‘‘অন্যচ্ছ্রেয়োন্যদুতৈব প্রেয়স্তে উভে নানার্থে পুরুষং সিনীতঃ৷
তয়োঃ শ্রেয় আদদানস্য সাধু ভবতি হীয়তের্থাদ্ য উ প্রেয়োবৃণীতে৷৷’’
দু’টি মুখ্য বৃত্তি মানুষকে পরিচালিত করছে৷ একটি শ্রেয় আর অন্যটি প্রেয়৷ এদের মধ্যে মৌলিক পার্থক্যটা কী? একটি জড়াভিমুখী (Analytical by nature) অর্থাৎ স্বাভাবিক বিশ্লেষণাত্মক আর অন্যটি আত্মাভিমুখী (Synthetical) অর্থাৎ সংশ্লেষণাত্মক৷ তাহলে কোন্ মানুষটি কিরকম সেটি ৰুঝব কী করে? সেই মানুষটি দু’য়ের মধ্যে কোন্ বৃত্তি দ্বারা পরিচালিত, সেটা দেখেই তাকে চিনে নিতে পারব৷
এই যে শ্রেয় আর প্রেয় বৃত্তি, এই দু’টি সম্পূর্ণভাবে পরস্পর বিরোধী একটি উত্তর দিক তো অন্যটি দক্ষিণ দিক৷ এই দু’য়ের মধ্যে কখনই সংযোগ হতে পারে না৷
বাস্তবিক জীবনে কখনো কখনো তোমরা দেখবে যে মনের মধ্যে একটা সংঘর্ষ এসে গেছে–‘এরকম করলে এই ফল পাব আর ওই রকমটি করলে ওই রকমই ফল পাব৷ তাহলে আমি কোন্টা করব আর কোন্টা করব না?’ সে অবস্থায় মানুষ খোঁজে মধ্যম মার্গকে অর্থাৎ সাপও মরল কিন্তু লাঠি ভাঙ্গল না৷ এখানে একটা কথা মনে রাখবে পাপের বিরুদ্ধে সংগ্রাম তুমি আজকেই না করে কাল বা পরশু করতে পার, দু’–তিন দিন সময়ও নিতে পার কিন্তু কীজন্যে? –না, প্রস্তুতির জন্যে৷ অর্থাৎ মনে রাখবে বিরোধী শক্তির সঙ্গে সংগ্রামে যুদ্ধ–বিরাম (truce) হতে পারে–সন্ধি (pact) কখনই নয়৷ যুদ্ধ বিরাম কাকে বলব? ধর, দুই দলের মধ্যে লড়াই চলছে, দুই দল নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে ঠিক করল যে আজ সূর্যাস্তের পরে লড়াই করবে না কেননা খ্রীষ্টমাসের দিন বা বড়দিন, তাই লড়াই করবে না৷ অর্থাৎ এক্ষেত্রে লড়াই বন্ধ করা হ’ল না৷ লড়াই চলতে থাকবে, একে বলব যুদ্ধ–বিরাম৷ আর সন্ধি কী? তুমি এক শর্ত দিলে, অন্যে আর একটা শর্ত দিল, আর এর এই শর্তটা মেনে নেওয়া হ’ল–ইত্যাদি ইত্যাদি৷ একে ইংরাজীতে বলব pact, আর সংস্কৃতে সন্ধি৷ তাই বিরোধী ভাব বা বিরোধী শক্তির সঙ্গে সন্ধি হবে না৷ যুদ্ধ–বিরাম হতে পারে৷ তুমি যুদ্ধ–বিরাম করতে পার নিজের শক্তি বাড়ানোর জন্যে৷ আজ তুমি একা আছ, অথচ বিরোধী পক্ষে আছে দশ, তুমি যুদ্ধ–বিরাম করে সংখ্যা বাড়িয়ে বিশ জন হয়ে আগামীকাল লড়াই করবে৷ ভালো মানুষকে সর্বদাই এই কথা মনে রাখতে হবে যে অসাধুতার সঙ্গে, পাপের সঙ্গে কোনো প্রকারের সমঝোতা হতে পারে না৷
‘‘অন্যচ্ছ্রেয়োন্যদুতৈব প্রেয়ঃ’’– শ্রেয় আর প্রেয় দু’টি পৃথক পৃথক বস্তু৷ যেমন সরিষার তেল আর দুধ৷ দুইকে মিলিয়ে দিলে কিন্তু এরা মিলবে না, সেই অবস্থায় তা অপেয় হয়ে যাবে, অখাদ্য হয়ে যাবে৷
‘‘উভেনানার্থে পুরুষং সিনীতঃ’’৷ নানা অর্থে, বহুবিধ অর্থে অর্থাৎ বিভিন্ন অর্থে শ্রেয় আর প্রেয় মানুষকে পরিচালিত করে৷ প্রেয় মানুষকে চালায়, শ্রেয়ও চালায় কিন্তু দু’য়ের তাৎপর্য পৃথক পৃথক৷
‘‘তয়োরশ্রেয় আদদানস্য সাধু ভবতি হীয়তে অর্থাদ্যউপ্রেয়োবৃণীতে৷৷’’ শ্রেয় কী করে? তা মানুষকে পরমপুরুষের পানে, সৎ–এর কাছে, সাধুতার দিকে নিয়ে চলে৷ শ্রেয়ের স্বভাব হচ্ছে এই– মনুষ্যকে সৎ করা, পবিত্র করা, ঈশ্বরাভিমুখী করা৷ অর্থাৎ centripetal বা কেন্দ্রানুগামী গতি হ’ল শ্রেয়, আর centrifugal অর্থাৎ কেন্দ্রাতীগ গতি হ’ল প্রেয়৷
‘‘শ্রেয় আদদানস্য সাধু ভবতি৷’’
এই যে সাধু হওয়া, এর অর্থ ভস্ম লাগানো নয়৷ সাধু হওয়া মানে যার জীবন পবিত্র, সাধু মানে যার মধ্যে সর্বাত্মক সংযম আছে৷ সর্বাত্মক সংযম মানে কী? মনে রাখবে সংযমের অর্থ বৃত্তিকে হত্যা করা নয়, বৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা৷ কোশী নদীর ওপর ড্যাম বা ব্যারেজ তৈরী হ’ল৷ এর অর্থ কোশী নদীকে আমরা ধ্বংস তো করে দিলাম না৷ এই নদীতে যে প্রাণশক্তি ছিল, যে প্রাণশক্তি উত্তর বিহারের পক্ষে বিপদস্বরূপ ছিল, সেই প্রাণশক্তিকে আজ আমরা কল্যাণদায়িনী শক্তি রূপে পরিবর্তিত করে দিলুম৷ এইভাবে সংযম মানে সুনিয়ন্ত্রণ–নিয়ন্ত্রণ করে ভালো কাজে লাগিয়ে দেওয়া–এই হ’ল সংযম৷ সাধু সেই–ই যার মধ্যে আছে এই সর্বাত্মক সংযম৷ ভস্ম সে লাগাল না, টাই কোটপ্যাণ্ট পরে একেবারে জেণ্টলম্যান কিন্তু সেও সাধু হতে পারে৷ নিজেকে জাহির করবার জন্যে সাধু নয়৷ তাহলে সাধুতা হচ্ছে আন্তরিক জিনিস৷