সাধনা ও সিদ্ধি

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

জ্ঞান সাধনা 
প্রত্যেক বস্তুর মধ্যে পরমাত্মাকে দর্শন করার মানুষের যে প্রয়াস সেটা তার জ্ঞানসাধনা তাহলে জ্ঞানসাধনার সিদ্ধি কী? সকল বস্তুকে পরমাত্মা–রূপে দেখা৷ যদি কেউ তা করতে পারে তাহলে জ্ঞানসাধনায় সিদ্ধিলাভ হ’ল কি না বা তার ফল কী হ’ল, তা ক্ষোঝবার জন্যে কাউকে জিজ্ঞাসা করারও প্রয়োজন পড়বে না৷ যখন সবকিছুর মধ্যে পরমাত্মার স্বরূপ দেখবে তখন নিজেই ক্ষুঝে নেবে যে জ্ঞানসাধনায় সিদ্ধিলাভ হয়ে গেছে৷ 
আত্মস্থীকরণ
জ্ঞানসাধনার ব্যাপারটা কী? ফুলের সম্বন্ধে জানলে, এইগুলিও তো জ্ঞান৷ জ্ঞান বিভিন্ন প্রকারের হয়৷ হালুইকরের মিষ্টি সম্বন্ধে জ্ঞান–এও এক প্রকারের জ্ঞান৷ কিন্তু কোনো বস্তু সম্বন্ধে জেনে নিলেই জ্ঞান সাধনা হ’ল না৷ কারণ প্রথম কথাটা হ’ল কোনো বস্তুকে জানলেই ওই বস্তুতে পরমাত্মার স্বরূপ দেখা হয় না৷ দ্বিতীয় কথাটা হচ্ছে জড়বস্তুর আত্মস্থীকরণ করা (Subjectivisation of objectivities)৷ বাইরে হাতী আছে৷ হাতী থেকে যে আলোক–তরঙ্গ নির্গত হচ্ছে সেটা চোখের ওপর পড়ল৷ এরপর সেই আলোক তরঙ্গ চাক্ষুষী নাড়ীতে প্রতিফলিত হ’ল৷ এরপর মনের বিশেষ বিন্দুতে ওই তরঙ্গ যখন পৌঁছে গেল আর তার প্রতিচ্ছায়ার স্পন্দন মনের মধ্যে হ’ল, তখন বলব মন হাতী দেখল৷ একে বলি আত্মস্থীকরণ৷ কিন্তু লৌকিক জগতে যত বস্তুই রয়েছে এদের স্বভাব হচ্ছে এরা চলমান সত্তা, কেউই স্থির নয়৷ সবকিছু চলে চলেছে৷ এই সবকিছু তিনটি ক্ষন্ধনে আক্ষদ্ধ–দেশ–কাল ও পাত্রের ক্ষন্ধন৷ একই মানুষ, দেশ ও পাত্রও সেক্ষেত্রে এক কিন্তু কালে পার্থক্য এসে যাচ্ছে৷ অর্থাৎ সময়ের পরিবর্তন হওয়ায় বিশ বছরের যুবক হয়ে যাচ্ছে সত্তর বছরের বৃদ্ধ৷ দেশ ও পাত্র একই, পরিবর্তন এসে গেল কালে৷
ঠিক একই ব্যাপার হয় দেশ সম্বন্ধে৷ অর্থাৎ স্থান–পরিবর্তন হলে৷ এক বাটি জল নিয়ে যাওয়া গেল মাউন্ট এবারেষ্টে৷ সেখানে জল আর একই রূপে থাকবে না৷ জমে বরফ হয়ে যাবে৷ স্থান পরিবর্তনের সাথে সাথে বস্তুর পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে৷ সুতরাং জগতে যা কিছু দেখছি সবই দেশ–কাল–পাত্রের অধীন৷ তাই বাইরের জগতে যে আত্মস্থীকরণ তা কখনই স্থায়ী হয় না৷ আজ কোনো কিছু প্রাপ্ত হ’ল, আগামীকাল সেটা হারিয়ে ফেললে৷ কারণ যেটা আত্মস্থীকরণ করা হচ্ছে সেটা চলছে দেশ–কাল–পাত্রানুযায়ী৷ 
তাই বাইরের জগতে কোনো কিছু আত্মস্থীকরণ তা ক্ষণিকের জন্যে৷ এটার মূল্য কতটুকু? যে সত্তা দেশ–কাল–পাত্রের আওতায় পড়ে না, একমাত্র সেই সত্তার আত্মস্থীকরণ হলে সেটা স্থায়ী হবে৷ এতে পরিবর্তন আসবে না৷ তাই সত্যিকারের জ্ঞান সেটাই যা দেশাতীত, কালাতীত ও পাত্রাতীত সত্তা সম্বন্ধে জ্ঞান অর্থাৎ পরমাত্মা সম্বন্ধে জ্ঞান আর অন্যান্য যা কিছু জ্ঞান তা জ্ঞানই নয়৷ জ্ঞানের জঞ্জাল৷ 
তোমাদের মধ্যে কেউ  স্কুল ফাইনাল বা বি এ বা এম এ পাশ করেছ৷ আমি এই মুহূর্তে যদি সেই সময়কার প্রশ্ণপত্র দিয়ে বলি উত্তর লিখতে, তোমাদের মধ্যে কেউই পাশ করতে পারবে না৷ যদিও সবাই তোমরা একদিন স্কুল ফাইনাল পাশ করেছিলে৷ তাহলে জ্ঞান কী? একমাত্র পরমাত্মার জ্ঞানই প্রকৃত জ্ঞান৷ 
‘‘আত্মজ্ঞানং বিদুর্জ্ঞানং জ্ঞানান্যন্যানি যানি তু৷
তানি জ্ঞানাবভাসানি সারস্য নৈব ক্ষোধনাৎ৷৷’’ 
আত্মজ্ঞান যার মধ্যে এসেছে সে প্রত্যেক সত্তার মধ্যে পরমাত্মার সেই দেশাতীত–কালাতীত–পা সত্তাকেই দেখবে৷ পরমাত্মা সর্বদা সকল সত্তার সঙ্গে আছেন৷ একবার তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেলে তাঁর থেকে দূরে কখনও যেতে পারবে না,  ও তিনিও তোমার থেকে দূরে যেতে পারবেন না৷
বাস্তবিক কর্ম
কর্ম সম্বন্ধে বলা হয়েছে যে মানুষ নিজের জন্যে যতটা সেবা নেবে তার চেয়ে বেশী সেবা অন্যকে দেবে৷ তখন বলা যাবে কর্মসাধনা হচ্ছে৷ যখন নিজের জন্যে কিছুই নেবে না, অন্যের অধিক থেকে অধিকতর সেবা করবে তখন ক্ষোঝা যাবে কর্মসাধনায় তার সিদ্ধিপ্রাপ্তি হয়েছে৷ তাই জিজ্ঞাসা করা দরকার নেই যে কারোর কর্মসাধনায় সিদ্ধি হয়েছে কী না৷ যখন দেখবে নিজের জন্যে কিছুই করছ না, নিজের সম্বন্ধে ভাবনা পর্যন্ত দূর হয়ে গেছে, নিজের সেবা না করে কেবল অন্যেরই সেবা করে চলেছ, তখন ক্ষুঝবে তুমি কর্ম সাধনায় সিদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছ৷ 
কর্ম কী? বস্তুর যে স্থান পরিবর্তন সেটাই কর্ম৷ বস্তুটি এখানে ছিল, ওখানে চলে গেল–স্থান পরিবর্তন হ’ল অর্থাৎ একটি কর্ম অনুষ্ঠিত হ’ল৷ আমার দ্বারা সেই কর্মটি হ’ল৷ যার দ্বারা বস্তুর স্থান পরিবর্তন সিদ্ধ হয় তাকে বলব কর্মী৷ তুমি যা কিছুই কর না কেন  তাকে কর্ম বলা হবে৷ শ্বাস পরিবর্তনও একটি কর্ম কারণ এতে হূদ্পিণ্ড–ফুসফুস ও বুকের পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে৷ তাহলে সত্যিকারের কর্ম কী? যার দ্বারা স্থান পরিবর্তন স্থায়ী হয় সেটাই কর্ম৷ তুমি এখান থেকে জয়পুর গেলে৷ এরপর তুমি বলতে পারবে না যে তুমি জয়পুর থেকে আর কোথাও যাবে না৷ বলতে পার যে জয়পুর থেকে আমি যেতে চাই না৷ হতে পারে পরবর্তীকালে লোকে তোমার মৃতদেহ দিল্লীর নিগমক্ষোধ ঘাটে দাহ সংস্কার করল৷ আজ আমি কয়েকটি ছেলেকে বলেছিলুম একটা লোহা৷ একে গরম করা হ’ল৷ ৩০০০০সি–এ গরম হলে এটা তরল হয়ে যাবে৷ আর অধিক গরম করলে গ্যাস হয়ে যাবে৷ 
মন কী? প্রকৃতির ক্ষন্ধনে আত্মা কিছুটা স্থূল হয়ে মনে রূপান্তরিত হয়৷ প্রকৃতির ক্ষন্ধন আরো বাড়লে মন জড় জগতে পঞ্চভূতে (five fundamental factors) রূপান্তরিত হয়৷ আমরা যে পঞ্চভূত দেখি সেটা আসলে কী? পরমাত্মার মন জড়ে রূপান্তরিত হয়েছে৷ এটা সঞ্চর ক্রিয়া কেন না এতে পরিবর্তন  এসেছে৷ কর্ম হচ্ছে সাধনা৷ তোমার মনকে যদি অধিক উত্তাপ দেওয়া হয় তবে মন সূক্ষ্ম হয়ে যাবে৷ লোহা তরল পদার্থে পরিণত হয়ে যায়৷ তরল পদার্থ গ্যাসে পরিণত হয়ে যায়৷ মনের এই যে অবস্থা, অধিক উত্তাপ প্রয়োগ করলে মন আত্মায় রূপান্তরিত হয়ে যাবে৷ কারণ মনের উৎপত্তি আত্মা থেকে৷ মন সূক্ষ্ম হয়ে যায়, মন আত্মা হয়ে যায়৷ তোমার মনে যখন সাধনাগ্ণি প্রজ্জ্বলিত হবে তখন মন আত্মা হয়ে যাবে৷ এই হ’ল কর্ম৷ মনের এই যে আত্মায় রূপান্তরণ– এ স্থায়ী রূপান্তরণ কারণ এই আত্মা আবার মনে পরিণত হতে পারবে না৷ এ হ’ল স্থায়ী কর্ম৷ তাই ঈশ্বর–উপাসনাই স্থায়ী কর্ম৷ যেমন ঈশ্বর–জ্ঞান সত্যিকারের জ্ঞান তেমনি ঈশ্বর–উপাসনাই স্থায়ী কর্ম, আর অন্য সব কর্ম কর্মই নয়৷