আমরা প্রতি বছরের মত এবারেও খুব ঘটা করে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন করেছি৷ রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি, রবীন্দ্র–সঙ্গীত, রবীন্দ্র রচনা নিয়ে গুরুগম্ভীর বত্তৃণতা কোনোটারই খামতি নেই৷ বরং রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলোর্ যেগুলি সুস্পষ্টভাবে ঈশ্বরপ্রেম সম্বন্ধীয় সেগুলিকে বেমালুম স্ত্রী–পুরুষের প্রেমের সঙ্গীত হিসেবে টিভি– সিরিয়্যালে ব্যাপক ভাবে ব্যবহার করে কথায় কথায় রবীন্দ্র প্রীতির নিদর্শন দেওয়া হচ্ছে৷ পাড়ায় পাড়ায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের বন্যা বইছে৷ কিন্তু ওই সঙ্গীতগুলির অন্তর্নিহিত ভাব অনুভব করার চেষ্টা প্রায় কেউই করেন না এটা বলাই বাহুল্য৷ এই ভাবে রবীন্দ্র–ভাব, রবীন্দ্র–আদর্শকে ভুলেই আমরা রবীন্দ্রপ্রীতির উচ্ছ্বাস দেখাচ্ছি৷
আজকের বিপন্ন সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্র ভাবনা যে মানুষকে নূতন দিশা দেখাতে পারে সেটাকেউ কি ভেবে দেখছেন? নিশ্চয়ই না৷ রবীন্দ্রনাথ কেবল কাব্যবিলাসী ছিলেন না৷ তিনি সমাজের দুঃখ, ব্যথা, বেদনা, অত্যাচার, শোষণ এসব সম্পর্কে খুবই সচেতন ছিলেন৷ তাঁর ‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতাতে তিনি তাই সুস্পষ্টভাবে বলেছেন ঃ
‘‘ওরে তুই ওঠ আজি৷
আগুন লেগেছে কোথা কার শঙ্খ উঠিয়াছে বাজি
জাগাতে জগজ্জনে৷ কোথা হতে ধ্বনিছে ক্রন্দনে
শূন্যতল কোন্ অন্ধ কারা মাঝে জর্জর বন্ধনে
অনাথিনী মাগিছে সহায়৷ স্ফীতকায় অপমান
অক্ষমের বক্ষ হতে রক্ত শুষি করিতেছে পান
লক্ষ মুখ দিয়া৷’’
এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ডাক দিয়েছিলেন তিনি তাঁর কবিতায়–
‘‘মুহূর্ত তুলিয়া শির একত্র দাঁড়াও দেখি সবে
আর ভয়ে ভীত তুমি সে অন্যায় ভীরু তোমা চেয়ে
যখনি জাগিবে তুমি তখনি সে পলাইবে ধেয়ে,
যখনি দাঁড়াবে তুমি সম্মুখে তোমার তখনই সে
পথ কুক্কুরের মত সংকোচে সত্রাসে যাবে মিশে৷’’
কবি হূদয়ের গভীরতম প্রদেশ থেকে উপলব্ধি করেছিলেন ঃ
‘‘বড়ো দুঃখ বড়ো ব্যথা–সম্মুখেতে কষ্টের সংসার
বড়ই দরিদ্র, শূন্য, বড়ো ক্ষুদ্র, বদ্ধ, অন্ধকার৷
অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু,
চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ু,
সাহস বিস্তৃত বক্ষপট৷’’
কিন্তু সমাজের এই গভীর সমস্যার সমাধান কোন্ পথে? কবি এই কবিতায় তাঁর নিজের অন্তরাত্মাকেই এই প্রশ্ণ করেছেন৷ আর তার উত্তরেই সত্যদ্রষ্টা কবির অন্তর থেকে বলিষ্ঠ সত্যের বাণী ফুটে বেরিয়ে এসেছে–যে বাণী শাশ্বত সত্যের বাণী৷ এটাই বিশ্বজনের উদ্দেশ্যে সত্যদ্রষ্টা কবির অন্তরের গভীর উপলব্ধি–প্রসূত বাণী ঃ
‘‘বলো, মিথ্যা আপনার সুখ,
মিথ্যা আপনার দুঃখ৷ স্বার্থমগ্ণ যেজন বিমুখ
বৃহৎ জগৎ হতে, সে কখনো শেখেনি বাঁচিতে৷’’
এতটা বললেই বোঝা যায় এ এক বলিষ্ঠ মানবতাবাদীর কথা৷ আজকে বিশ্বের কেউই কবির এই মানবতাবাদের দিকটা অস্বীকার করেননি৷ কিন্তু আসল সত্যটা হচ্ছে, কবি এখানেই থেমে থাকেন নি৷ এই সুগভীর মানবতাবোধের উৎসটা কী? তা না জানলে তো ‘মানবতাবাদ’ কেবল বাগাড়ম্বর পূর্ণ বত্তৃণতার ফুলঝুরি হয়ে থাকবে৷ পৃথিবীর রুক্ষ নিষ্ক্রুণ মৃত্তিকায় তা কোনো ফসল ফলতে পারবে না৷
কবি তাঁর আন্তর উপলব্ধির গভীরতা থেকে এই মানবতাবোধের উৎসের সন্ধান পেয়েছেন–যে উৎসকে বাদ দিলে মানবতাবাদ কেবল ফাঁকা বুলিই থেকে থাকবে৷ রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধির এই গভীরতাকেই বুঝতে হবে৷ রবীন্দ্রনাথ যখনই বলছেন ‘‘স্বার্থমগ্ণ যে জন বিমুখ / বৃহৎ জগৎ হতে, সে কখনো শেখেনি বাঁচিতে৷’’ ঠিক এর পরের লাইনেই বলছেন–
‘‘মহাবিশ্বজীবনের তরঙ্গেতে নাচিতে নাচিতে
নির্ভয়ে ছুটিতে হবে, সত্যেরে করিয়া ধ্রুবতারা
মৃত্যুরে না করি শঙ্কা৷ দুর্দিনের অশ্রুজলধারা
মস্তকে পড়িবে ঝরি, তারি মাঝে যাব অভিসারে
তার কাছে–জীবনসর্বস্বধন অর্পিয়াছি যারে
জন্ম জন্ম ধরি৷’’
রবীন্দ্রনাথের এই যে গভীর অধ্যাত্ম–প্রত্যয় এটাই রবীন্দ্র আদর্শের মূল কথা৷ তিনি তাঁর বিভিন্ন কবিতায় ঘুরে ফিরে এ–কথাই বলেছেন৷ সমাজের নৈতিক, সাংসৃক্তিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সমস্ত প্রকার সমস্যার চাবিকাঠিই রয়েছে এই সর্বসঙ্কীর্ণতাহীন উদার আধ্যাত্মিকতার মধ্যে–ভূমা আদর্শের মধ্যে৷ ‘নৈবেদ্য’তে একটি কবিতায় এই আধ্যাত্মিক আদর্শ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি সুস্পষ্ট ভাবে বলেছেন ঃ
‘‘শোন বিশ্বজন, শোন অমৃতের পুত্র যত দেবগণ
আমি জেনেছি তাঁহারে মোহান্ত পুরুষ যিনি
আঁধারের পারে–জ্যোতির্ময়৷
তারে জেনে তারি পথ চাহি
মৃত্যুরে লঙিঘতে পারো অন্য পথ নাহি৷
রে মৃত ভারত
শুধু এক পথ আছে নাহি অন্যপথ৷’’
- Log in to post comments
Comments
লোকসভা নির্বাচনকে ঘিরে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি
ইদানিং লোকসভা নির্বাচনকে ঘিড়ে দেশে এখন, বলা চলে, গৃহযুদ্ধ চলছে৷ এই পশ্চিমবাঙলার প্রতি জেলাতেই নির্বাচনী প্রচারকে ঘিরে মারপিট, খুন জখম চলছে৷ নেতা-নেত্রীরা অত্যন্ত নোংরা ভাষায় পরস্পর-পরস্পরকে আক্রমণ করছে৷ নিম্নমানের ভাষাও ব্যবহার করা হচ্ছে৷ অনেকেই গণ্যমান্য নেতা-নেত্রীরা সৌজন্যের ধার ধারছেন না৷ কেন্দ্রীয় নেতা-নেত্রীরা ও রাজ্যের নেতা-নেত্রীরা যে ভাষায় পরস্পরকে গালিগালাজ করছে, নির্বাচন ফুরিয়ে গেলে কি তা সহজে ভোলা যাবে? তখন, ধরা যাক, বর্তমানে যারা কেন্দ্রে আছেন, তাঁরাই যদি সরকারে থাকেন, তাহলে কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের নেতা-নেত্রীরা আলাপ আলোচনা চালাবেন কীভাবে? যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কেন্দ্র ও রাজ্যের সহযোগিতায় দেশ চলে৷ কিন্তু কেন্দ্র ও রাজ্যের নেতা-নেত্রীদের মধ্যে এভাবে বৈরীভাব থাকলে তো জনগণকে ভুগতে হবে৷ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজকর্ম ব্যাহত হবে৷
তাছাড়া, গণতন্ত্রে যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠ দল শাসনক্ষমতায় আসে, কিন্তু দেশের স্বার্থে যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় লোকসভায় বা বিধানসভায় সব পক্ষ একত্রে বসে যে কোনো বিষয়ের ভালমন্দ বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন৷ এটাই বিধিসম্মত৷ সেক্ষেত্রে বিভিন্ন দলের নেতা-নেত্রীদের মধ্যে বৈরীভাব থাকলে চলবে না৷
এটাই সুস্থ রাজনীতি৷ কিন্তু বর্তমানে দেখছি বিভিন্ন দলের নেতা-নেত্রীরা গণতন্ত্রীয় রাজনীতিকে চরমভাবে দূষিত করে তুলছেন৷
জনপ্রতিনিধি হবেন উদার, বিচারশীল , ধৈর্য্যশীল, সকলের কথা শুনবেন, বিচার-বিবেচনা করবেন, তার সঙ্গে তাঁরা হবেন দৃঢ়ভাবে নৈতিকতায় প্রতিষ্ঠিত৷ বর্তমানে আমরা এধরণের নেতা-নেত্রীদের একান্ত অভাব অনুভব করছি৷
---সুশান্ত মাটিয়া, মেদিনীপুর