রাজনীতি সেবা না চাকরি

লেখক
শ্রীসুভাষ প্রকাশ পাল

দিন কয়েক আগে ফেসবুকের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে একটা বিষয় নজরে এল৷ বয়স্ক লোকেদের আড্ডার আসরে এক ব্যক্তি আমজনতার উদ্দেশ্যে একটা প্রশ্ণ ছুঁড়ে দিয়েছেন৷ বলেছেন--- রাজনীতি সেবা না চাকরি? যদি সেবা হয় তাহলে বেতন, পেনশন কেন? আর যদি চাকরি হয় তাহলে পরীক্ষা বা শিক্ষা-দীক্ষা নেই কেন? তবে সত্যি কথা বলতে---এটা অনেকেরই মনের কথা, অনেকে মুখ ফুটে কথাটা বলতে পারেন নি৷ আর উনি সাহস করে সবার বিবেকের কাছে প্রশ্ণটি উত্থাপিত করেছেন, রবিঠাকুরের কথায় বলতে হয়---‘মন্ত্রী কহে---আমারো ছিল মনে কেমনে বেটা পেরেছে সেটা জানতে,

কিছুদিন আগেও দেখতে পেতাম--- সমাজে কিছু মানুষ সেবার ভাবনা নিয়ে, অপরের কল্যাণ হবে ভেবে দেশসেবার কাজে আত্মনিয়োগ করতেন৷ এতে বিনিময়ে কিছু পাওয়ার আশা থাকত না৷ অপরের মুখে হাসি ফুটেছে দেখেই তাঁরা তৃপ্তি লাভ করতেন৷ স্বাধীনতা সংগ্রামে যাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তাঁরা পরে আখের গোছাতে পারবেন বা পেনশন পাবেন এই ভেবে সেই কাজে প্রবৃত্ত হননি৷ তাঁরা কর্ত্তব্যের খাতিরে, ঔচিত্য বোধে দেশমাতার প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসার প্রেরণাতেই নিজেদের সুখস্বাচ্ছন্দ বিসর্জন দিয়ে উক্ত কর্মে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন৷ ক্ষণেকের জন্যেও নিজ স্বার্থের কথা ভাবেন নি, কিন্তু বর্তমানে যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানসিকতারও অনেক পরিবর্তন হয়েছে৷

রাজনীতি কথাটির দুরকম অর্থ হতে পারে৷ এক রাজার নীতি, রাজনীতি, পূর্বে অধিকাংশ দেশে রাজতন্ত্রের প্রচলন ছিল, রাজা বা রানী যদি প্রজানুরঞ্জক হতেন, প্রজাদের সুখ-সুবিধার কথা বেশী করে ভাবতেন, তখন প্রজারাও সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারতেন আর রাজা যদি স্বৈরাচারী হতেন, বিলাস-ব্যাসনে মত্ত থাকতেন, তখন প্রজাদের দুঃখকষ্টের সীমা থাকত না, এখন সারা পৃথিবীতে রাজতন্ত্র নেই বললেই চলে৷ বর্তমানে কোথাও সমাজতন্ত্র কোথাও গণতন্ত্র, কোথাও বা গণতন্ত্রের নামে একনায়কতন্ত্র৷

এখন রাজনীতি বলতে বোঝায়---নীতির রাজা রাজনীতি৷ অর্থাৎ যে নীতির মাধ্যমে যে অনুশাসনের বা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে স্বল্প সময়ে অধিক সংখ্যক মানুষের কল্যাণ করা যায় তাই রাজনীতি এই রাজনীতির যাঁরা ধারক ও বাহক হবেন তাঁদেরকে অবশ্যই নীতিবাদী হতে হবে শিক্ষিত ও উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতে হবে৷ সেবার মনোভাবে উদ্বুদ্ধ হতে হবে, সেবা জিনিসটা হবে একতরফা৷ অপরকে দেব, কিন্তু ফিরে পাওয়ার কোন আশা থাকবে না৷ মানুষের সেবা করব, বিনিময়ে নিজের পরিবারের বা আত্মীয় স্বজনের চাকরি-বাকরি বাগিয়ে নেব, বিপুল সম্পদের অধিকারী হব---এটাকে সেবা বলে না৷ কিন্তু বর্তমান সমাজে সেটাই হয়ে চলেছে৷ রাজনীতির অঙ্গনে স্বার্থপর, ধান্দাবাজ, বাহুবলী, কূটকৌশলী ব্যক্তিদেরই দাপাদাপি চলছে৷ সৎব্যষ্টিদের সেখানে কোন স্থান নেই বললেই চলে৷ সৎ মানুষেরা এখন কোনঠাসা৷

আমাদের দেশের যদি সত্যিই মঙ্গল করতে হয়, তবে রাজনীতির অঙ্গনে সৎ মানুষদের নিয়ে আসতেই হবে৷ কি করলে বা কোন আদর্শ (ism) গ্রহণ করলে তা সম্ভব হবে সমাজতাত্ত্বিকরা তা নিশ্চই ভাবছেন৷ দুর্ভাগ্যের বিষয় আমাদের দেশের কর্ণধাররাও রাজনীতিতে যাতে স্বার্থপর ধান্দাবাজ লোকেদের রাজত্ব চলতে থাকে সে ব্যাপারে পরোক্ষে উৎসাহ দিয়ে চলেছেন, ২০/২৫ বছর যাতে করলে আগে পেনশন পাওয়া যেত৷ বর্তমানে কমপক্ষে ১০ বছর কাজ করলে তবে পেনশন পাওয়া যায়৷ কিন্তু রাজনীতি যদি সেবা হয় তবে সেখানে বেতন বা পেনসনের কোনও সুযোগ থাকাই উচিত নয়৷ অপরপক্ষে আমাদের দেশে পাঁচবছর এম.এল.এ বা এম.পি থাকলেই সারাজীবনের জন্য পেনশন পাওয়া যাচ্ছে৷ ফলে লোভী, দুর্নীতিপরায়ন, ধান্দাবাজ ব্যষ্টিরা রাজনীতিকে জীবিকা হিসেবেই ভাবতে শুরু করেছেন, এজন্যই নির্বাচনে একটা টিকিট পাওয়ার জন্য এত লড়াই শুরু হয়েছে৷ যতদিন রাজনীতিতে অযোগ্য ব্যক্তিদের অর্থ ও সামাজিক প্রতিষ্ঠা-প্রাপ্তির হাতছানি থাকবে ততদিন রাজনীতির অঙ্গনে তথা সমাজজীবনে মারামারি, হানাহানি, কাটাকাটি চলতেই থাকবে৷ তবে একটা কথা ভাববার বিষয় যে সমস্ত সৎ ব্যক্তি রাজনীতিতে (সমাজ সেবায়) আসবেন তাদের আর্থিক অবস্থা যদি স্বচ্ছল না হয়, তবে রাষ্ট্রকে তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে হবে, কেননা খালি পেটে ধর্ম হয় না৷

পরিশেষে বলব--- সমাজ সেবায় সৎ ব্যষ্টিরা এগিয়ে আসুন, সেই সৎব্যষ্টিদের ঈশ্বরকেন্দ্রিক দর্শনে বিশ্বাসী হতেই হবে৷ অর্থাৎ আমাদের সবার মাথার উপরে একজন নিয়ন্তা আছেন৷ তাঁকে কেউ বলে ঈশ্বর, কেউ বলে আল্লা, কেউ বলে খৃষ্ট ইত্যাদি, তিনি সবার সৃষ্টিকর্তা পরমপিতা, আমরা সবাই তাঁর সন্তান-সন্ততি৷ জীবের সেবাই শিবের সেবা, জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর, ঈশ্বরের সন্তানদের সেবা করলে পরমপুরুষ তুষ্ট হবেন--- এই ভাবনা নিয়ে আমাদের যাবতীয় সেবাকার্য করে যেতে হবে৷ এতে নিজেরও কল্যাণ, দেশেরও মঙ্গল, এছাড়া অন্য কোন পথ নেই৷ নান্যঃ পন্থাঃ বিদ্যতে অয়নায়৷