উত্তুঙ্গ তরঙ্গমালায় বিক্ষুব্ধ এক মহাসমুদ্র৷ যে সমুদ্রের নাম নেই, গোত্র–পরিচয় নেই৷ কে নাম দেবে, কে এর পরিচিতি অন্যকে শোণাবে কারণ মানুষ যে তখন পৃথিবীতে আসেনি৷ সে আজ থেকে তিরিশ কোটি বৎসর আগেকার কথা৷*ঙ্মনৃতাত্ত্বিক দিক থেকে প্যালিজোয়িক যুগের কার্বোনিফারসের সময়কাল (যখন গাছপালার উদ্ভব হ’ল) ২৭০–৩৫০ কোটি বছর আগে৷–সম্পাদক৷ৰ পার্বত্য ঊষর ভূমি সম্বন্ধে বলবার মত, নাম নেবার মত কোন বৃক্ষরাজিও তখন পৃথিবীতে আসেনি৷**ঙ্মৰীজযুক্ত গাছের প্রথম উদ্ভব মেসোজোয়িক যুগের ট্রাইয়াসিক কালের (২১০–২৫০ কোটি বছর আগে)৷–সম্পাদকৰ এই নাম–না–জানা গিরিভূমিকেই পরবর্তীকালে নাম দেওয়া হয়েছিল ‘রাঢ় দেশ’৷ ‘রাঢ়’ শব্দটি প্রাচীন অষ্ট্রিক ভাষার শব্দ যার মানে রক্ত–মৃত্তিকার দেশ৷ সেকালের সেই পৃথিবীতে আর্যাবর্ত ছিল না, ৰাংলা ও দক্ষিণের সমতল ভূমিও ছিল না, রাজস্থান ও গুজরাটের মরুভূমিও ছিল না৷ আরব সাগরের উত্তরাংশও ছিল না, ছিল দক্ষিণাংশ যা দাক্ষিণাত্য উপদ্বীপকে আফ্রিকার সঙ্গে, আন্দামান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, অষ্ট্রেলিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত করেছিল–কোথাও জলের ঊর্ধ্বদেশ দিয়ে কোথাও নিম্নদেশ দিয়ে৷ সেই মানুষ না–থাকা পৃথিবীতে সেদিনের সেই রাঢ়ভূমি ছিল আবার অন্যের চেয়েও বেশী প্রাচীন৷ তার তুষারাবৃত পর্বতশ্রেণী জন্ম দিয়েছিল অনেক নদীর৷ এই বরফ–গলা নদী সমুদ্রের দিকে এগিয়ে চলত–কখনও পূর্বমুখে, কখনও বা দক্ষিণ–পূর্ব মুখে৷
দিন এগিয়ে চলল, কাল এগিয়ে চলল অনাদি থেকে অনন্তের দিকে৷ ঝড়–ঝঞ্ঝায়–অশনি–সম্পাতে পর্বতগুলি ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে লাগল, তাদের মস্তকের তুষার–মুকুট ঝরে পড়ল, তাদের উচ্চতা কমতে লাগল৷ অবক্ষয়ে পর্বতগুলি যেমন যেমন ছোট হতে লাগল তেমনি দুই পর্বতের মধ্যবর্তী অববাহিকা উঁচু হতে লাগল৷ আজকে আমরা পশ্চিম রাঢ়ে যে তরঙ্গায়িত রক্ত–মৃত্তিকা দেখতে পাই–যে তরঙ্গ সামনের দিকে এগোতে এগোতে সুদূর নীলিমায় মিশে যায়, যে তরঙ্গ পশ্চাদ্দিকে পেছুতে পেছুতে কোন হারানো ঠিকানার ইঙ্গিত দিয়ে যায়–সেই তরঙ্গায়িত দেশ হ’ল আমাদের রাঢ়ভূমি৷
‘‘মিষ্টি রাঢ়ের মাটি–
সোনার লঙ্কা, সোনার স্বর্গ চেয়েও জানি খাঁটি৷’’
পর্বত ক্ষয় হতে থাকে, তারাই পরিবর্তিত রূপে বালি–পলিতে রূপান্তরিত হয়৷ রাঢ়ের নদীবাহিত বালি–পলি তৈরী করল পূর্ব রাঢ়৷ সে আজ লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি বৎসর আগেকার কথা৷
রাঢ়ের জন্মের বহু কোটি বৎসর পরে জন্ম নিল হিমালয়৷ হিমালয় থেকে বেরিয়ে এল হিমালয়–দুহিতা গঙ্গা ও হিমালয় তনয় ৰ্রহ্মপুত্র৷ তাদের জলবাহিত বালি–পলি নোতুন মাটি তৈরী করল, তৈরী হ’ল উত্তর ভারত, তৈরী হ’ল ৰাংলা৷ রাঢ়ের পূর্বে যে সমুদ্র ছিল এই বালি–পলিতে তার গর্ভদেশ উন্নত হতে হতে পূর্ব রাঢ়ের পরে–পূর্ব রাঢ়ের অনেক পরে, অনেক লক্ষ লক্ষ বছর পরে এক বিরাট সমতল ভূমি তৈরী হ’ল৷ সংস্কৃত ভাষায় সেই সমতল ভূমির নাম হচ্ছে সমতট, ৰাংলা ভাষায় ৰাগড়ী৷ আরও পূর্ব দিকে রাঢ়ের নদীবাহিত পলির সঙ্গে ৰ্রহ্মপুত্রের বালি–পলি মিশে তৈরী হ’ল বঙ্গ বা ডৰাক্৷ পশ্চিম রাঢ়ের মানুষ পূর্ব দিকে গিয়ে পূর্ব রাঢ়ে বসতি স্থাপন করলে৷ সে আজ লক্ষ লক্ষ বৎসর আগেকার কথা৷ মানুষের যদি জন্ম হয়ে থাকে দশ লক্ষ বছর পূর্বে তবে সেই দশ লক্ষ বছর পূর্বেকার পশ্চিম রাঢ়ের মানুষ তাদের জন্মের পূর্বেই পূর্ব রাঢ়কে তৈরী অবস্থায় পেয়েছিল৷ এমনকি, উত্তর ভারতেরও কিছুটা জেগে উঠেছিল মানুষ সৃষ্টির পূর্বেই৷ তবে সমতট ও ডৰাকের উদ্ভব হয়েছিল মানুষ পৃথিবীতে আসার কিছু পরে৷ পশ্চিম ও পূর্ব রাঢ়ের মানুষ অরণ্য কেটে সমতট–বঙ্গ ডৰাকে বসতি স্থাপন করেছিল৷ এই হ’ল রাঢ় ও ৰাংলার উৎপত্তিগত একটা পরিচিতি৷
মোটামুটি বিচারে সমতট বলতে আমরা ৰুঝি ঃ (১) পূর্ব মুর্শিদাবাদ, (২) নদীয়া, (৩) ২৪ পরগণা, (৪) কুষ্ঠিয়া, (৫) যশোর, (৬) খুলনা, (৭) পশ্চিম ফরিদপুর ও (৮) পশ্চিম বাখরগঞ্জ৷
মোটামুটি পূর্ব রাঢ় বলতে ৰুঝি ঃ (১) পশ্চিম মুর্শিদাবাদ, (২) বীরভূম জেলার উত্তরাংশ, (৩) পূর্ব বর্দ্ধমান, (৪) গোটা হুগলী, (৫) গোটা হাওড়া, (৬) পূর্ব মেদিনীপুর, (৭) বাঁকুড়া জেলার ইন্দাস থানা৷
পশ্চিম রাঢ় বলতে ৰুঝি ঃ (১) সাঁওতাল পরগণা, (২) বীরভূমের অধিকাংশ অংশ, (৩) বর্দ্ধমানের পশ্চিমাংশ, (৪) ইন্দাস থানা বাদে বাঁকুড়া জেলা, (৫) পুরুলিয়া জেলা, (৬) ধানবাদ জেলা, (৭) হাজারিবাগ জেলার (বর্তমান গিরিডি জেলা) কাস্মার, পেটারওয়াড, গোলা, জেরিডি ও রামগড় প্রভৃতি এলাকা, (৮) রাঁচী জেলার সিল্লি, সোনাহাতু, বুন্দু ও তামার থানা, (৯) সিংভূম জেলা, (১০) মেদিনীপুর জেলার ঝাড়গ্রাম মহকুমা, সদর উত্তর ও সদর দক্ষিণ মহকুমা৷