দুধের মধ্যে যে রকম ঘি ব্যাপ্ত হয়ে থাকে আর মন্থন করলে সেটা ওপরে উঠে আসে, ঠিক সেই রকম তোমার মধ্যে পরমপুরুষ ব্যপ্ত আছেন সাধনারূপী মন্থনের দ্বারা তুমি তাঁকে পেয়ে যাবে৷ মন্থন করলে যে মাখন বেরিয়ে আসে, সেটাই পরমপুরুষ৷ তিনি তোমার ভিতরে আছেন ঘরের মধ্যে কোনো দেবতাকে তুমি বাহ্যিক পূজা করে, বহিরাঙ্গিক সাধনার দ্বারা তাঁকে পাবে না৷ বরং সেটার দ্বারা তুমি তাঁর থেকে আরো দূরে সরে যাবে৷
লোক বলে, ‘এখানে তীর্থ, এই কুণ্ডে স্নান করলে শত অশ্বমেধ যজ্ঞের পুণ্যপ্রাপ্তি হবে৷ তামসিক মন আর সেই প্রকার কার্যরত মানুষ এখানে পবিত্র হয়ে যাবে৷’ যদি ঠিকভাবে দেখ তো বুঝবে এই স্নানের দ্বারা চর্মরোগের আক্রমণের সম্ভাবনা৷ সত্যিকারের তীর্থ তো আত্মতীর্থ যেখানে পৌঁছতে গেলে না এক পাও চলতে হয়, না এক সেকেণ্ড সময় লাগে৷ কখনো কখনো জাগতিক কাজ করতে করতে বেশী সাধনা করবার ইচ্ছা জাগবে, একেই বলে উপবাস৷ উপবাসে মনের ভিতর লুক্কায়িত পরমপুরুষের কাছে (উপ) বাস করবার প্রয়াস আছে৷ উপবাসের এই হচ্ছে প্রকৃত অর্থ৷ এই উপবাস পালনের ফলে সন্তুলিত আহারের সহায়তা পাওয়া যায়৷ এর অর্থ এই নয় যে আহার না করলে পরমাত্মার প্রাপ্তি হয়ে যাবে৷
নদী শুকিয়ে গেছে, ওপরে আছে বালু কিন্তু বালির নীচে স্বাভাবিকভাবে পরিশ্রুত নির্মল জল আছে৷ ওপরের বালিকে সরিয়ে দাও, আর নির্মল জলের দ্বারা নিজের পিপাসা তৃপ্ত কর৷ মনের ময়লাকে দূর কর, আর আত্মানন্দপ্রাপ্তি দ্বারা তৃপ্ত হয়ে যাও৷ অরণির ভিতর যেমন আগুন থাকে সেই রকম তোমার ভিতর পরমপুরুষ আছেন৷ সাধনারূপী ঘর্ষণে এই অগ্ণি প্রকট হয়ে যাবে৷
পরিশ্রম কে বেশী করে? জ্ঞানী অথবা কর্মী? এরা ভগবানকে সহজে পেতে চায়৷ জ্ঞানীর তথাকথিত জ্ঞানের মধ্যে দু’টি অবগুণ আছে–প্রথম আলস্য, দ্বিতীয় হচ্ছে অহংকার৷ অহংকারী মানুষ পরমাত্মা থেকে অনেক দূরে থাকে৷ আলস্যের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হচ্ছে আধ্যাত্মিক আলস্য৷ ‘আজ দেরী হয়ে গেছে, সাধনা করব না, কালকে ঠিকভাবে সাধনা করে নোব’৷ সিনেমা–নাটক–আহার এসবে তো ঠিক সময় দেওয়া হয় অথচ কাটা হয় সাধনার সময় দেওয়ার ব্যাপারে, কেবল ভগবৎ–চর্চার সময়ই ঘুম আসে৷
তোমাদের একটা গল্প মনে আছে যে, রামের বনবাস কালে চোদ্দ বছর পর্যন্ত লক্ষ্মণ দিন–রাত জেগে থেকে প্রতিদিন রামের রক্ষক রূপে পাহারা দিয়েছেন৷ এক দিন তার ঘুম এসে গেল৷ তখন বীর লক্ষ্মণ ধনুক–বাণ নিয়ে নিদ্রাদেবীকে মারতে উদ্যত হ’ল৷ নিদ্রাদেবী বললে–‘‘আপনি কী রকম বীর? একজন মহিলার ওপরে অস্ত্রের প্রয়োগ করছেন৷’’ লক্ষ্মণ বললেন–‘‘ক্ষমা করুন, এখন আপনি আসবেন না, যখন রামের অযোধ্যায় রাজতিলক অনুষ্ঠান হয়ে যাবে তখন আপনি আসতে পারেন৷’’ তারপর তিলক সমারোহে দরবার ভর্ত্তি লোকের সামনে লক্ষ্মণ যখন রামের সেবা করছিলেন, তখন নিদ্রাদেবী তাঁর ওপর আক্রমণ করে বসলেন৷ লক্ষ্মণ আবার বিরোধ করলেন, তখন নিদ্রাদেবী জিজ্ঞেস করলেন–‘আমি তাহলে কোথায় যাব’ লক্ষ্মণ বললেন–‘‘যখন কোনো ধর্মসভায় কোনো অধার্মিক পৌঁছে যায়, আপনি তার চোখের ওপর গিয়ে এখন থেকে বসবেন৷’’ তারপর থেকে নিদ্রার এই নিয়ম চলতে থাকল৷
কর্মীর মধ্যে একটাই দোষ আর তা হচ্ছে অহংকার৷ কিন্তু ভক্ত জানে সে কিছুই নয়, পরমপরুষই সবকিছু সে কেবল যন্ত্র আর তিনি যন্ত্রের চালনাকারী৷ কর্মের শ্রেয় তার প্রাপ্য নয়, তাই ভক্তের মধ্যে অহংকার আসে না৷ আর আলস্যও আসে না কেননা সে ভাবে যে, ‘আমার ভগবানের কাজ আমি করবো না তো কে করবে? আমি কার অপেক্ষায় থাকব যে অন্য কেউ তাঁর কাজ করে দেবে? ভক্তের মধ্যে ইষ্টের আদেশ প্রতিপালন না করা পর্যন্ত বিশ্রাম করার প্রবৃত্তি থাকেই না৷ জ্ঞানীর ভগবান পুস্তকের ভগবান, তা গাছের মিষ্টি ফল অর্থাৎ জলের ওপর পড়া ছায়ার সমান, যা কোনরকমের ক্ষুধা তৃপ্ত করতে পারে না৷ কর্মীর ভগবান ষ্টীম রোলারের মত৷ তা চলছে কিন্তু তার মধ্যে কোনো জ্ঞান নেই৷
জ্ঞানীর ভগবান সম্বন্ধে মহিম্নবোধ থাকে৷ সে ভগবানের নিকটে পৌঁছাতে পারে না৷ সিদ্ধান্তের মধ্যে, থিওরির মধ্যে সে ভগবানকে জানবার চেষ্টা করে কিন্তু তাঁর কাছে পৌঁছতে পারে না৷ তুমি কারোর থেকে দূরে অবস্থান করে তার সেবা করতে পারো না৷ ভক্ত ভগবানের সঙ্গে সতত সম্পর্কিত থাকে৷ সে বলে যে ভগবান যদি তাকে আঘাতও দেন, তাহলেও সে খুব আনন্দিত হবে কেন না আঘাত করার সময় তো ভগবানকে তাকে ছুঁতেই হবে৷ ‘পরমপুরুষ আমাকে ছুঁয়ে নিয়েছেন, এটাতো আমার মহাভাগ্য৷ তিনি আমার আঘাত দিন আর শাস্তিই দিন, আমার শুধু চাই তাঁর সঙ্গে সতত সম্পর্ক৷ আমি জোর করে তাঁর সেবা করব৷ আমি চিৎকার করে করে তাঁর নাম–কীর্ত্তন করব৷’
এক মায়ের তিন ছেলে–জ্ঞানী, কর্মী আর ভক্ত৷ জ্ঞানী ভাবে, মা–তো রান্নাঘরে, এই সময় তার কোনো অবসর নেই, অবসর পেলেই তিনি আসবেন৷ সেই সময় পর্যন্ত আমি কিছু পড়াশুনা করে নিই৷ কর্মী ভাবে মা বাসন–কোষণ পরিষ্কার করছেন, আমি ঘরটা পরিষ্কার করে নিই৷ ভক্ত না কিছু ভাবে, না কিছু করে, খালি চিৎকার করে করে মাকে ডাকতে থাকে, আর মা–কে সব কাজ ছেড়ে এসে তাকে কোলে নিতেই হয়৷ এই জন্যে বুদ্ধিমত্তার কাজ হ’ল এটাই যে পরমপুরুষের সম্পর্কে এসে যাওয়া৷ ভক্তের কাছে ভগবানই সবকিছু৷ তিনি সব প্রভুর প্রভু, সব ঈশ্বরের ঈশ্বর, তাই তিনি মহেশ্বর৷ এই জগতে পরমপুরুষের যত অভিব্যক্তি আছে অর্থাৎ যত দেব’ আছে তিনি সব দেবের কারণস্বরূপ অর্থাৎ মহাদেব৷ ভগবানই সত্যিকারের সকলের রাজা, বাকি রাজা নাটকের রাজারূপী এক একটা পাত্রমাত্র৷
মনে রাখবে সেই পরমতত্ত্ব এক৷ তার থেকেই তোমার উৎপত্তি, তুমি কারো থেকে হীন নও কেননা তুমি পরমপুরুষষের সন্তান৷ পণ্ডিতেরা যতই তোমাকে হতোৎসাহিত করুক না কেন, তুমি এটা ভুলো না যে তুমি পরমপুরুষের সন্তান৷ এইজন্যে তুমি কারোর থেকেও কম শ্রেষ্ঠ নও৷ তোমাদের জয় হোক৷ ৭ জানুয়ারী ১৯৭১, পটনা