সৈদ্ধান্তিক তত্ত্ব ও প্রয়োগভূমি তত্ত্ব

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

যে সিদ্ধান্ত প্রয়োগভূমি থেকে আত্মপ্রকাশ করে তাকে স্বল্পায়াসেই বাস্তবে রূপায়িত করা যায়৷ সে সিদ্ধান্ত অবশ্যই বাস্তাবায়িত হবে, তবে তা প্রচেষ্টা, সময় ও সংযোগের ওপর নির্ভরশীল৷ কিন্তু যখন প্রয়োগের দিকটা সিদ্ধান্ত তৈরী করার পরে আসে, তখন বাস্তবে রপায়িত হতেও পারে আবার নাও হতে পারে৷

এই ধরণের সৈদ্ধান্তিক তত্ত্বের ব্যর্থতার চারটি কারণ৷ কারণগুলি নিম্নে প্রদত্ত হ’ল ঃ

 প্রথমটি হচ্ছে ভণ্ড-মনস্তত্ব (হিপোক্রাইটস সাইকোলজি)৷ কপটাচারী সিদ্ধান্ত তৈরী করে ঠিকই কিন্তু তা প্রয়োগ-ভূমিতে অসিদ্ধ৷ তত্ত্বের নাম ভাঙিয়ে সে তার ও দলের স্বার্থ-সিদ্ধি করে৷ সুতরাং তা কখনোই বাস্তবায়িত হবে না৷ তা শুধুমাত্র লোক দেখানো৷ প্রাচীন যুগে, মধ্যযুগে ও এমনকি বর্তমান যুগেও অনেক সংখ্যায় ওই ধরণের সিদ্ধান্ত রয়েছে৷ এর প্রবর্তকেরা কপট৷ এরা জনসাধারণকে বড় বড় কথা বলে তাদের বিভ্রান্ত করে থাকে৷ এই ধরণের লোক সম্পর্কে সদাশিব বলেছেন ‘লোক ব্যামোহ কারকঃ’৷ অর্থাৎ এরা জনগণের মনে রোগের সঞ্চার করে থাকে৷ সমস্যার সমাধান করা তাদের উদ্দেশ্যে নয়৷ মানব সমাজে অবক্ষয়, দুর্দশা ও অধঃপতনের এটাই প্রধান কারণ৷ মানব-সমাজের বর্তমান সংকটের মূল৷ এই ধরণের সিদ্ধান্ত অতীতে ছিল, বর্তমানেও আছে৷ এগুলোর পেছনে রয়েছে কপটের ভণ্ড মনস্তত্ব--- কপটাচারীদের বৌদ্ধিক অমিতাচার intellectual extravaganza)৷ তোমরা অবশ্যই সামাজিক স্তরে , অর্থনৈতিক স্তরে ও জীবনের বিভিন্ন স্তরে এই ধরণের শে কিছু সংখ্যক সিদ্ধান্ত দেখে থাকর্ে৷ এটা শুধুমাত্র একটা বিশেষ সমস্যা নয়, সমগ্র বৌদ্ধিক জগতের সমস্যা৷ আমি সভ্যতার সংকট সম্পর্কে তোমাদের লেছি যে, এই সংকটের কারণ হ’ল মার্জিত শয়তানদের বৌদ্ধিক অমিতাচার৷ উদাহরণ স্বরূপ যেমন মিশ্র অর্থনীতি৷ যাঁদের এই বিষয়ে জ্ঞান আছে তাঁরা সকলেই জানেন যে, এটি একটি প্রহসন মাত্র৷ অতীতে তা কোনও দিন বাস্তবায়িত হয়নি আর ভবিষ্যতেও হবে না৷ এটা মিথ্যার মার্জিত রূপ মাত্র ৷ এর বাস্তবায়ন কখনই সম্ভব নয়৷ এর প্রবর্তকেরা এই সম্পর্কে মোটেই ওয়ার্কিহাল নয়, আর তারা ওয়ার্কিহাল হতেও চাইর্ে না৷ কেননা, তাদের উদ্দেশ্যে হ’ল অন্যকে ধোঁকা দেওয়া৷ অন্য একটি উদাহরণ হ’ল শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান৷ এটি কখনো কার্যে পর্যবসিত হয়নি, হচ্ছে না আর হবেও না৷ আরেকটি হ’ল, গণতান্ত্রিক সমাজ বাদ৷ একে সোণার পাথরবাটি বলা যেতে পারে৷ পাথরবাটি পাথরের হয়, সোণার নয়৷ এই কাজের পেছনে রয়েছে কপট দ্ধি৷ কোনও সিদ্ধান্তের অসাফল্যের চতুর্বিধ কারণের এটি অন্যতম৷

পরবর্তীটি হচ্ছে--- তাত্ত্বিক মনস্তত্ব৷ এখানে ভণ্ড-মনস্তত্ত্ব কাজ করে না৷ যখন কোনও তাত্ত্বিক সিদ্ধান্ত রচনা করে তখন সে বাস্তব জগতের দিকে তাকায় না৷ তারা দেখে না তাদের পায়ের তলায় কী আছে৷ তারা হাওয়ার ওপরে দুর্গ রচনা করে৷ কারণ বাস্তবের সঙ্গে ওদের কোন সম্পর্ক নেই৷ তর্কজীব্য দর্শনও এইরূপ৷ কিছুদিন পর সিদ্ধান্ত বিলুপ্ত হয়৷ ভারতের জনজীবনে বহু সিদ্ধান্ত প্রবর্তিত হয়েছে, কোন কোন সিদ্ধান্তের প্রয়োগের দিকও রয়েছে৷ তাই এগুলো কিছুটা পরিমাণে সার্থক হবে৷ কিন্তু তোমরা লক্ষ্য করে থাকর্ে অন্য পাঁচটি আস্তিক্য দর্শনের তুলনায় ন্যায় দর্শন বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক না রেখে অনেক দূর পরিক্রমা করেছে৷ তবে তা কণাদের ন্যায় দর্শন নয়, গৌতমীর ন্যায় দর্শনের লোয় প্রযোজ্য৷ তাই গৌতমীর ন্যায় দর্শনের ওপর ভিত্তি করে কোনও বাস্তব কার্য সাধিত হতে পারে না৷ মধ্যযুগে বহু নৈয়ায়িক ‘পাত্রাধার তৈল’ কিংবা ‘তৈলধার পাত্র’ এই নিয়ে গবেষণা করে গেছে৷ মূলতঃ এর সঙ্গে বাস্তব জগতের কোনও সম্পর্ক নেই৷

 তাত্ত্বিক মনস্তত্ত্বের (থিয়োরিটিসিয়ান সাইকোলজি) অন্য একটি দিক হ’ল ঃ মানুষের জীবন ত্রিধা প্রকাশিত --- শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক৷ এরা আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে প্রবেশ করে না৷ এর ফলেই এরা সৈদ্ধান্তিক তত্ত্বকে প্রয়োগ-ভৌমিক তত্ত্বে রূপান্তরিত করতে পারে না৷ প্রথমতঃ সিদ্ধান্ত অবাস্তব৷ দ্বিতীয়তঃ বাস্তব রূপায়ণে অভাব৷

তৃতীয়টি হ’ল--- প্রয়োগের ক্ষেত্রে অক্ষমতা (ইনএফিসিয়েন্সি ইন দি ফিল্ড অব্ এ্যাপ্লায়েন্স)৷ সিদ্ধান্ত যথাযথ হলেও অনভিজ্ঞতার ফলে অথবা অন্য কোনও ত্রুটির জন্যে তা বাস্তবে রূপায়িত হয় না৷ অনেক সময় কোনও মানুষ ব্যষ্টিগত জীবনে অনেক দক্ষ, কিন্তু সমষ্টিগত জীবনে পুরোপুরি অসফল৷ ভারতে বৌদ্ধ যোগাচারের যুগে মহান সাধকগণ শুধু মাত্র ব্যষ্টিগত জীবনেই সফল ছিলেন৷ তাঁরা জগতের কথা ভাবতেন না, আর মানুষকে বাস্তব জীবনে কর্মক্ষম করে তুলতে চেষ্টা করেন নি৷ তৎকালীন ভারতের জীবন সম্পর্কে যাঁরা সামান্যতম ওয়াকিবহাল আছেন --- তাঁরা জানেন যে, সত্যিকারের সিদ্ধান্তের অনুপস্থিতির জন্যে(না তাত্ত্বিকদর্শন, না বাস্তব দর্শন) সেই সময় বৌদ্ধ সাধকগণ শংকরাচার্য কর্তৃক পরাস্ত হয়েছিলেন৷ এর ফলে শংকরাচার্যের পরবর্তীকালে ভারতবর্ষে এক বৌদ্ধিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল৷ এই শূন্যতা ভারতের জন্যে অত্যন্ত ভয়াবহ ছিল৷ এই শূন্যতার স্থায়িত্বকাল ছিল --- শংকরাচার্য থেকে চৈতন্য মহাপ্রভু পর্যন্ত৷ (পরবর্তী সংখ্যায় সমাপ্য)