পুঁজিবাদ প্রভাবিত আজকের ভোগবাদী সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ছেয়ে গেছে৷ ধনলোলুপ বৈশ্যরা বুদ্ধিজীবিদের বৌদ্ধিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রয়োগে যেমন শোষণকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে৷ ঠিক তেমনি সর্বাত্মক জীবনাদর্শের অভাবে রাজনীতি ও প্রশাসনের দুর্নীতিকরণ হতে হতে আজ দুর্নীতিবাজদের রাজনীতিকরণ হয়ে গেছে৷ রাজনীতিতে এখন ধান্ধাবাজ দুর্নীতিগ্রস্তদেরই রমরমা৷ রাজনীতির প্রকৃত অর্থ শ্রেষ্ঠনীতি, রাজনীতির লক্ষ্য জনগণের কল্যাণ৷ তাই যারা রাজনীতির চউকাঠে পা রাখবেন তাদের আধ্যাত্মিক নীতিবাদী হতেই হবে৷ তবেই তারা জনগণের প্রকৃত সেবক হতে পারবেন৷ কিন্তু বর্তমানে রাজনীতি আর দুর্নীতি কথা দুটি প্রায় সমার্থক হয়ে গেছে৷ এখন তাই রাজনৈতিক ক্ষমতাধরদের দুর্নীতিবাজ হয়ে ওঠা দেখতে দেখতে জনগণের গা সওয়া হয়ে গেছে৷ কথায় বলে যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ৷ রাজনৈতিক দল, প্রশাসন থেকে সমাজের সর্বস্তর আজ অসৎ, নীতিহীন দুর্নীতিপরায়ণ লোকে ছেয়ে গেছে৷ এদের ভীড়ে মুষ্টিমেয় কিছু সৎ নীতিবাদী মানুষ আজ কোনঠাসা৷ রাজনৈতিক দল, অফিস-আদালত, শিক্ষা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র সর্বত্রই সৎনীতিবাদী মানুষেরা দুর্নীতিবাজদের দাপটে টিম টিম করে তথাকথিত প্রদীপের মতো জ্বলছে৷ ক্ষমতার বৃত্তের বাইরে থাকা বিরোধী দলের তৃণমূলস্তর থেকে পার্টির পদাধিকারীরা রাজনৈতিক পালাবদলের ফলে ক্ষমতায় এসে ভুলে গেছে দলের রাজনৈতিক মূল্যবোধ৷
জন সাধারণকে ঠকিয়ে রাতারাতি বড়লোক হবার লোভে ক্ষমতার চিটেগুড়ে আটকে গেছে তাদের সব ন্যায় নীতি সততা প্রভৃতি৷ এইসব দুর্নীতিবাজরা রাজনৈতিক ক্ষমতা কে জনগণের কল্যাণের কাজে না লাগিয়ে তার দুরোপযোগ করে৷ তারা লাগামছাড়া লোভের বশবর্ত্তী হয়ে কর্মপ্রার্থী বেকার যুবক-যুবতীদের অসহায় অবস্থার সুযোগে তাদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে অনৈতিকভাবে চাকুরী বিক্রি করেছে৷ এইভাবে তারা দেশে বিদেশে কোটি কোটি কালো টাকা জমিয়েছে৷ বিলাসবহুল প্রাসাদোপম বাড়ী, ফ্ল্যাট, বাগানবাড়ী, রিসর্ট ও হোটেল ইত্যাদি নামে বেনামে করেছে৷ উঠতি মডেল ও টলিউডের একশ্রেণীর অভিনেত্রীদের নিয়ে রঙীন স্ফূর্তির জোয়ারে গা ভাসাচ্ছে এইসব রংবাজ দুর্নীতিগ্রস্তরা৷ এইভাবে পঞ্চায়েত থেকে ক্ষমতার শীর্ষবৃত্তে থাকা দুর্নীতিবাজরা মিলে গড়ে তুলেছে দুর্নীতির সিন্ডিকেট৷ কিন্তু কথায় আছে লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু৷ পাপ বাপকেও ছাড়ে না৷ বর্তমানে সমাজে দুর্নীতির শিকড় এতটাই গভীরে যে ঠগ বাজতে গাঁ উজাড় হবার মতো অবস্থা৷ এমতাবস্থায় শাসকদল পাঁকে পড়েছে ভেবে নিয়ে ডান, বাম, রাম প্রভৃতি দলগুলির আনন্দে উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করার কোন সঙ্গত কারণ নেই৷ কারণ তারা কেউই ধোয়া তুলসীপাতা নয়৷ তারা আয়নায় একবার দুর্নীতি ও হিংসার আগুনে ইন্ধন দেওয়া নিজেদের জান্তব পাশবিক মুখগুলো দেখুক৷ তাদের অতীত ও বর্তমানের কীর্ত্তির(?) কথা লিখে শেষ করে যাবে না৷ বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের ৩৪ বছরের বাম সরকারের দুর্নীতি, হিংসা, পৈশাচিকতার ইতিহাস লিখতে গেলে আর একটা মহাভারত হবে৷ তবে এটা হবে দুর্নীতি, হিংসা, পৈশাচিকতা ও পাশবিকতার মহাভারত৷
আসল কথা হল বর্তমান সমাজে ভোগবাদের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে মানুষের ন্যায়, নীতি, সততা ও মানবিক মূল্যবোধ ভোগসর্বস্ব জীবনচর্যায় অভ্যস্ত মানুষের মধ্যে দেখা দিচ্ছে সীমাহীন লোভ, লালসা, হিংসা, নিষ্ঠুরতা, পাশবিকতা, ভ্রষ্টাচার, ব্যভিচার প্রভৃতি অবগুনগুলির৷ এগুলোকে আজকাল অনেক মানুষই আর পাপ বা অন্যায় বলে মনে করে না৷ শাসকদলের কিছু দুর্নীতিবাজদের দুর্নীতির খবর প্রকাশ্যে আসতেই বিরোধী দলগুলো বিশেষত বামেরা গলার শিরা ফুলিয়ে রাজ্যের শাসকদল ও সরকার বিরোধী স্লোগান ও ভাষণ দিয়ে গলা ফাটাচ্ছে৷ পিছনে ফিরে অতীতের স্মৃতির পাতায় তাদের কুকীর্ত্তি সম্বন্ধে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক৷
বিশ শতকের আশির দশকে পশ্চিমবঙ্গের বাম জমানায় বেঙ্গল ল্যাম্প কেলেঙ্কারীর কথা আশা করি প্রবীন পাঠকদের মনে আছে৷ তখন এই কেলেঙ্কারী রাজ্য জুড়ে বিতর্কের ঝড় তুলে ছিল৷ জ্যোতি বসু তখন দোর্দণ্ডপ্রতাপ মুখ্যমন্ত্রী৷ তার কীর্তিমান (?) পুত্র চন্দন বসু তখন মুখ্যমন্ত্রী পিতা (অন্ধ ধৃতরাষ্ট)-র প্রশয়ে ক্ষমতার অলিন্দ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন৷ যেমন একদা অবিসংবাদী ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছিল ইন্দিরা কংগ্রেস জমানায় কেন্দ্রীয় সরকারে ইন্দিরা পুত্র সঞ্জয় গান্ধী৷ সর্বহারার পার্টী মার্কসবাদী নেতার ধনকুবের পুত্র চন্দন বসু বেঙ্গল ল্যাম্প কোম্পানীকে অর্ডার পাইয়ে দিতে তৎকালীন পুর্তমন্ত্রী আর.এস.পি.নেতা যতীন চক্রবর্তীকে সরাসরি সুপারিশ করেছিলেন৷ সেই সুপারিশ পত্রটি মিডিয়ায় ফাঁস হয়ে যাবার ফলে রাজ্য রাজনীতিতে আলোড়ন শুরু হয়৷ জ্যোতি বসুর ভাবমূর্ত্তি খারাপ হচ্ছে দেখে তখন সিপি.এম আর.এস.পির রাজ্য সম্পাদক মাখন পালকে দিয়ে যতীন চক্রবর্তীর ওপর চাপ সৃষ্টি করে যাতে তিনি প্রকাশ্যে বলেন যে খবরটা মিথ্যা৷ কিন্তু যতীন চক্রবর্তী ছিলেন নিজ সিদ্ধান্তে অনড়৷ রাজা ও রাজপুত্রের ল্যাজে পা পড়ার ফলে তাদের রোষে পড়ে আর.এস.পি. নেতা যতীন চক্রবর্তীকে মন্ত্রীত্ব খোয়াতে হয়৷ যতীন চক্রবর্ত্তীকে শেষে দল থেকেও বহিস্কৃত হতে হয়৷ শুধু কি তাই, ত্রিপুরার তৎকালীন বামফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী নৃপেন চক্রবর্তী চন্দনের কোটিপতি হয়ে ওঠা নিয়ে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে পলিটব্যুরো অবধি প্রশ্ণ তুলেছিলেন৷ সেই অপরাধে কেন্দ্রীয় কমিটি ও পলিটব্যুরোর সদস্য হওয়া সত্ত্বেও সিপিএম পার্টি থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়৷ শিক্ষা ক্ষেত্রে নিয়োগ দুর্নীতি বাম আমলেও কম হয়নি৷ কিন্তু সিপিএম যেহেতু সংঘটিত পার্টি (অর্গানাইর্জড) তাই তাদের দুর্নীতিটাও হত খুব অর্র্গনাইজড্ভাবে৷ প্রকাশ্যে সেসব কাহিনী কমই আসত৷ আর কেন্দ্রে যেহেতু তাদের বন্ধু কংগ্রেস সরকার ছিল তাই বাম আমলের সরকার থেকে সুবিধাভোগী রাজ্য কংগ্রেস নেতাদের বলা হত তরমুজ৷ অর্থাৎ বাইরে সবুজ কংগ্রেসী হলেও ভিতরে ভিতরে লাল বামপন্থী৷ বাম ও কংগ্রেসের মধ্যে অলিখিত চুক্তি ছিল পশ্চিমবঙ্গের বাম সরকারের দুর্নীতি ও হিংসাত্মক কার্যকলাপের ব্যাপারে তারা অন্ধ ও বধির হয়ে থাকবে বিনিময়ে কংগ্রেস শাসিত কেন্দ্র সরকারকে বামেরা সমর্থন জানাবে৷ এই অলিখিত চুক্তি বামফ্রন্ট সরকারের শেষদিন পর্যন্ত ছিল৷ তাই বাম সরকারের শত শত খুন, ধর্ষন ও দুর্নীতি নিয়ে কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার মুখ খোলেনি কখনও৷ আজকের মোদী সরকার যেমন মমতাকে কোনমতেই বাগে আনতে না পেরে পশ্চিমবঙ্গে সিবিআই ও ইডিকে লেলিয়ে দিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের বাম সরকারের বিরুদ্ধে কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার কখনো সিবিআই ইডি লেলিয়ে দেয়নি৷ বাম সরকারের এইরকম আর একটি কেলেঙ্কারী হল ৩০০ কোটি টাকার লোহার স্ক্র্যাপ কেলেঙ্কারী৷ চীনের বেজিংয়ে অলিম্পিক গেমসের পরিকাঠামো নির্মাণের জন্য পশ্চিমবঙ্গ ৩০০ কোটি টাকার লোহার গুড়ো চীনে সরবরাহের অর্ডার পেয়ে ছিল৷ জাহাজ ভর্ত্তি ৩০০ কোটি লোহার গুঁড়ো আর চীনে পৌঁছাতে পারে নি৷ মাঝদরিয়ায় নাকি সেই জাহাজ ডুবে যায়! এই ঘটনার সত্যতা যাচাইও হয়নি৷ নাম কা ওয়াস্তে সিবিআই তদন্তে কিছু জানা যায়নি৷ আর পশ্চিমবঙ্গে কম্যুনিষ্টদের হাড়হিম করা নৃশংস হত্যার কাহিনী তো অসংখ্য, লিখে শেষ করা যাবে না৷ মরিচঝাপির উদ্বাস্তু গণহত্যা, সাঁইবাড়ী হত্যাকাণ্ড,১৯৮২ সালে বিজনসেতুতে আনন্দমার্গের ১৭জন সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদের নৃশংস হত্যা, ধানতলা,বানতলা, ছোট আঙ্গারিয়া, নন্দীগ্রাম হত্যাকাণ্ড ইত্যাদির ঘটনা উল্লেখযোগ্য৷ তাই বাম জমানার সততার পূজারীদের (!) এরকম অনেক কীর্ত্তি কাহিনী পর্দার অন্তরালে আছে৷ আর রামেদের বর্তমান ডাবল ইঞ্জিন সরকারগুলির দুর্নীতির কথা (পাঠকগণ পত্রপত্রিকার মাধ্যমে নিত্য অবগত হচ্ছেন) লিখে নিবন্ধের কলেবর বৃদ্ধি করতে চাই না৷
বর্তমানে সমস্ত রাজ্য ও দেশের কেন্দ্রীয় সরকারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অজস্র দুর্নীতি৷ কংগ্রেস জমানায় রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে বোফর্স কেলেঙ্কারীর বিরুদ্ধে একসময় বিরোধীদের শ্লোগান ছিল ‘গলি গলি মে শোর হ্যায়, রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়৷’ মনমোহন সিংহের কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে ওঠা কয়লা ব্লকের লিজ সম্পর্কিত ‘কয়লা কেলেঙ্কারী’, মধ্যপ্রদেশের বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষা নিয়োগ সংক্রান্ত কয়েক হাজার কোটি টাকার বিশাল ‘ব্যাপম্ কেলেঙ্কারী’ যা ধামা চাপা দেওয়ার জন্য ৩৬ জন মানুষকে খুন করা হয়েছিল৷ যার কিনারা আজও হয়নি৷ এছাড়া মোদীর ৫৯ হাজার কোটি টাকার রাফাল বিমান ক্রয় সংক্রান্ত ‘রাফাল কেলেঙ্কারী’৷ মোদির বিরুদ্ধে ওটা আদানির আর্থিক প্রতারনা সম্পর্কিত বহু অভিযোগ বিরোধীদের৷ এই ইস্যুতে বিরোধীরা জেপিসি অর্থাৎ যৌথ সংসদীয় কমিটির দাবীতে অনড় থাকায় সংসদে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল৷ ছাপান্ন ইঞ্চি ছাতির ‘না খাউঙ্গা না খানে দুঙ্গা’ শ্লোগান যে নিছকই লোক দেখানো ফাঁকা আওয়াজ যোগীর রাজ্য সহ অন্যান্য ডবল ইঞ্জিন সরকারের হাল হকিকৎ দেখলেই তা বোঝা যায়৷
এখন প্রশ্ণ হল সর্বত্র এই যে পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতি---এর থেকে জনগণ ও সরকার কি করে মুক্ত হবে? পার্টি ও সরকারে কিছু মানুষ অবশ্যই আছেন যারা সৎ, কিন্তু তাদের সংখ্যাটি খুবই নগন্য৷ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কথাই ধরা যাক৷ ব্যষ্টিগত জীবনে তিনি সৎ ও সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত লড়াকু নেত্রী৷ তিনি তো প্রতিটি সভায় দলের নেতা ও কর্মীদের সততার পাঠ দেন--- ‘‘লোভ কোরো না, বিনয়ী হও,’’ ক্ষমতার আস্ফালন দেখাবে না, জনগণের সেবক তোমরা ইত্যাদি ইত্যাদি৷ কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা! এ যেন সেই উলুবনে মুক্ত ছড়ানোর মতো৷ কিছু নেতা কর্মীরা সেগুলো মেনে চলার চেষ্টা করে৷ কিন্তু অধিকাংশই সেগুলো একান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দেয়৷
উপর্যুক্ত দুর্নীতির ঘটনাগুলো সহ সমাজের সর্বত্র আজ হিংসা নৃশংসতা, খুন, ধর্ষন, অসূয়া, ইত্যাদি অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে৷ এ থেকে সমাজকে মুক্ত করার কোন পথ সুশীল সমাজেরও সাধ্যের বাইরে৷ সমাজে ঘটিত উপরের ঘটনাগুলোর কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় প্রধানত দুটো কারণ এই সব সমস্যার মূলে৷ তা হল (১) সর্বাত্মক জীবনাদর্শের অভাব (২) খাঁটী তথা সৎ ও নীতিবাদী আদর্শ মানুষের একান্তই অভাব৷ তাই সমাজকে এই সংকট থেকে মুক্ত করতে হলে আজকের ভোগসর্বস্ব জীবনচর্যাকে সরিয়ে অধ্যাত্মমুখী জীবনচর্যায় অভ্যস্ত হতেই হবে৷ এছাড়া সমাজের সার্বিক অবক্ষয় থেকে পরিত্রাণের অন্যকোন পথ নেই৷ মনে রাখতে হবে মানুষের জীবন ভোগ মুখী হওয়ার ফলেই আজ সমাজের এত সমস্যা৷ বর্তমানে পুঁজিবাদের কুপ্রভাবে ভোগবাদ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে---শহরের অতি আধুনিক শিক্ষিত শহুরে বাবু ও ‘জেনারেশন ওয়াই’ থেকে গ্রামের অর্ধশিক্ষিত অশিক্ষিত সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষদের মধ্যে এমনভাবে সঞ্চারিত হয়েছে যে অধিকাংশ মানুষের জীবনের লক্ষ্যই হচ্ছে কেবল ভোগ---এইসব মানুষের জীবনে উচ্চ আদর্শ না থাকার কারণে জড় জাগতিক ভোগসুখই তাদের জীবনের এক মাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়৷ এই লক্ষ্যপূরণের জন্য তারা যে কোনো উপায়ে অন্যকে ঠকায়, প্রতারনা বা জালিয়াতি করে,ভেজাল জিনিসের ব্যবসা করে, এমনকি টাকার জন্য নিজের প্রিয়জনকে খুন পর্যন্ত করে৷ টাকার জন্য যত নীচে নামতে হয় এরা তা করে৷
প্রতিটি মানুষই সুখ পেতে চায়৷ নাল্পে সুখমস্তি৷ অল্প সুখে কারও মন ভরে না৷ কারণ মানুষ অনন্ত ব্রহ্মের অংশ হিসাবে পৃথিবীতে অনন্ত ক্ষুধা নিয়ে এসেছে৷ সুখ পাবার এষনাতে অনন্ত ক্ষুধাকে নিবৃত্ত করতেই মানুষ, জমি, জায়গা, বাড়ী, গাড়ী, ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স---এসব কিছু করছে৷ এসবের পিছনে কাজ করছে মানুষের সীমাহীন ক্ষুধার লোভ৷ এ থেকে মুক্তি পাওয়ার একটাই উপায়-তা হল সীমিত পার্থিব সম্পদের প্রতি মানুষের এই লোভ তথা অনন্ত ক্ষুধা কে নিবৃত্ত করতে হলে জড়-জাগতিক সীমিত সম্পদের পরিবর্তে তাকে অসীম আধ্যাত্মিক সম্পদ আহরণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে৷ আত্মানুশীলন তথা ঈশ্বর প্রণিধান হল সেই অসীম আধ্যাত্মিক সম্পদে পরিতৃপ্ত হওয়ার কৌশল৷ মানুষ এই কৌশলে রপ্ত হলে ধীরে ধীরে তার বিষয় ভোগবাসনা কমে যাবে৷ মানব জীবনের পরম লক্ষ্য ব্রহ্মসম্প্রাপ্তি---এই লক্ষ্যে মানুষ যত আত্মানুশীলনের পথ ধরে এগিয়ে যাবে তখন তার কাছে ---‘‘পরমপুরুষ আমার পিতা, পরমা প্রকৃতি আমার মাতা, আমি বিশ্বের নাগরিক, আমরা সবাই একই পরমপিতার সন্তান, ভাই-বোন’ ---এই বাক্যগুলি হবে ধ্রুবসত্য৷ তখন এই মহৎ ভাবনায় ভাবিত মানুষ অন্যের ওপর জুলুম করবে না৷ দুর্নীতি ও নিজের ভোগ বাসনায় উদগ্র হয়ে অন্যকে বঞ্চিত করে নিজে সম্পদের পাহাড় রচনা করবে না৷ বরং যৌথ পরিবারের সদস্যদের মতো সকলের সঙ্গে মিলে মিশে তা ভোগ করবে৷ একদা লোভ, লালসা, হিংস্র দুর্নীতিতে আকন্ঠ নিমজ্জিত মানুষ হয়ে উঠবে প্রকৃত অর্থে মানব৷ মানবের মধ্যে পশুভাব দূর হয়ে ধীরে ধীরে জাগ্রত হবে দেব ভাবের৷ তখন সেই মানুষই হবে আদর্শ খাঁটি মানুষ---এরা হবে নব্যমানবতাবাদের পূজারী যম নিয়মে প্রতিষ্ঠিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামী৷ মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার প্রবর্ত্তিত সামাজিক অর্থনৈতিক দর্শন, ‘প্রাউটে’র পরিভাষায় যাদের বলা হয়েছে ‘সদ্বিপ্র’৷ বলা বাহুল্য প্রাউট প্রবক্তা ওপরে আলোচিত দুর্নীতি ও শোষণমুক্ত এক আদর্শ মানব সমাজ গড়ার লক্ষ্যেই দিয়েছেন সর্বাত্মক জীবনাদর্শ৷ যা মানুষের জাগতিক, মানসিক ও আত্মিক ---এই ত্রিস্তরীয় বিকাশ সাধনের মাধ্যমে তাকে এক আদর্শ খাঁটি সৎ মানুষ হিসাবে গড়ে তুলবে৷ আর তাদের দিয়ে সমাজ থেকে দুর্নীতির শিখড় উপড়ে ফেলে সবাই মিলে এক আদর্শ দুর্নীতিমুক্ত ও শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তুলবে৷
- Log in to post comments