রাজনীতি–সচেতন মধ্যবিত্ত, ছাত্র–যুব ও সাধারণ মানুষই বিপ্লব আনবে

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

আজ জীবনের সকল ক্ষেত্রেই নীতিহীনতার এক কালো ছায়া দ্রুত ঘনিয়ে আসছে ও তা মানুষের প্রগতির পথে দারুণ অন্তরায় সৃষ্টি করে চলেছে৷ নীতিহীনতার এই আবর্জনা ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করতে চাই প্রচণ্ড শক্তিশালী নৈতিক বল৷ এই দুর্দান্ত নৈতিক বল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোন সরকারের কাছ থেকে আশা করা যায় না৷ এটা আমরা আশা করতে পারি অরাজনৈতিক পক্ষ থেকে৷ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত কোন দল বা নেতাদের খামখেয়ালী কাজকর্মকে বাধা দেওয়ার মতো নৈতিক বলের যদি সমাজে অভাব দেখা দেয়, তাহলে যে কোন সরকার–তা সে ফ্যাসীবাদী, সাম্রাজ্যবাদী, সাধারণতন্ত্রী, একনায়কতন্ত্রী, আমলাতান্ত্রিক বা গণতান্ত্রিক, যাই হোক না কেন–সে সরকার অত্যাচারী হতে বাধ্য৷ সরকারের নীতিহীন কাজকর্মের ফলেই গণ–ভ্যুত্থানের জন্ম হয়৷ উন্নত মেধাসম্পন্ন মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়, অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্যে যারা উত্তেজনায় ফুটতে থাকে, এরাই অপশাসনের বিরুদ্ধে গণ–ভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয় ও শেষ পর্যন্ত সমাজের এই রাজনৈতিক সচেতন অংশই শাসক–শক্তির পরিবর্ত্তন ঘটায়৷ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে সব মধ্যবিত্ত মানুষ সরকারী প্রশাসনের অংশ হিসেবে কাজ করে তাদের পক্ষে সক্রিয় প্রতিবাদের আওয়াজ তোলা খুবই অসুবিধাজনক৷ তারা নিঃশব্দে দুর্ভোগ ভুগতে থাকে৷ তাদের এই কষ্টের কোন স্বীকৃতিও মেলে না৷ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার এইটাই সবচেয়ে বড় ত্রুটি৷

মানব–সভ্যতার ইতিবৃত্ত এ কথাই বলে যে যদি কোন সরকার মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের সামূহিক স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়, সেক্ষেত্রে এই সরকারের পতন হবেই৷ শিক্ষায় অনগ্রসর কোন রাষ্ট্রে যেখানে জনসাধারণ রাজনৈতিক সচেতন নয়, সেখানে পূর্ণ বয়স্কের ভোটাধিকারের ব্যবস্থা সরকারী প্রশাসন যন্ত্রকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে দেয়৷ কপট নেতারা রাজনীতি–সচেতন মধ্যবিত্ত সমাজের ভোট হাতাতে পারে না বা মিথ্যা প্রতিশ্রুতির বাগ্জাল রচনা করে’ এদের বোকা বানাতে পারে না৷ এই অবস্থায় সরকার মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের স্বার্থের বিরুদ্ধে যেতে থাকে৷ দুর্নীতিপরায়ণ নেতারা অনুন্নত শ্রেণীর মানুষের ভোট কেনার জন্যে নানান্ ধূর্তামির পথ নেয়৷ যে নেতা যত ধূর্ত হয় এক্ষেত্রে সে ততই সফল হয়৷ সুতরাং রাজনৈতিক নেতাদের দুর্নীতি রোধ করতে প্রয়োজন রাজনৈতিক সচেতনতা ভাল হয়, রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিতদের নিয়ে একটি সংস্থা গড়ে তোলা৷

পৃথিবী দ্রুত এগিয়ে চলেছে, আর প্রতি ক্ষেত্রেই এরূপ একটা সংস্থার প্রয়োজনীয়তা খুবই অনুভূত হচ্ছে৷ তথাকথিত রাজনৈতিক  শিক্ষায় শিক্ষিত গোষ্ঠীর একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হ’ল যুবগোষ্ঠী৷ ছাত্রগোষ্ঠীও এর একটা বিশিষ্ট অংশ৷ রাজনৈতিক ব্যবস্থার ত্রুটি শিক্ষা ব্যবস্থায় অবনতি ঘটায় আর এর ফলে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়৷ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অর্থনৈতিক দায়দায়িত্ব সরকারের ওপর ন্যস্ত থাকায় সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে দুর্ভাগ্যজনক ভাবে অনুগত ভৃত্যে পরিণত করে৷ প্রাউটিষ্ট সংঘটন গড়ে তোলার মূল উদ্দেশ্য হ’ল, ব্যষ্টিগত ও সামূহিক জীবনে নীতিহীন কাজকর্মের বিরুদ্ধে একটি নৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা৷

আজকাল রাজনীতিকরা তাদের নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যে শিক্ষার্থীদের বিপথগামী করছে৷ ছাত্রদের কোন কোন অংশ এদের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে৷ এই সকল ছাত্র তাদের নিজেদের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলেছে, ও তাই এদের পক্ষে নৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব নয়৷ তোমরা প্রাউটিষ্টরা যম–নিয়মের নীতিগুলি মেনে কঠোরভাবে অরাজনৈতিক সংস্থা হিসেবে কাজ করে যাও৷

যারা খাঁটি জীবন দর্শন ও যম নিয়মে প্রতিষ্ঠিত, যথার্থ আধ্যাত্মিক সাধনার পথ পেয়েছে, তারাই আগামী দিনে সমাজের নেতৃত্ব দেবে৷ সচেতন মানুষের কর্তব্য রাজনৈতিক ভণ্ডদের হাত থেকে ভৌতিক ক্ষমতা ও বৌদ্ধিক নেতৃত্ব কেড়ে নেওয়া৷ এই সব রাজনৈতিক নেতারা সব সময় কেবলমাত্র কাদা ছোঁড়াছুড়িতে মত্ত৷ তাই তারা সমাজের কোনই কাজে আসবে না৷ যদি সদ্বিপ্ররা জনগণের সক্রিয় সাহায্য পায়, তাহলে বিপ্লব আসতে বাধ্য৷ যদি কোন সরকার প্রাউটের আদর্শ গ্রহণ করে, সেখানে সদ্বিপ্রের শাসন কায়েম হবে৷ যদি এই আদর্শ কোন সরকার গ্রহণ না করে, তবে রক্তাক্ত বিপ্লব অবশ্যম্ভাবী৷ আর শেষ পর্যন্ত শাসনক্ষমতা সদ্বিপ্রের হাতেই যাবে৷

রাজনীতিকদের মতলব কেবলমাত্র ক্ষমতা দখল করা৷ তাই মানুষকে রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা দরকার, তাহলে রাজনীতিবিদ্রা আর এদের ঠকাতে পারবে না৷ একটা সময় অবশ্যই আসবে, তখন এদের সব রকম লোক–ঠকানো কৌশল জনগণের মনে আর কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে না৷ সেদিন এই জনগণই ওদের সমাজসেবার মুখোস খুলে দেবে৷ বর্তমানে সাধারণ মানুষ রাজনীতি–সচেতন নয়, তাই তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা এদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে শোষণ করছে৷ প্রাউটিষ্টদের কর্তব্য হ’ল এইসব তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের চ্যালেঞ্জ করা৷

বিশ্ব সেনা–দল (ওয়ার্ল্ড মিলিশিয়া) থাকবে৷ কিন্তু সেনাদলে সৈন্যসংখ্যা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনতে হবে৷ বিশ্ব–রাষ্ট্র তৈরী হবার পরেও বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সংঘর্ষ বা কোন দেশের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে না৷ কারণ বিদ্যা–বিদ্যার সংঘর্ষের ফলেই তো এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি৷ সুতরাং পুলিশ–মিলিটারীর প্রয়োজন চিরদিনই থাকবে৷

(২০ অক্টোবর, ১৯৫৯, জামালপুর)