ৰাধাই প্রগতির লক্ষণ

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

ৰাধার গণ্ডী ডিঙিয়ে এগিয়ে চলার চেষ্টা করা সকল জীবের স্বাভাবিক ধর্ম৷ এটা যে কেবল মানুষেরই বৈশিষ্ট্য তা নয়৷ কিন্তু এই যে বন্ধনগত অনুপপত্তি এটাকে জয় করতে গেলে কেবল শারীরিক শক্তিই যথেষ্ট নয় মানসিক ও আধ্যাত্মিক শক্তিরও প্রয়োজন৷ পশুর ক্ষেত্রে শারীরিক শক্তি যথেষ্ট থাকা সত্বেও মানসিক শক্তির অভাব-নিৰন্ধন অথবা অল্পতা-নিবন্ধন সে বেশী দূর এগোতে পারে না৷ আর আধ্যাত্মিক শক্তি বলতে তার কোন কিছু নেই ৰললেই চলে৷ যে উত্তুঙ্গ পর্বতমালাকে দেখে পশু থেমে দাঁড়ায়, দুর্বলতর মানুষ তাকে অতিক্রম করে তার বুদ্ধিবলে৷ এই যে মানুষ পারে, পশু পারে না---এই যে পশু হেরে যায় শারীরিক ৰল থাকা সত্বেও এর কারণটা এই৷ স্পষ্টতঃই ৰোঝা যাচ্ছে যে এর কারণটা হল মানুষের উন্নত মানস শক্তি৷ কিন্তু এই উন্নত মানসিক শক্তিটা কি একদিনে এসেছে? সংঘর্ষ ও সমিতির মাধ্যমে বৌদ্ধিক উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে ও তার ফলে মানুষের মন আর মনের আবাস মস্তিষ্ক উন্নত হয়েছে৷ আর এই উন্নত মন ও মস্তিষ্কের বাহক হিসেবে সে একটা বিবর্তিত শরীর পেয়েছে---যে শরীরটা অন্যান্য পশুর থেকে অনেকখানি পৃথক৷ তার এই মানসিক পার্থক্যের সঙ্গে, তর্জ্জনিত শারীরিক পার্থকাটাও মানুষকে বিশেষভাবে বিশিষ্ট করে তুলেছে৷ এইখানেই মানুষের ৰাহদুরি৷

একটা ৰাধা এল৷ পশু জড় শক্তির দ্বারা সেই ৰাধাকে অতিক্রম করতে চাইৰে৷ আর মানুষ চিন্তা করবে, ভাবৰে, বুদ্ধির সাহায্যে কোন নূতন উপায় উদ্ভাাবন করে ৰাধাটাকে ডিঙিয়ে চলে যাবে৷ মনে রাখতে হবে---এই যে বাধা, এটা কেবল দৈহিক, দৈশিক, কালিক বা পাত্রিক ৰাধাই নয়৷ এর চেয়েও ৰড় ৰাধা রয়েছে---মানসিক, আধ্যাত্মিক৷

এদের মধ্যে দৈশিক, কালিক ও পাত্রিক ৰাধাগুলি আধিভৈতিক বাধার অস্তর্গত৷ কিন্তু আধিদৈবিক ও আধ্যাত্মিক ৰাধাগুলি---দৈশিক-কালিক-পাত্রিক ৰাধা -বাইরেকার জিনিস৷ আর এই আধিদৈবিক তথা আধ্যাত্বিক ৰাধার বিরুদ্ধে সংগ্রাম কেবল মানুষের পক্ষে সম্ভব, মানুষ্যেতর জীবের পক্ষে সম্ভব নয়৷ তবে আধিভৌতিক ক্ষেত্রে জীবজন্তু কিছুটা লড়াই করে থাকে৷ আধিদৈবিক ক্ষেত্রে মানুষের মুখ্য ৰাধা হল ভাবজড়তা৷

তাই গ্রামের লোকের মুখে, বাড়ীর লোকের মুখে, বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মুখে শুণতে শুণতে মনের মধ্যে সুচিকাভরণ করে দেওয়া হয় বিভিন্ন ভাবনাকে, মানুষ ৰড় হয়েও লেখাপড়া শিখেও যার বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে না৷ অসহায় হয়ে তার কাছে আত্মসমর্পণ করে৷ এ কী দুর্দৈব! এ ৰড় দুঃখের বিষয়! জানছি, বুঝছি এক, করছি আর এক রকম৷ কেন আর এক রকম করছি?---না, সেই যে আর এক রকমটা তার বিরোধিতা করবার মত মানসিক সৎসাহস নেই৷ বুঝছি, অমুক রোগ হলে অমুক চিকিৎসা করাই উচিত৷ করছিও তাই কিন্তু ভয়ও আছে৷ বিশেষ দেবী দেবতার প্রতি লুকিয়ে লুকিয়ে তার পূজোটা দিচ্ছি৷ ‘‘যেটা লেগে যায়, লাগে তো তুক না লাগে তাক৷’’ এটা একটা ভীষণ দুর্বলতা৷ এই দুর্বলতাটাকে ইংরেজীতে Dogma বলে, সংস্কৃত ভাষায় আমি নাম রেখেছি ‘ভাবজড়তা’৷ মানস ভূমিতে এই ভাবজড়তার বিরুদ্ধে মানুষকে প্রবলভাবে সংগ্রাম করে যেতে হৰে৷ এই ভাবজড়তা তার উত্তুঙ্গ ফণা বিস্তার করে মানুষকে গ্রাস করতে চাইছে৷ মানবতার স্বার্থে তার বিরুদ্ধে মানুষকে লড়তে হৰে৷ মানুষকে মুক্ত হতে হবে, ক্ষুদ্রতার বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে মানুষ দেখবে---আর একটা ৰড় ৰন্ধনের গণ্ডী পার হতে হচ্ছে৷ সেটা পার হয়ে দেখৰে---আর একটা ৰড় বন্ধন৷ এভাবে এগোতে এগোতে যখন সমস্ত ৰাধা নিঃশেষ চুর্ণীভূত হয়ে যাবে সেই দিনটি হৰে মানুষের মুক্তির দিন৷ সেই চরম দিনের প্রতীক্ষায় প্রতিটি মানুষকে সচেষ্টভাবে অপেক্ষা করতে হবে৷ নিশ্চেষ্টভাবে তাকিয়ে থাকলে চলবে না৷ সচেষ্টভাবে মানুষকে এগিয়ে চলতে হবে৷

আর শেষ ৰাধা হলো আধ্যাত্মিক জগতের ৰাধা৷ ধর্মদেশনার উদ্দেশ্যে যুগে যুগে কত শ্রুতি, স্মৃতি, পুরাণাদি রচিত হয়েছে৷ এই সমস্ত শ্রুতি, স্মৃতি, পুরাণে কত পরস্পর বিরোধী উক্তি রয়েছে৷ প্রত্যেকে দাবী করেছে আমার মতটাই খাঁটি, অধিকতর যুক্তিসম্মত ও সমর্থনযোগ্য৷ কারণ, আমি যা ৰলছি তা স্বয়ং ঈশ্বরের বাণী, ঈশ্বরের নির্দেশ৷ এখন প্রশ্ণ হলো সবই যদি স্বয়ং পরমপুরুষের নির্দেশ হয় তাহলে তাদের মধ্যে এত মত পার্থক্য কেন? তা তো হওয়া উচিত নয় সকল মানুষের মনের মধ্যে যে মৌল ধর্মবিশ্বাস যা মৌল ধর্মীয় মনস্তত্ব, সেখানে তো কোন পার্থক্য দেখি না৷ জৈবধর্ম, সনাতন মানব ধর্ম বা ভাগবৎ ধর্মের ক্ষেত্রেই আমরা তো কোন প্রকার পরস্পর বৈপরীত্য দেখি না৷ কারণ এ সবই বিশ্বমানবের সার জিনিস---মনস্তত্ত্বসঞ্জাত৷

এখন আধ্যাত্মিক ৰাধার বিরুদ্ধে সার্থক সংগ্রামের জন্যে প্রয়োজন বিশ্বমানবের মধ্যে ভাগবৎ ধর্মের প্রতিষ্ঠা৷ তবেই দুরতিক্রম্য আধ্যাত্মিক ৰাধার গণ্ডী পেরিয়ে মানুষ পরম মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারৰে৷ এই প্রসঙ্গে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উক্তি হলো---

‘‘মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তিতে’’

‘‘যে মানুষ আমার ভজনা করে তার পক্ষে এই দুস্তর ৰাধা অতিক্রম করা সম্ভব’’ এই যে আধ্যাত্মিক ৰাধা যা মানুষের চলার পথে ৰড় ৰাধা, যার জন্যে মানুষ মনুষ্যত্ব খুইয়ে পশুত্বে পর্যবসিত হয়---এর চেয়ে দুঃখের কথা আর কী হতে পারে৷ তবুও এই ৰাধার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা ও সংগ্রামে জয়ী হওয়া আর তার দ্বারা মানবতার মুক্তি ঘটানো---এ সবই সহজ হয়ে উঠে যদি মানুষ পরমপুরুষের আশ্রয়ে চলে আসে৷ এই যে ৰাধা, এই ৰাধার স্রষ্টা কে?--- না, পরমাত্মার এক বিশেষ শক্তি যার অপর নাম মায়া৷ এই যে মায়া বা শক্তি ইনি কার শক্তি?- না ‘‘শক্তি সা শিবস্য শক্তিঃ’’---পরমপুরুষের শক্তি৷ এখন মানুষ যদি এই মায়াসৃষ্ট ৰাধা অতিক্রম করতে যায় তাহলে মায়ার অধীশ্বর পরমপুরুষের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ নেই৷          (শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের অভিমত-৫ম খণ্ড থেকে সংগৃহীত)