আনতে হবে৷ অধিক থেকে অধিকতর সংখ্যায় কেবল গভীর নলকূপ খনন করে চলা কোন সমাধানই নয়৷ বরং বৃষ্টিপাত যেখানে হচ্ছে, ঠিক সেই জায়গায় জলকে সংগ্রহ করে রাখবার চেষ্টা করতে হবে৷ এই জন্যে অবিলম্বে ওইসব জায়গায় অনেক পুকুর, খাল, ছোট বাঁধ, জলাধার, হ্রদ তৈরী করে বৃষ্টির জলকে পানীয় জল হিসেবে ব্যবহারের জন্যে সঞ্চয় করে রাখতে হবে৷ অদূর ভবিষ্যতে মানবতা যে জল–সংকটের সম্মুখীন হবে তা থেকে বাঁচবার এই হচ্ছে একমাত্র উপায়৷ জাগতিক ক্ষেত্রে দুই ধরনের বিপর্যয়ের সম্ভাবনা থাকে –এক হচ্ছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, দ্বিতীয় হচ্ছে মনুষ্য সৃষ্ট বিপর্যয়৷ আজকে যদিও মনুষ্য সৃষ্ট বিপর্যয়ের সংখ্যাই যেন বেড়ে যাচ্ছে, কিন্তু তার মধ্যেই মানুষ টাইফুন, বন্যা, খরা, ভূমিকম্প ইত্যাদির মত প্রাকৃতিক বিপর্যয়েরও সম্মুখীন হচ্ছে৷ মানুষ এইভাবে নানারকম দুর্বিপাকের কবলে পড়লেও, প্রলয় বলে কিছু কোন কালেই হবে না৷ প্রলয়ের ভ্রান্ত ধারণাটাই দাঁড়িয়ে আছে ভাবজড়তা আর কুসংস্কারের ওপর৷
মনুষ্য সৃষ্ট দুর্বিপাক দুই ধরনের –– প্রথমটা হ’ল কোনো জায়গায় মানুষের সমাজকে দ্বিধাবিভক্ত, ত্রিধাবিভক্ত করে ফেলা৷ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হ’ল ইজরায়েল–প্যালেষ্টাইন্ সংঘর্ষ আর উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের মধ্যে যুদ্ধ৷ অখণ্ড ভারতকে ভেঙ্গে ভারত, পাকিস্তান আর পরবর্তীকালে বাংলাদেশের সৃষ্টি ত্রিধাবিভক্ত করার উদাহরণ৷ পরিবেশের ধ্বংসসাধন করে আর কয়লা, তেল ও জলের মত মাটির নীচেকার সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার করে মানুষ নিজে এক বড় বিপর্যয়কে ডেকে আনছে৷ জঙ্গল উচ্ছেদের মধ্যে দিয়ে মানুষ পরিবেশের চরম ধ্বংসসাধন করছে৷ এর ফলে বঙ্গোপসাগর থেকে আগত বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনাযুক্ত মেঘ সমগ্র ভারতবর্ষের ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে আরব সাগরের ওপর বৃষ্টিপাত ঘটাচ্ছে৷ এর অর্থ হ’ল, যে মেঘ আগে মগধে বৃষ্টিপাত ঘটাত তা এখন আরব সাগরের ওপর বর্ষিত হচ্ছে৷ এর ফলশ্রুতিতে আরব সাগরের জলস্তর উঁচু হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বঙ্গোপসাগরের জলে লবণাক্ত ভাব বেড়ে যাচ্ছে৷ এর ফলে আবার ভারতের উপকূল অঞ্চলের জলস্তর উঁচু হচ্ছে, তার সঙ্গে ভারত উপমহাদেশের স্থলভূমি সঙ্কুচিত হয়ে আসছে আর ভূমিক্ষয় বেড়ে চলেছে৷ পৃথিবীর প্রায় দুই–তৃতীয়াংশ ভূভাগ হ’ল জলের তলায় আর এক–তৃতীয়াংশ হ’ল স্থলভাগ৷ কিন্তু নির্বিচারে বন ধ্বংসের ফলে জলভাগ বেড়ে যাচ্ছে অথচ ভূভাগ কমে আসছে৷
পরিবেশ ধ্বংসের আর একটি উদাহরণ হ’ল ভূ–নিম্নস্থ সম্পদের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার৷ মাটির নীচেকার এই সব সম্পদ খনন করে বাইরে নিয়ে আসার ফলে বিশাল ও গভীর খাদের সৃষ্টি হচ্ছে যা ঠিক ভাবে ভরাট করে দেওয়া উচিত৷ অনেক দেশে মাটির নীচে থেকে কয়লা উত্তোলনের পরে বালি দিয়ে সেই স্থান ভরাট করে দেওয়া হয়৷ তা যদি না করা হয় তাহলেই সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলি অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বেশী ভূমিকম্প–প্রবণ এলাকায় পরিণত হবে৷ শুধু তাই নয় –না ভরাট করা খাদ পৃথিবীর ভূমি–সংরচনাকেই দুর্বল করে দেবে যার ফলে সমগ্র অঞ্চলটাই একদিন ধসে যাবে৷
আরব দেশগুলি মাটির নীচে থেকে তেল উত্তোলন করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে চলেছে৷ বেশ কিছু বছর আগে সেই দেশের নেতারা বুঝলেন যে তেলের উৎপাদন এইভাবে চিরকাল চলবে না৷ তাই তেলের সরবরাহ শেষ হয়ে গেলে তাদের দেশের ভবিষ্যৎ কি হবে, এই নিয়ে তাঁরা ভাবনা চিন্তা শুরু করলেন৷ তাদের দেশে জলস্তর নীচে নেবে যাচ্ছে আর মরুভূমির পরিধি বেড়ে যাচ্ছে, এই দেখে তারা উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠলেন৷ এই সমস্যা সমাধান করার জন্যেই তাঁরা মাটি আর মিষ্টি জল আমদানী করার সিদ্ধান্ত নিলেন৷ তারপর থেকে যেসব গাছপালা তাঁরা লাগিয়েছিলেন আজ তা আট–দশ বছরের হয়েছে৷ আর এর মধ্যেই সেই সব দেশের মানুষের প্রথম বন্যা দেখার মত অভিজ্ঞতা হয়েছে৷ স্থানীয় মানুষের অনেকে এর আগে বন্যা কখনো দেখেননি৷ আর ছোট ছোট শিশুরা এত বৃষ্টি দেখে আশঙ্কায় চিৎকার করে উঠেছিল৷
পৃথিবীর অধিকাংশ স্থানে ভূ–গর্ভস্থ জলের অত্যধিক ব্যবহারের ফলে মরুভূমি তৈরী হওয়ার মত পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে৷ ভূ–গর্ভস্থ জল নীচে নেমে যাওয়ার অর্থই হ’ল ভূ–পৃষ্ঠের কাছাকাছি মাটি শুকিয়ে যাওয়া, যার ফলে গাছপালাও শুকিয়ে মরে যায়৷ রাজস্থানের অনেক অংশে ঠিক এই রকমটাই হয়েছে৷ একমাত্র ব্যাপক বনসর্জন এই মরুভূমি হওয়ার করুণ পরিণতি থেকে বাঁচাতে পারে৷
মানুষ অতীতে জলের আকাল আর খরার কবলে পড়ে অনেক ভুগেছে আর ভবিষ্যতে যদি ওই ব্যাপারে উপযুক্ত ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে তারা আরও ভুগবে৷ যদি বন ধ্বংস ও ভূগর্ভস্থ জলকে নিয়ে যথেচ্ছাচার চলতে থাকে তাহলে পৃথিবীর অনেক দেশ ভয়ংকর জল সংকটের মধ্যে পড়বে৷ এই মর্মান্তিক পরিণতি থেকে বাঁচবার একমাত্র উপায় হ’ল অবিলম্বে জলসম্পদ সংরক্ষণের জন্যে একটি বিকেন্দ্রিত পরিকল্পনা রূপায়িত করা৷
খরার কারণ সমূহ
খরা কেন হয়? এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলি কী কী? এর তিনটি প্রধান কারণ হ’ল নিম্নরূপ ঃ–
প্রথম, ব্যাপকভাবে গাছপালা ও বন ধ্বংস করা৷ দ্বিতীয়, সমুদ্র ও মহাসাগরের ওপর নিম্নচাপ তৈরী হওয়ার প্রাকৃতিক নিয়ম৷ আর তৃতীয় কারণ হ’ল সূর্য সহ অন্যান্য জ্যোতিষ্ক্, যেমন–ধূমকেতু–নেক্ষুলা বা গ্যালাক্সির কৌণিক গতির হঠাৎ পরিবর্তন৷
বন উচ্ছেদ খরার জন্ম দেয় কেননা এর ফলে গাছপালা মাটিকে সরস রাখতে পারে না৷ সাধারণ অবস্থায় গাছের ছোট ছোট আঁশযুক্ত শেকড় মাটি থেকে প্রচুর জল শুষে নেয় ও তা ধরে রাখে যা ধীরে ধীরে মাটিতে ছাড়তে থাকে৷ উদাহরণস্বরূপ, গ্রীষ্মকালে বাংলার ধানক্ষেতে দেখা যাবে যে ক্ষেতের ধারে নিচু অংশে অল্প অল্প জল জমা হচ্ছে৷ জল এল কোথা থেকে? জমিতে দাঁড়ানো ফসলের গোড়া থেকেই তা বেরিয়ে আসে৷ কিন্তু যখন ধান ও সহকারি ফসল কাটা হয়ে যায় তখন দেখা যায় সেই জলও শুকিয়ে যাচ্ছে৷ মানুষই বনোচ্ছেদের কারণ, তাই মানুষকেই নিজের প্রয়াসের দ্বারা এই সমস্যা সমাধান করতে হবে৷
খরার দ্বিতীয় ও তৃতীয় কারণ বর্তমানে মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে৷ ভবিষ্যতে আবহ বিজ্ঞান ও সামুদ্রিক বিজ্ঞানের •meteorological and marine sciences) উন্নতি হলে মানুষ আংশিক ভাবে দ্বিতীয় কারণকে প্রভাবিত করতে পারবে বা তা থেকে নিস্তার পেতে পারবে৷ তৃতীয় কারণ একমাত্র নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন পরম চৈতন্যসত্তা৷ অবশ্য মানুষ যদি পজিটিভ মাইক্রোবাইটার পথ নেয় আর পরম চৈতন্যসত্তার কৃপা পায়, তাহলে মানুষও তৃতীয় কারণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে৷
গ্রহ–তারা–জ্যোতিষ্ক্দ কৌণিক গতির হঠাৎ পরিবর্তনের ফলে কীভাবে খরা হতে পারে? কিছু ধূমকেতু আছে যার গতিপথ আগে থেকে স্থিরীকৃত হয়ে থাকে৷ আর জ্যোতির্বিদরা তাদের পৃথিবীর কক্ষপথে আগমন ও তজ্জনিত সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে জানতে পারেন৷ কিন্তু কিছু কিছু ধূমকেতু আছে যারা আগাম কোনো সতর্ক বার্তা ছাড়াই হঠাৎ এসে উপস্থিত হয়৷ যখন এই রকম কোনো শক্তিশালী জ্যোতিষ্কের হঠাৎ আগমন হয় বা তাদের কক্ষপথে যদি হঠাৎ কোনো পরিবর্তন ঘটে তাহলে তাদের মহাকর্ষীয় টানে ঋতুচক্র বা সৃষ্টিধারার স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপে বাধা সৃষ্টি হতে পারে৷ যেমন কোনো শক্তিশালী ধূমকেতু বা উল্কার প্রবল মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে মেঘ তৈরী হওয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে৷ সংস্কৃতে এই অবস্থাকে বলা হয় বক্রীদশা৷
বিশাল সংখ্যায় পজিটিব বা নেগেটিব মাইক্রোবাইটামের একত্র সমাবেশের ফলে উল্কা, ধূমকেতু বা উপগ্রহের মধ্যে এক ধরনের বিচ্যুতি আসতে পারে৷ বিশাল মহাশূন্যে সবকিছুর গতি–প্রকৃতি নির্ভর করে পজিটিব ও নেগেটিব মাইক্রোবাইটার গতি প্রকৃতির ওপর৷
জ্যোতিষ্কের কৌণিক গতি মানুষের মনকেও প্রভাবিত করে৷ ধর, শান্ত পূর্ণিমা রাতে তুমি বাইরে কোথাও আছ, মৃদুমন্দ ঠাণ্ডা বাতাস তোমার শরীরকে জুড়িয়ে দিচ্ছে৷ স্বাভাবিক ভাবে এই পরিবেশে এক সুন্দর ভাললাগার অনুভূতি তোমার মনে বিরাজ করবে৷ ধর, এই অনুভূতি তোমার মধ্যে অনেকক্ষণ ধরে আছে –– কিন্তু তার মধ্যে এক সময় হয়ত তুমি দেখলে যে তোমার স্নায়ুকোষগুলো কেমন যেন নির্জীব হয়ে আসছে৷ আর এই অভিজ্ঞতা যদি একটি নির্দিষ্ট সীমার বাইরে চলে যায়, তোমার চিন্তাশক্তি বিকল হয়ে যেতে পারে, যার ফলে কোনো মানসিক রোগও দেখা দিতে পারে৷ [বাইরের অন্য কিছুর প্রভাবে, যেমন কৌণিক গতির পরিবর্তন] মানুষের শারীর –– মানসিক সংরচনার মধ্যে পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার ফলে এটা হয়৷
ধর, আট বছর বয়সে তোমার জীবনে কোনো ঘটনা ঘটেছিল৷ আমরা জানি এই বিশ্বে একটি জিনিস অন্য একটি জিনিসের সঙ্গে হুবহু এক নয়, যদিও পারস্পরিক সাদৃশ্য থাকতে পারে৷ এখন আট বছর পরে যদি অনুরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তাহলে ১৬ বছর বয়সে একই রকমের ঘটনা হয়ত তোমার জীবনে ঘটে যেতে পারে৷ তোমাদের দেখতে হবে, যে বিশেষ পরিস্থিতিতে একজনকে অতীতে কোনো কষ্টকর ও দুঃখজনক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, তাকে যেন কখনই সেই পরিস্থিতিতে পড়তে না হয়৷ কেননা সেই ক্ষেত্রে তা মানুষটির আধ্যাত্মিক প্রগতিকে ব্যাহত করবে৷ এই ব্যাপারটা জাগতিক ও মানসিক ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য৷
মানুষের গতি হচ্ছে পরিবেশগত ভারসাম্য অর্জনের দিকে– চরম সংশ্লেষণাত্মক স্থিতির দিকে৷ অন্তর্জগতে সমতা বজায় রাখতেই হবে৷ কেন না এর ফলে আধ্যাত্মিক প্রগতি সম্ভব হবে৷ পরিবেশগত শৃঙ্খলা বজায় রাখা শুধু এই গ্রহের জন্যে নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্যে৷ আর তা ভেতরে বাইরে দু’দিকেই বজায় রেখে চলতে হবে৷ কোনো জ্যোতিষ্কের কৌণিক স্থানচ্যুতি যেমন মানুষের মনকে প্রভাবিত করবে, তেমনি বহির্জাগতিক দিক থেকে বিশ্বকে তো প্রভাবিত করবেই তাই অন্তর্জগত–বহির্জগ্ সমতা অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে৷ মানুষের জীবনের সর্বক্ষেত্রেই এই সূক্ষ্ম সমতা বোধ বজায় রেখে চলতে হবে –– এটাই হ’ল সত্যিকারের পরিবেশগত ভারসাম্য৷
নলকূপের মাধ্যমে সেচ ব্যবস্থার ত্রুটি
আমি আগেই বলেছি অধিক সংখ্যায় নলকূপ তৈরী করে দিলেই জল–সংকটের সুরাহা হবে না৷ এই ব্যবস্থায় ত্রুটি কী? নলকূপের মাধ্যমে সেচ জলস্তরকে নীচে নামিয়ে দেবে, আর এর অনবরত ব্যবহারের ফলে ভূ–গর্ভস্থ জলের স্রোত শুকিয়ে যাবে৷ প্রথমে হয়ত এর কুফল ঠিকভাবে বোঝা যাবে না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে এক উর্বর এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হয়ে গেল৷ আসলে যদি ভূ–গর্ভস্থ জলের স্তর কুড়ি–পঁচিশ ফুটের ওপরে থাকে, তাহলে ভূ–পৃষ্ঠের গাছ–পালার ক্ষতি হবে না, কিন্তু তা যদি পঞ্চাশ ফুটের নীচে নেমে যায় তাহলে ভূ–পৃষ্ঠের মাটি এক বন্ধ্যা, পতিত জমিতে পরিণত হতে বাধ্য৷
গভীর নলকূপের মাধ্যমে সেচের কুফলগুলি নিম্নরূপ ঃ–
১৷ পার্শ্ববর্তী অগভীর নলকূপের জল শুকিয়ে যায়, যার ফলে পানীয় জল পাওয়া সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়৷
২৷ গাছ, ফলের বাগান, বড় বড় উদ্ভিদ যথেষ্ট পরিমাণে জল মাটির নীচে পায় না৷ ফলস্বরূপ তারা শুকিয়ে মরে যায়৷ নলকূপের মাধ্যমে যদি ব্যাপক ভাবে কৃষিকাজ করা হয় তাহলে গ্রামাঞ্চলের সবুজ পটভূমি ৩০ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যেই শুকিয়ে মরুভূমিতে পর্যবসিত হবে৷
৩৷ কিছু গভীর নলকূপের ক্ষেত্রে শত্রু পদার্থ –– যেমন ভারী খনিজ বা খনিজ লবণের মত মাটির পক্ষে ক্ষতিকর পদার্থ –– জলের সঙ্গে মিশে তার লবণাক্ত ভাগকে বাড়িয়ে দিয়ে সমস্যা তৈরী করে৷ ফলে শেষ পর্যন্ত জমি অনুর্বর ও চাষের কাজে অনুপযুক্ত হয়ে দাঁড়ায়৷ যখন নলকূপের উৎস শুকিয়ে যায়, তখন ওই নলকূপের জল যা চাষের জন্যে ট্যাঙ্কে জমিয়ে রাখা হয়েছিল তাও শুকিয়ে যায়৷
নলকূপের মাধ্যমে সেচ শুধু সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে, কেননা তা শেষ পর্যন্ত চারিপাশের পরিবেশের বিপুল ক্ষতি করে দেয়৷ সেচের জন্যে বিভিন্ন বিকল্প ব্যবস্থা হ’ল –– নদী সেচ, পুকুর–বাঁধ–সায়রে মাধ্যমে সেচ, তোলা সেচ, খাল/নালার মাধ্যমে সেচ৷ সেচের জল হ’ল ঘুরন্ত লাটিমের মাথার মত গুরুত্বপূর্ণ আবশ্যকতা৷ এ ছাড়া কৃষিকাজ অসম্ভব৷
সর্বশ্রেষ্ঠ সেচ পদ্ধতি
সেচের জন্যে সবচেয়ে ভাল পদ্ধতি হ’ল –– পুকুর–খাল–বাঁধ, জলাশয়, আর জলাধারের মাধ্যমে ভূ–পৃষ্ঠের জলকে সংরক্ষণ করা৷
রাঢ় ও ওড়িষ্যার উদাহরণ নেওয়া যাক্৷ এই দুই অঞ্চলের সম্ভাবনাকে ঠিকমত কাজে লাগানো হয়নি বা তার উপযুক্ত বিকাশেরও ব্যবস্থা করা হয়নি৷ এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় সম্পদ হ’ল ভূ–গর্ভস্থ সম্পদ যা ঠিকমত ব্যবহারে আনা উচিত ছিল, কিন্তু বাস্তবে এ সম্পর্কে কিছুই করা হয়নি৷ জমির ক্ষমতাকেও যথোপযুক্ত ভাবে কাজে লাগানো উচিত ছিল, কিন্তু তাও অবহেলার শিকার হয়ে রয়ে গেছে৷
এই অঞ্চলের ভূ–পৃষ্ঠস্থ জলের সম্ভাবনাকে কিভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে? এই অঞ্চলের বৃষ্টিপাত খুবই কম, বছরের একটা সময় শুধু বৃষ্টি হয়, বাকী সময় শুকনো থাকে৷ নলকূপেরও ব্যবস্থা নেই বললেই চলে৷ আর তোলা সেচ বা খাল–নালার মাধ্যমে সেচেরও অবস্থা তথৈবচ৷ শতকরা ৬৫ ভাগ জমি পাথুরে ও বালু যুক্ত৷ মোটা দানার কিছু শস্যই এই মাটিতে হতে পারে৷ তাই রাঢ়ে আমাদের দু’টি জিনিস অবিলম্বে করতে হবে –– ছোট ছোট অনেক পুকুর, বাঁধ, সায়র তৈরী করতে হবে, আর সব নদী–জোড়–নালার দুই পাশে ব্যাপক বনসর্জন করতে হবে৷ রাঢ় হ’ল তরঙ্গায়িত মাটির দেশ৷ তাই বড় বড় জলাধার এখানে সহজে তৈরী করা সম্ভব হবে না, কিন্তু ছোট ছোট অনেক সায়র ও পুকুর তৈরী করা যাবে৷ ছোট ছোট পুকুরের তুলনায় বড় ও গভীর জলাধার কোনো উপকারে আসবে না৷ তাই এই প্রয়াসকে উৎসাহ দিয়ে লাভ নেই৷ তাছাড়া বড় জলাধার মানেই হ’ল জল অনেক ওপরে তুলে খাল/নালার মাধ্যমে জমিতে পৌছনোর ব্যবস্থা করতে হবে৷ রাঢ়ে এই ব্যবস্থায় জলের চাপ কম হবে কেননা জল জলাধার থেকে খালের মাধ্যমে পৌঁছাবার সময়ে দেখা যাবে উঁচু নিচু পাহাড়ী জমিতে খাল বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে৷ তাই বড় বড় জলাধার তৈরী করতে বিশাল অঙ্কের অর্থ লগ্ণী করলে তা ব্যর্থ হতে বাধ্য৷ অথচ সেই একই অর্থে অনেক ছোট পুকুর ও সায়র তৈরী করা যাবে৷ প্রতিটির জন্যে লাখ টাকা খরচ ধরে যদি অনেক ছোট ছোট বাঁধ (check dams) তৈরী করা হয় তা হলে দেখা যাবে যে এগুলি থেকে কোটী কোটী টাকার প্রতিদান পাওয়া যাচ্ছে৷
ছোট ছোট পুকুর বা বাঁধের ক্ষেত্রে হয় কি? –– না, খালের অতিরিক্ত জল যা ক্ষেতের দিকে চলে যেত তা আবার জলের মূল উৎসের কাছে ফিরিয়ে এনে জলের অপচয়কে এড়ানো যায়৷ ছোট স্তরের সেচখালের জলকে খুব কম দূরত্বে নিয়ে যেতে হয়৷ তাই অধিকাংশ সময় পার্শ্ববর্তী জমিতে খুব ভালভাবে সেচ হয়ে যায়৷ অবশ্য অন্য সময়, যেমন বর্ষাকালে অতিরিক্ত জল থাকবেই যা মূল উৎসে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হয় বা নদীর নিম্নাংশে ব্যবহার করতে হয়৷ এই ব্যবস্থায় বর্ষাকালে বন্যার মত পরিস্থিতি হলে তা প্রতিহত করা যায়৷ এইভাবে নদীর ওপর যে ছোট বাঁধ তৈরী হয়েছে তাকেও ক্ষতির হাত থেকে বাঁচানো যায়৷ কর্ষকদের যত্নবান হতে হবে যেন জমিতে অত্যধিক পরিমাণে অজৈব সার ব্যবহার না করা হয়৷ কেননা সেক্ষেত্রে রাসায়নিক পদার্থ নদীর জলকে দূষিত করে দেবে ফলে মানুষ, জানোয়ার, মাছ, গাছ আর পরিবেশের ক্ষতি হবে৷ তাই অজৈব সারের বদলে জৈব সার ব্যবহার করাই বাঞ্ছনীয়৷
কোনো বৃষ্টিছায়া (rain shadow) অঞ্চলে সেচকার্য কীভাবে করা উচিত? যখন জলভরা মেঘ সমুদ্র থেকে এসে পাহাড়ে ধাক্কা মারে তখনই বৃষ্টিপাত হয়৷ পর্বত শ্রেণীর যে অংশটা সমুদ্রের দিকে থাকে তা প্রচুর বৃষ্টি পায়৷ কিন্তু উল্টোদিকে অন্তর্ভূমি (inland) কম বৃষ্টি পায়৷ যে অংশটা প্রচুর বৃষ্টিপাত পায় তা হ’ল বৃষ্টি–সম্মুখ অঞ্চল আর যা কম বৃষ্টি পায় তা হ’ল বৃষ্টিচ্ছায়া অঞ্চল৷ সমগ্র তেলেঙ্গানা এলাকা ও মহারাষ্ট্রের পুণে ও তৎসন্নিহিত অংশ বৃষ্টিচ্ছায়া অঞ্চল৷
পুণে এলাকায় কীভাবে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে? এ জন্যে দু’টি প্রধান উপায় আছে৷ এক হ’ল, পর্বতশ্রেণীর সন্নিহিত উপকূল এলাকায় জল পাম্প করে তুলে এমন জায়গায় ফেলতে হবে যাতে তা অন্তর্ভূমি এলাকায় গড়িয়ে চলে যেতে পারে৷ দ্বিতীয় হ’ল, বৃষ্টি–সম্মুখ অঞ্চলের দিক থেকে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে বৃষ্টিচ্ছায়া অঞ্চল পর্যন্ত জল নিয়ে যাওয়া৷ এই দ্বিতীয় পদ্ধতিই সবচেয়ে সস্তা৷ ভালভাবে তৈরী এই ধরনের সুড়ঙ্গ একশ পঞ্চাশ বছরের মত টিকবে৷