রাঢ়ের সভ্যতা

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

মানুষের উদ্ভব পৃথিবীতে কয়েকটি বিশেষ বিশেষ বিন্দুতে হয়েছিল৷ কে আগে আর কে পরে–এই নিয়ে বিশদ আলোচনা না করেও বলতে পারি, রাঢ়ভূমিতে মানুষের উদ্ভব অতি প্রাচীন৷ এর চেয়ে প্রাচীনতর মনুষ্য–নিবাসের কোন সন্ধান পাওয়া যায় না৷ পৃথিবীতে যখন অরণ্য এল রাঢ়ের এই কঠিন শিলা, বিবর্তিত শিলা, আগ্ণেয় শিলা ও পাললিক শিলার ওপরে জন্ম নিল নিবিড় অরণ্য৷ সেই অরণ্যই একদিন মানুষ–জনপদ রাঢ়কে প্রাণ–সুধা জুগিয়েছিল, এই অরণ্যই রাঢ়ের নদীগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করত৷ ওই অরণ্যই বরফ–ঢাকা পাহাড়গুলি ক্ষয়ে যাবার পরে আকাশের মেঘকে ডেকে আনত রাঢ়ভূমিতে৷ রাঢ়ভূমিতে পর্জন্যদেবের কৃপাবর্ষণ হ’ত অফুরন্ত, অঢেল৷ এই আমাদের রাঢ়ভূমি–অনেক সৃষ্টি–স্থিতি–লয়ের জীবন্ত দর্শক, অনেক বিবর্তনের নির্বাক সাক্ষী৷

রাঢ়ের অরণ্যে অগুনতি আরণ্য জীব৷ মানুষ যখন এল রাঢ়ের মাটিতে, তখন রাঢ়ের বক্ষ থেকে হিমযুগ অপসৃত হয়েছে৷ বৃহৎ জীব–জন্তুরা ক্রমশঃ ক্ষুদ্রাকৃতি হয়ে যাচ্ছে৷ বরফে জমে ম্যামথ (ঐরাবত) শিলীভূত (fossilised) হয়ে গেছে কিন্তু রয়েছে তার বংশধর হাতি৷ বিরাট  ডাইনোসর, ব্রণ্টাসোর, কক্টেসিয়াসদের যুগ শেষ হয়ে গেছে, তার বদলে এসেছে অন্য ধরনের বড় বড় জীব৷ রাঢ়ের সেই আরণ্য মানুষ, সেই পাতা–পরা, গাছের বাকল–পরা, জানোয়ারের চামড়া–পরা মানুষ অরণ্যে শিকার করত৷ সেই মানুষকে আজকের মানুষ অবহেলার সঙ্গে ভাবতে পারে কিন্তু সেই মানুষ ছিল সরলতার প্রতিভূ–রাঢ়ের তরঙ্গায়িত মৃত্তিকার, রাঢ়ের বজ্র–নির্ঘোষের প্রতিভূ ছিল সেকালের সেই অনগ্রসর মানুষ যারা আজকের মানুষের প্রণম্য পূর্বসূরী, যাদের চরণধূলি মাথায় নিয়ে আজ আমরা পথ চলছি৷

পরবর্তীকালে সেই মানুষেরা পশুচারণ শিখলে, ধীরে ধীরে অল্প–স্বল্প চাষবাসও শিখলে৷ রাঢ়ের ফাগুন মাসের আগুন–ধরা পলাশের বন তাদের মনেও রঙের নাচন লাগিয়ে দিলে৷ আত্মপ্রকাশের উত্তাপ তাদের প্রাণকেও নাড়া দিলে৷ সে আজ অনেক হাজার বছর আগেকার কথা৷ তারা নিশ্চয় তপস্যা করেছিল৷ কিন্তু তারা কীসের তপস্যা করেছিল? কীভাবে তপস্যা করেছিল? কে তাদের তপস্যা করতে শিখিয়েছিল? তাদের অন্তরের প্রাণপুরুষ, তাদের জীবন–দেবতাই তাদের শিখিয়েছিল৷ –খোঁজ, খোঁজ, একজন কেউ আছেন–একজন কেউ আসছেন–একজন কেউ তোদের চলার পথের পাথেয় জুগিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছানোর নিশানা জুগিয়ে দেবেন৷ এই ছিল তাদের না–না–জানা নীরব তপস্যা৷ ভারতে তখন আর্যরা আসছে, কিছু এসেছে, কিছু মধ্য–এশিয়ার ঊষর প্রান্তর থেকে আসব আসব করছে, এমন সময় জন্মেছিলেন সেই বিরাট প্রাণপুরুষ সদাশিব৷ তাঁরই অমর বাণীর, তাঁরই অভ্রান্ত নির্দেশনার সংস্পর্শে এসে রাঢ়ের মানুষ তাদের অভীষ্টের জীয়নকাঠি পেয়ে গেল৷ রাঢ় হ’ল সভ্যতার আদি বিন্দু৷

রাঢ় শুধু সভ্যতারই আদি বিন্দু নয়, সাংস্কৃতিক অগ্রগতিরও প্রথম পদবিক্ষেপ এই রাঢ়৷ ছোট বড় নদীর বিভিন্ন অববাহিকার পারস্পরিক মিলনে–মিশ্রণে কর্মৈষণা ও ভাবাদর্শের বিনিময়ে গড়ে উঠল রাঢ়ের সভ্যতা, রাঢ়ের সংসৃক্তি যা কেবল রাঢ়েই নয়, যার ঔজ্জ্বল্য সেই অন্ধকার যুগের অনগ্রসর মানুষের জীবনে একটা সোণালী প্রভাত৷ নানান্ দেশের মানুষ তখন ছুটে এল রাঢ়ে মানবতার পাঞ্চজন্য শুণতে, মানবতার মহান প্রশস্তি উদগীত করতে৷ চীন এই ভূমিকে নাম দিয়েছে ন্ত্রব্ধ বা লাতি, গ্রীস নাম দিয়েছিল গঙ্গা–রিডি (Ganga Ridi), আর্যরা নাম দিয়েছিল ‘রাট্ঠ’৷ এই রাঢ়ের সভ্যতা–সংসৃক্তি রাঢ়েই সীমিত থাকল না–থাকা সম্ভবও ছিল না, উচিতও ছিল না৷ সমুদ্রপথে সে তার তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে অর্ণবপোতে ছুটে গেল নাম–না–জানা নাম–না–শোণা সুদূর বন্ধুর আহ্বানে৷*(‘‘সভ্যতার আদিবিন্দু রাঢ়’’ থেকে গৃহীত৷–সম্পাদক৷)

গঙ্গা–রিডি ঃ প্রাচীন গ্রীক ভাষায় যদিও ‘রিড্’ শব্দের অর্থ রাষ্ট্র কিন্তু ‘গঙ্গা–রিডি’ এই গ্রীক শব্দটি এসেছে ‘গঙ্গা–রাঢ়’ শব্দ থেকে যার মানে হচ্ছে গঙ্গাস্পর্শী রাঢ় ভূমি৷ আলেকজাণ্ডার (সিকান্দার শাহ্) যখন ভারত আক্রমণ করেন তখন তিনি রাঢ়ী বাঙালীর শৌর্যের প্রশংসা শুণেছিলেন৷ সেই উপলক্ষ্যেই গ্রীক ভাষায় প্রথম ‘গঙ্গারিডি’ শব্দটি প্রবেশ করে৷ আমরা গঙ্গা–রিডির পরিবর্ত্তে ‘গঙ্গা–রাঢ়’ শব্দটি অনায়াসেই ব্যবহার করতে পারি৷

গণ্ডোয়ানাভূমি

ভূতাত্ত্বিকদের অনুমান এককালে উত্তরভারত, হিমালয় প্রভৃতি অঞ্চল ছিল না৷ দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে একদিকে আফ্রিকা, অন্যদিকে আন্দামান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া হয়ে অষ্ট্রেলিয়া পর্যন্ত এক সুবিস্তীর্ণ ভূ–ভাগ ছিল৷ এই ভূমিখণ্ডের মধ্যভাগে বসবাসকারী ‘গোণ্ড’ জনজাতি থেকে এই প্রাচীন দেশটির নাম রাখা হয়েছিল ‘গণ্ডোয়ানা’৷ এই গণ্ডোয়ানার পশ্চিম প্রত্যন্তে বসবাসকারীরা ছিলেন নিগ্রো বর্গীয়, পূর্ব প্রত্যন্তে বসবাসকারীরা ছিলেন অষ্ট্রিক বর্গীয় ও মধ্যভাগে অর্থাৎ কিনা ভারতের দক্ষিণ অংশে বসবাসকারীরা ছিলেন অষ্ট্রিকো–নিগ্রোয়েড বা দ্রাবিড় গোষ্ঠীভুক্ত৷ মধ্য ভারতের গোণ্ড কমিউনিটি এখনও আছে৷ গোণ্ড বর্গভুক্ত সাধারণ মানুষের পরিচয় সাধারণতঃ ধুরবাগোঁড়৷ রাঁচীর নিকট ধুর্বা নামক স্থানটি স্মর্তব্য৷ রাজপরিবারভুক্ত মানুষেরা ‘রাজগোঁড়’ নামে পরিচিত৷ পরবর্তীকালে এঁরা ‘রাজগোঁড়’ বা ‘ধূরবাগোঁড়’ পদবী ত্যাগ করে রাজপুত বা ঠাকুর গোষ্ঠীভুক্ত হয়ে যায়৷

 

উৎস

*(‘‘বর্ণবিচিত্রা’’ থেকে গৃহীত৷ –সম্পাদক৷)