বিশ্বের বিভিন্ন পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীকে সাহায্য করা আমাদের আশু কর্ত্তব্য৷ যেহেতু বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন সামাজিক–র্থনৈতিক ব্যবস্থাগুলি পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন পূর্ত্তির প্রতি ও সামগ্রিকভাবে সমাজের উন্নতির প্রতি নজর না দিয়ে সমাজের এক বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করে’ চলেছে, সেইজন্যেই পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক অবদমনের শিকার হচ্ছে৷
উদাহরণস্বরূপ, মার্কসবাদে রাষ্ট্র যেহেতু কেবল সর্বহারাদের কল্যাণের কথা ভাবে, তাই যারা সর্বহারা নয় তারা অবদমিত ও প্রদমিত হয়৷ বলা হয়ে থাকে এই ব্যবস্থা শূদ্রের শাসন ব্যবস্থা৷ কিন্তু বাস্তবে শূদ্রদের দ্বারা কোন শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হতে পারে না৷ সর্বহারার একনায়কতন্ত্রের ধারণাটাই অবাস্তব, অসম্ভব ও অবৈজ্ঞানিক৷ বাস্তবের মাটিতে মার্কসবাদের কোন শিকড় নেই৷ এটা একটা উদ্ভট তত্ত্ব৷ তাই ১৯৭৭ সালেই (তদানিন্তন) সোভিয়েত রিপাবলিক সর্বহারার শাসন ব্যবস্থার মত উদ্ভট ধারণাকে পরিত্যাগ করে’ কল্যাণ রাষ্ট্রের ঘোষণা করেছিল৷ যাইহোক, মার্কসবাদ হ’ল এক তাসের ঘর যা হাল্কা হাতুড়ির টোকাতেই ভেঙ্গে পড়বে৷ বাস্তব বিশ্বে মার্কসবাদ কোন সাফল্য রেখে যেতে পারবে না৷
পুঁজিবাদে বা গণতন্ত্রে রাষ্ট্র যদিও তত্ত্বগত ভাবে রাষ্ট্র যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠের কল্যাণকামী, বাস্তবে কিন্তু সংখ্যালঘিষ্ঠ বৈশ্য তথা পুঁজিবাদীদের স্বার্থরক্ষাকারী৷ আর বাকীরা পর্যবসিত হয় দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে৷
প্রাউটের সমাজ ব্যবস্থায় সকলের কল্যাণই রাষ্ট্রের কাম্য–‘সর্বজন হিতায়’৷ এই ব্যবস্থায় কেউই দমিত বা অবদমিত হয় না৷ প্রাউট সদবিপ্রের শাসনকে সমর্থন করে’৷ সদবিপ্রেরা যেহেতু সমাজের সকল শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে’, সেহেতু কেবল সদবিপ্রেরাই সকল গোষ্ঠীর কল্যাণকে সুনিশ্চিত করতে পারে৷
প্রাউট প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্যে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে৷ উদাহরণস্বরূপ, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীদের মধ্যে উপজাতিরা সব থেকে বঞ্চিত৷ ত্রিপুরা সহ ভারতের বিভিন্ন জায়গার ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উপজাতিরা দরিদ্র ও অশিক্ষিত৷ তাদের সামাজিক–র্থনৈতিক উন্নতি বিধানের উদ্দেশ্যে অনতিবিলম্বে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত৷ বিশেষ ব্যবস্থা সমূহের মধ্যে থাকবে –– শিক্ষা ক্ষেত্রে অসাম্য দূর করা, ব্যাপক কুটিরশিল্পের প্রচলন, সুষ্ঠু কৃষি সহযোগিতা, অতিরিক্ত সেচের জল সরবরাহ, বিদ্যুৎ সহ অন্যান্য শক্তি উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা, আর রেল ও টেলিফোনের সাহায্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার সুযোগ৷
এছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে, ও তাদের অবলুপ্তির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে৷ অনতিবিলম্বে এদের রক্ষা করার ব্যবস্থা করা উচিত৷ এইসব জনগোষ্ঠীর মধ্যে পড়ে আফ্রিকার জুলু ও পিগমী, ৰাংলার লোধা, ছোটনাগপুরের বীরহোড়, মালদহের মালো, বিহারের রোহতাস জেলার ভোজপুরী ভাষাভাষী আঙ্গার, কশ্মীরের লাদাখী, ইয়ূরোপের রোমাঁশ, অষ্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যাণ্ডের মাওরী, ও কিন্নৌর–এর সিডিউল কাষ্টরা৷ রাঢ় ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের কৈবর্ত্তদের অবলুপ্তির আশঙ্কা না থাকলেও, তাদের জন্মহার সাধারণ জন্মহার থেকে কম৷ এই সমস্যা সমাধানে অবিলম্বে সচেষ্ট হতে হবে৷
পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর চাকরী প্রাপ্তি ও তাদের অর্থনৈতিক উন্নতির উদ্দেশ্যে কিছু কিছু দেশে সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু আছে৷ প্রাউট–আদর্শ অনুসারে অবশ্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা থাকা উচিত নয়৷ যখন প্রাউট–ব্যবস্থার প্রবর্ত্তন হবে, তখন যেহেতু সকলের প্রগতিই সুনিশ্চিত হবে, সেহেতু কেউই চাকরীতে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করবে না৷ তখন এমন এক কর্মসংস্থান হবে যে, সে সময় মানুষকে কাজ খুঁজতে হবে না, কাজই মানুষকে খুঁজবে৷
যাই হোক, বর্তমান সামাজিক–র্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের দুর্দশা মোচনের উদ্দেশ্যে তাৎক্ষণিকভাবে নিম্নলিখিত অগ্রাধিকার ব্যবস্থা চালু করা যায় ঃ–
হ্ণ জন্মসূত্র যাই হোক না কেন, পিছিয়ে পড়া, গরিব পরিবারের সদস্য চাকরী ও শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রথম অগ্রাধিকার পাবে৷
হ্ণ গরিব, কিন্তু পিছিয়ে পড়া নয়, এমন পরিবারের সদস্য দ্বিতীয় অগ্রাধিকার পাবে৷
হ্ণ গরিব নয়, কিন্তু পিছিয়ে পড়া পরিবারের সদস্য তৃতীয় অগ্রাধিকার পাবে৷
হ্ণ সবশেষে সুযোগ পাবে গরিবও নয়, পিছিয়ে পড়াও নয়, এমন পরিবারের সদস্য৷
এখানে ‘পিছিয়ে পড়া পরিবার’ বলতে ৰোঝাবে যে পরিবারের সদস্য অতীতে কোন চাকরী বা শিক্ষার সুযোগ পায়নি৷ যতক্ষণ না দেশ দারিদ্র্য মুক্ত হয়, অর্থাৎ যতক্ষণ না সকলের নূন্যতম প্রয়োজন–প্রাপ্তি সুনিশ্চিত হয়, ততক্ষণ এই পরিবারগুলি এই সুবিধা পেতে থাকবে৷
এইভাবে, কে কোন্ জাতে জন্মালো তা না দেখে, সেই পরিবারের আর্থিক অবস্থা অনুযায়ী শিক্ষা ও চাকুরীর ক্ষেত্রে এই অগ্রাধিকার সূত্র মেনে চলতে হবে৷ তথাকথিত নীচু জাতের একজন মুচি যদি ধনী হয়, সেক্ষেত্রে সংরক্ষণের কোন প্রয়োজনই নেই, আবার তথাকথিত উচ্চজাতের অন্তর্গত একজন মৈথিলী ৰ্রাহ্মণ দরিদ্র হতে পারেন৷ সেক্ষেত্রে তাঁর জন্যে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে৷ এই ধরনের অগ্রাধিকার ভিত্তিক সংরক্ষণ ব্যবস্থায় সমগ্র সমাজের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হবে৷
বহু অনগ্রসর ও উন্নয়নশীল দেশে পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠীর উন্নতির প্রশ্ণে সংঘর্ষ চলছে৷ উদাহরণস্বরূপ, বিহারে জাত–পাত ভিত্তিক তথাকথিত উন্নত ও অনুন্নত শ্রেণীর মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব চলছে৷ যদি এই ধরনের সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু করা হয় তাহলে ভারতসহ বিশ্বের সমস্ত দেশেই উন্নত ও অনুন্নতদের মধ্যে গোষ্ঠী সংঘর্ষের সমস্ত সম্ভাবনা দূর করা যাবে৷ সেই সঙ্গে, সামাজিক ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের সুযোগও এসে যাবে৷ জাত–পাত–ধর্মমত– নির্বিশেষে সরকার সকলের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা প্রভৃতি অর্জনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারবে৷ এই পদ্ধতিতে পশ্চাদপদদের মন থেকে সমস্ত হীনম্মন্যতা দূর হয়ে যাবে, ও সকলেই নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী নিজেদের জীবনযাত্রা নির্বাহ করার মত আয় করার সুযোগ পেয়ে যাবে৷
জুন ১৯৭৯, কলিকাতা